
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম শহরের সবচেয়ে ব্যস্ততম জংশন ষোলশহর স্টেশন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অবস্থানের কারণেই ব্যস্ততম জংশনে পরিণত হয় ষোলশহর স্টেশনটি। এ কারণে স্টেশনটি ঘিরে গড়ে উঠেছে স্থায়ী ও ভাসমান (ভ্যান গাড়ি) দোকান।
যার শতভাগই গড়ে তোলা হয়েছে রেলওয়ের জমি জবর দখল করে। বর্তমানে ষোলশহর স্টেশন ঘিরে রয়েছে অন্তত সাত শতাধিক স্থায়ী দোকান ও মার্কেট। প্রতিদিন বসে ৩ শতাধিক ভাসমান ভ্যান গাড়ির দোকানও। যেখান থেকে দৈনিক ও মাসিক ভাড়া নেন ষোলশহর স্টেশন মাস্টার মুহাম্মদ জয়নাল।
যার কারণে দোকান ও মার্কেট ভবনের মালিক ও ব্যবসায়ীরা জয়নালকে স্টেশন মাস্টার না ডেকে ডাকেন জমিদার। দোকান ও মার্কেট ভবনের মালিক-ব্যবসায়ীদের মতে, স্টেশন মাস্টার জয়নাল ভাসমান ভ্যান গাড়ির দোকান থেকে প্রতিদিন ভাড়া হিসেবে তুলেন ৩০০ টাকা হিসেবে।
আবার কোন কোন ভ্যানগাড়ির দোকান থেকে ৫০০ টাকা হিসেবেও আদায় করেন। সে হিসেবে প্রতিদিন আদায় করেন লাখ টাকা। আর সাত শতাধিক দোকান ও মার্কেটের প্রতিটি থেকে মাসিক ভাড়া নেন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা করে। যেখান থেকে আদায় করেন ১ কোটি টাকার মতো।
এছাড়া করেন রেলের টিকেট বাণিজ্যও। নির্ধারিত মুল্যের চেয়ে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেশি ছাড়া টিকেট বিক্রি করেন না তিনি। জড়িত তেল চুরির সাথেও। এভাবে প্রতি মাসে কোটি টাকা বাণিজ্য করেন তিনি। তবে এর পুরোটা জুটে না তার কপালে। ভাগবাটোয়ারা শেষে তিনি মাসে ভাগে পান ১০ লাখ টাকার মতো।
অবৈধ এই আয়ের বাকি টাকার ভাগ চলে যায় রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় ট্রাফিক কর্মকর্তা (ডিটিও), চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট (সিওপিএস), বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (ডিসিও), চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার (সিসিএম), আরএনবি পরিদর্শক, আরএনবি চিফ কমান্ডেট, বিভাগীয় মহাব্যবস্থাপক (ডিআরএম) ও পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) পর্যন্ত।
তবে স্টেশন মাস্টার জয়নালের কপালে যা জুটে তাতে তিনি মহা আরাম আয়েশে দিনযাপন করছেন। এভাবে গত কয়েক বছরে তিনি চট্টগ্রামে গড়ে তুলেছেন একাধিক বহুতল ভবন। কিনেছেন বহু প্লট, ফ্ল্যাট। একাধিক ব্যাংকের হিসাবে গচ্ছিত রেখেছেন কোটি কোটি টাকা।
রেলওয়ের সংশ্লিষ্টরা জানান, ষোলশহর রেলওয়ে স্টেশনের অঘোষিত জমিদার জয়নালের বাড়ি চট্টগ্রামের কোতায়ালী থানা এলাকায়। ষোলশহর স্টেশন থেকে যার দূরত্ব মাত্র ৩ থেকে সাড়ে তিন কিলোমটার। এ সুবাধে তিনি বাড়ি থেকে ইচ্ছেমতো ষোলশহর স্টেশনে আসেন, আবার ইচ্ছেমতো চলে যান। অনেক সময় নির্ধারিত ডিউটির সময় তিনি স্টেশনে থাকেন না, আবার কোন কোন সময় ডিউটি না থাকলেও স্টেশনে ঘুরে ঘুরে ধান্ধা করেন তিনি।
এসব অনিয়ম দূর্নীতি চাপা দিতে তিনি চট্টগ্রামের কতিপয় অনলাইন ও নাম সর্বস্ব আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার কতিপয় সাংবাদিকও পোষেন। পোষেন যখন যে দল ক্ষমতায় থাকেন, সে দলের দুস্কৃতিকারী কিছু নেতাকর্মীও। যাদের ভয়ে মুখ খোলার সাহস করেন না ব্যবসায়ীরা।
সম্প্রতি এসব অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে। মুঠোফোনে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে স্টেশন মাস্টার জয়নাল বলেন, ভাড়া বাণিজ্য ও তেল চুরি নিয়ে আমার বিরুদ্ধে তোলা সব অভিযোগ মিথ্যা। আমি কারও কাছ থেকে কোন টাকা নিই না। ভাড়া হিসেবে টাকা দেওয়ার বিষয়ে দোকানদার ও ব্যবসায়ীদের বক্তব্যের ভিডিও রয়েছে-এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, টাকা নেয় ঠিক আছে, কিন্তু আমি নিই না। যারা নেই তাদের বিরুদ্ধে আপনি রিপোর্ট করেন, আমার কোন আপত্তি নেই। তেল চুরির সাথেও আমি জড়িত নই।
এক পর্যায়ে তিনি বলেন, চট্টগ্রামে বহু সাংবাদিকের সাথে আমার সম্পর্ক রয়েছে। আমি আপনাকেও চিনি। কিন্তু কোন সময় তো আসেননি। এখন আপনি আমার অফিসে একটু আসুন। বসে কথা বলব। শেষে অফিসে গেলে সাক্ষাতের শুরুতে তিনি বলেন, সাংবাদিক মাহবুবকে চিনেন নাকি? এ কথা বলে তিনি ফোনে কল দিয়ে মাহবুবের সাথে কথা বলতে বলেন। কোন মাহবুব প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, কথা বলেন না, কথা বলেন।
চেনা নেই, জানা নেই কোন মাহবুবের সাথে, কেন কথা বলব জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওনার নাম্বারটা নেন। তাহলে বুঝতে পারবেন, কোন মাহবুব। ওনার সাথে আমার খুব ভাল সম্পর্ক। চট্টগ্রামে এ রকম অনেক সাংবাদিক রয়েছে, যারা মাসে মাসে দেখা করেন। আপনাদের সাথেও সম্পর্ক থাকবে আর কি!!!
আপনার কি আর কিছু বলার আছে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে কেউ ষড়যন্ত্র করছে। আপনাদের মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছে। এই কথা বলার জন্য আমি আসতে বলেছি। এক পর্যায়ে তিনি স্টেশনের আরএনবি ইনচার্জ ও সহকারি স্টেশন মাস্টার ও বিভাগীয় ডিটিও‘র সাথে কথা বলার অনুরোধ করেন। এদের সাথে কথা বলার কারণ জানতে চাইলে তিনি হতাশ হয়ে অফিস কক্ষ ত্যাগ করেন।
এ বিষয়ে জানতে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ডিটিও আনিসুল ইসলামের মুঠোফোনে একাধিবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। বুধবার (৮ জানুয়ারি) দুপুরে অফিসে গেলেও দেখা যায় দরজার বাইরে সিটকারি লাগানো। এ সময় অফিসের পিয়ন স্বপন বলেন, স্যার অফিসে খুব কম থাকেন। দিনের বেশিরভাগ তিনি স্টেশনে স্টেশনে ঘুরেন।
একাধিকবার ফোন করার পরও ফোন ধরেননি চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট (সিওপিএস) শহিদুল ইসলামও। বুধবার অফিসে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। একই অবস্থা রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার মাহবুবুল আলমেরও। একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। বুধবার বিকেলে অফিসে গিয়ে দেখা যায়, তিনি দরজা বন্ধ করে কতিপয় ঠিকাদার-সাপ্লাইয়ারের সাথে গোপন আলাপ করছেন।
তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার (এসিসিএম) শওকত জামিল মহসি বলেন, আমি তো এসেছি নতুন। এ বিষয়ে কোন অভিযোগ আমি পাইনি। তবে স্টেশনে ট্রাফিক বা জমি দখলের বিষয়টি দেখার দায়িত্ব আমাদের নয়। শুধুমাত্র টিকেট বিক্রির বিষয়টি দেখার দায়িত্ব আমাদের। আপনাদের থেকে যখন জানলাম, তখন টিকেট বাণিজ্যের বিষয়টি আমি দেখব। অনিয়ম হলে অবশ্যই স্টেশন মাস্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।
এ বিষয়ে জানতে বুধবার দুপুরে অফিসে গিয়েও রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) সুবুক্তগীনকে পাওয়া যায়নি। পরে মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
ঈশান/খম/বেবি