রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ছয়টি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা সংস্কারে ছয় বিশিষ্ট নাগরিককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ড. বদিউল আলম মজুমদার, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে কাজ করবেন সরফরাজ চৌধুরী, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ড. ইফতেখারুজ্জামান, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে জনাব আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী, সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসেবে ড. শাহদীন মালিক দায়িত্ব পালন করবেন।
বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এই তথ্য জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, সমাজের সব স্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব ও স্বার্থ নিশ্চিত এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বার্তাকে প্রতিফলিত করার জন্য সাংবিধানিক সংস্কারের প্রয়োজন আমরা অনুভব করছি। এসব বিষয়ে সংস্কারের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে আমরা প্রাথমিকভাবে ছয়টি কমিশন গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এসব কমিশনের কাজ পরিচালনার জন্য বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে ছয় জন বিশিষ্ট নাগরিককে এই কমিশনগুলো পরিচালনা করার দায়িত্ব দিয়েছি। এরপর আরও বিভিন্ন বিষয়ে কমিশন গঠন প্রক্রিয়া আমরা অব্যাহত রাখবো।
কমিশনের প্রধানদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়
ড. বদিউল আলম মজুমদার একজন অর্থনীতিবিদ, রাজনীতি বিশ্লেষক, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও উন্নয়নকর্মী। বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের বর্তমান পর্যায়ে ‘দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট’-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ও গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া তিনি নাগরিক সংগঠন ‘সুশাসনের জন্য নাগরিক’- সুজন-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এবং জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ড. বদিউল আলম মজুমদার কুমিল্লা জেলার লাকসাম উপজেলার পোলাইয়া গ্রামে ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬২ সালে নওয়াব ফয়জুন্নেছা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন তিনি। ১৯৬৯-৭০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীকালে উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন।
১৯৯১ সালে ড. বদিউল আলম মজুমদার দেশে ফিরে আসেন এবং ক্ষুধামুক্ত ও আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ও ব্রত নিয়ে ‘দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট’-এর সঙ্গে যুক্ত থেকে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন।
২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ড. বদিউল আলম মজুমদারকে ‘বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির’ (বার্ড) বোর্ড অব গভর্নরসের সদস্য করে। একই বছর তিনি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান গতিশীল ও শক্তিশালীকরণ কমিটি’র একজন সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমান বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি ছিলেন। ১৯৭২ সালে ঢাকা জেলা জজ আদালতে আইন ব্যবসা শুরু করেন। বিচারপতি মমিনুর রহমান ১৯৭৪ সালে হাইকোর্ট বিভাগের আইনজীবী হয়। ১৯৮০ সালে তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী হন। পরে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন।
তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারকদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র বিচারপতি এবং ২০১১ সালে বাংলাদেশের ২০তম প্রধান বিচারপতি হওয়ার পরের সারিতে ছিলেন। তাকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ না দিয়ে বাংলাদেশ সরকার মোজাম্মেল হোসেনকে নিয়োগ দেয়। মমিনুর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের রাজনীতিবিদ হান্নান শাহের ছোট ভাই এবং আওয়ামী লীগ সরকার তার পদোন্নতি দুবার উপেক্ষা করেছিল। দ্বিতীয়বার পদোন্নতির জন্য উপেক্ষা করায় তিনি সুপ্রিম কোর্ট থেকে পদত্যাগ করেন।
ড. ইফতেখারুজ্জামান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক। ইফতেখারুজ্জামান ১৯৬৮ সালে মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, যশোরের অধীনে তার উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি অর্থনীতিতে স্নাতক অধ্যয়ন সম্পন্ন করেন রকলা ইউনিভার্সিটি অব ইকোনমিক্স থেকে। তিনি এসজিএইচ ওয়ারশ স্কুল অব ইকোনমিক্স থেকে পিএইচডি অর্জন করেন। ১৯৮৮ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়ে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পোস্ট ডক গবেষণা করেছেন।
১৯৯১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ইফতেখারুজ্জামান বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ছিলেন। এরপর বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশন ছেড়ে তিনি ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন।
আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী অবসরপ্রাপ্ত একজন সরকারি কর্মকর্তা। ২০০১ সালে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার সাবেক প্রধান উপদেষ্টা লতিফুর রহমানের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
আব্দুল মুয়ীদ ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (বর্তমান বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস) যোগদান করেন। তিনি ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা ও ১৯৭৮ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর ঢাকা জেলার ডেপুটি কমিশনার এবং ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিভাগের কমিশনার ছিলেন। ১৯৯৪ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করে অবসর গ্রহণ করেন। ৩৩ বছরের কর্মজীবনে তিনি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগসহ বিভিন্ন বিভাগ ও দফতরের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯৬-৯৮ সাল পর্যন্ত যমুনা বহুমুখী সেতু কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক এবং যমুনা সেতু বিভাগের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় তিনি বঙ্গবন্ধু সেতুর নির্মাণ কাজ রেকর্ড সময়ে সফলভাবে সম্পন্ন করেন।
২০০০ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের প্রধান পরিচালনা কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ স্পোর্টস শুটিং ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন। তিনি ২০০৪-২০০৮ সাল পর্যন্ত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) গ্লোবাল কাউন্সিলর ছিলেন।
শাহদীন মালিক পেশায় একজন আইনজীবী। বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ। তার বাবা আব্দুল মালিক চৌধুরী ছিলেন বন বিভাগের প্রধান সংরক্ষক কর্মকর্তা। তিনি ১৯৭৯ সালে রাশিয়ার প্যাট্রিস লুমুম্বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। তিনি ১৯৮৪ সালে ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া ল স্কুল থেকে আইন বিষয়ে আরেকটি স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এরপর ১৯৯৪ সালে স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ থেকে পিএইচডি করেন। তিনি ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন।
শাহদীন মালিক ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টে যোগদান করেন। ২০০৩ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে তার আইন পেশা শুরু করেন। মালিক ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও শিক্ষক ছিলেন। ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের সম্মানিত পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর সমালোচনা করেন, যা পরে তত্ত্বাববধয়ায়ক সরকার বাতিল করে।
২০১৩ সালে তিনি বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী ছিলেন। মালিক সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। তিনি অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ এবং রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের গভর্নিং বডির সদস্য এবং একইসঙ্গে তিনি পূবালী ব্যাংক লিমিটেডের স্বতন্ত্র পরিচালক। তিনি গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডজাঙ্কট প্রফেসর। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনারের বিবেচনা থেকে তার নাম প্রত্যাহার করে নেন। নির্বাচন কমিশন গঠনে তৈরি করা সার্চ কমিটি তার নাম প্রস্তাব করেছিল।
এছাড়া পুলিশ সংস্কার কমিশনের নেতৃত্বদাতা হিসাবে সরফরাজ চৌধুরীর নাম ঘোষিত হয়েছে। তবে তার বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি।