
“এর মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগরীর ভেলুয়ার দিঘী, আগ্রাবাদ ডেবা লিজ দেওয়ার নামে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এই দিঘী দুটি ইজিপির টেন্ডারের মাধ্যমে প্রায় কোটি টাকায় লিজ দেওয়া হলেও অগোচরে লেনদেন হয়েছে সমপরিমাণ টাকা। ফলে লিজ গ্রহীতা লিজের শর্ত ভেঙে ওই দিঘীর পাড়ে পাকা ভবন তৈরী করে নিজস্ব অফিস ও দোকান পাট খুলে দিলেও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এ বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হলেও নিরবতা পালন করছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।”
চট্টগ্রামের তিনভাগের একভাগ জমি বন্দরের। আরেকভাগ জমি রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের। বাকি জমি বনবিভাগসহ সরকারি বিভিন্ন বিভাগের। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের জমির পরিমান প্রায় ২৪ হাজার ৪৪১ একর। যার সিংহভাগই এখন রেল বহিঃর্ভুত কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। যার পরিমাণ ১৪ হাজার একরেরও বেশি। এছাড়া পুরো অবৈধ দখলে রয়েছে ৬১৯.৬৭ একর। তবে লিজ আর অবৈধ দখল দুটো কাজেই টাকা হাতাচ্ছে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ভুসম্পত্তি বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এর মধ্যে রয়েছেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক (জিএম) নাজমুল হোসাইন, চিফ এস্টেট সুজন চৌধুরী, বিভাগীয় রেলওয়ে মহাব্যবস্থাপক (জিএম) সাইফুল ইসলাম, বিভাগীয় ভুসম্পত্তি কর্মকর্তা ও সেতু প্রকৌশলী জিষাণ দত্ত, বড়বাবু আমিনুল ইসলাম জুয়েল ও আবদুল বারেক অন্যতম। যারা লিজ, লাইসেন্স নবায়ন, ফাইল ফুট আপসহ বিভিন্ন জালিয়াতি ও কারসাজি করে প্রতিনিয়ত মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। এভাবে কয়েক বছরে তারা এখন কোটিপতি। এমন অভিযোগ ভুক্তভোগি জনসাধারণের।
স্থানীয়রা জানান, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিপুল পরিমাণ ভুমি রক্ষার তত্ত্ববধান করা হয় চট্টগ্রামের পাহাড়তলি বিভাগীয় ভুসম্পত্তি বিভাগ ও সিআরবি কার্যালয়ের এস্টেট ডিপার্টমেন্ট। কিন্তু এই দুই অফিসে কর্মরত রক্ষকরাই বেচে খাচ্ছেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের জমি।
সিআরবি এস্টেট বিভাগের তথ্যমতে, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ২৪ হাজার ৪৪১ একর জমির মধ্যে অপারেশনাল কাজে ব্যবহার হচ্ছে ১০৩৩১.৩১ একর জমি। অপারেশনাল কাজে ভাড়া দেওয়া হয়েছে ৯৪০০.৯৬২ একর জমি। রেল বহি:র্ভুত কাজে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬০৪.৮০ একর জমি। এছাড়া সম্পূর্ণ বেদখলে রয়েছে ৬১৯.৬৭ একর জমি। এছাড়া গত ২২-২৩ অর্থবছরে লিজ দেওয়া হয়েছে ২৯.৯১ একর জমি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে রেলওয়ে জমির হালনাগাদ তথ্য এটি।
আর এসব জমি লিজ দিতে গিয়ে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন জিএম, চিফ এস্টেট, কানুনগো, আইন কর্মকর্তা, বড়বাবুসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারি। গত ২২-২৩ অর্থবছর থেকে এ পর্যন্ত জমি লিজ, লিজ সংক্রান্ত লাইসেন্স নবায়ন, এতদসংক্রান্ত ফাইল ফুট আপের নামে এসব কর্মকর্তারা কোটি কোাট টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
এর মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগরীর ভেলুয়ার দিঘী, আগ্রাবাদ ডেবা লিজ দেওয়ার নামে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এই দিঘী দুটি ইজিপির টেন্ডারের মাধ্যমে প্রায় কোটি টাকায় লিজ দেওয়া হলেও অগোচরে লেনদেন হয়েছে সমপরিমাণ টাকা। ফলে লিজ গ্রহীতা লিজের শর্ত ভেঙে ওই দিঘীর পাড়ে পাকা ভবন তৈরী করে নিজস্ব অফিস ও দোকান পাট খুলে দিলেও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এ বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হলেও নিরবতা পালন করছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
একইভাবে নগরীর পাহাড়তলী রেলওয়ে বাজারের একটি বাণিজ্যিক প্লটের লাইসেন্স নবায়নে ভয়াবহ জালিয়াতির মাধ্যমে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটিয়েছে বিভাগীয় রেলওয়ে ভুসম্পত্তি বিভাগের কর্মকর্তা মাহবুবল করিম। এ কাজে মুখ্য ভুমিকা রাখেন রেলওয়ে বিভাগীয় মহাব্যবস্থাপক। আর এ কাজের রসদ যোগানদাতা ছিলেন বড়বাবু আমিনুল ইসলাম জুয়েল। তবে আমিনুল ইসলাম জুয়েল ছাড়া বড় দুই কর্মকর্তা সম্প্রতি অন্যত্র বদলি হয়েছেন।

ঘটনাটির অনুসন্ধানে জানা যায়, বিভাগীয় ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা মাহবুবল করিম বদলি হওয়ার আগে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যক্তির অজান্তে একটি দোকানের নামজারি করে দেন এক উপ-ভাড়াটিয়ার নামে। এর সঙ্গে জড়িত রেলওয়ের এক শ্রমিক লীগ নেতা। ঘটনা ধামাচাপা দিতে একাধিকবার শুনানি অনুষ্ঠিত হলেও এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি এখনো। গত ৬ মাস ধরে যার খেসারত দিতে হচ্ছে প্রকৃত ইজারাদারকে। এ নিয়ে রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে।
সূত্র জানায়, পাহাড়তলী বাজারের ডি/১৭০ নম্বর বাণিজ্যিক প্লটের প্রকৃত ইজারাদার মো. আবুল বশর। ১৯৯২ সালে তিনি রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের কাছ থেকে লাইসেন্স গ্রহণ করেন। ২০০ বর্গফুট দোকানের নিয়মিত খাজনাও পরিশোধ করে আসছেন তিনি। শারীরিক অক্ষমতার কারণে সম্প্রতি দোকানটি হস্তান্তর করেন সুমন চন্দ্র নাথ নামে এক ব্যক্তির কাছে। নিয়ম মেনে নামজারি করার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদনও করা হয়। তবে অদৃশ্য কারণে ইজারাদারের আবেদন আমলে না নিয়ে নামজারি করা হয় উপ-ভাড়াটিয়া মো. নজরুল ইসলামের নামে। বর্তমানে সেই উপ-ভাড়াটিয়া দোকানের মালিক দাবি করছেন।
এছাড়া ব্যবসায়ী নামধারী একটি শক্তিশালী ভূমিদস্যুর নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ভুমি ও বাণিজ্যিক ইজারা কার্যক্রম। অভিযোগ রয়েছে, এই সিন্ডিকেটকে পর্দার আড়ালে রেখে যাবতীয় সুযোগ সুবিধা দিয়ে মাফিয়া স্টাইলে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের কৌশলগুলো প্রয়োগের ক্ষেত্র তৈরি করে দেয় পূর্বাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা অসাধু কর্মকর্তারা।
এভাবে চট্টগ্রাম নতুন রেল স্টেশনে ১ হাজার গাড়ি ধারণক্ষমতার পার্কিংও ইজারা নিয়ে ৬ বছর ধরে দখল। যেখানে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল মার্কেট। চট্টগ্রাম নতুন ও পুরাতন স্টেশনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় গড়ে তোলা হয়েছে গেস্টহাউজ। হালিশহরে অবস্থিত বাংলাদেশ রেলওয়ে ট্রেনিং একাডেমীতে দখলে রয়েছে প্রায় ২৬ একর জলাশয়। সিআরবি হেরিটেজ এলাকার সাত রাস্তার মোড়ে ৫২২৫ বর্গফুট জমি লিজ নিয়ে ১০ হাজার বর্গফুট দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে তাসফিয়া গার্ডেন নামে একটি রেস্টুরেন্ট। এছাড়া কালুরঘাট সেতু, কালুরঘাটের মুড়িংঘাট, পটিয়ার ধলঘাট, দোহাজারী, ষোলশহর, জানাআলী স্টেশন, সীতাকুন্ড, ভাটিয়ারী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চাঁদপুরের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক জায়গাসমূহ দখলে রেখেছে রেলের ভুমিদস্যু খ্যাত শাহ আলম সিন্ডিকেট।
সৃত্র জানায়, গত ৬-৭ বছর আগে এসব জমি ও বাণিজ্যিক ইজারার মেয়াদ শেষ হলেও বার বার ইজারার মেয়াদ বাড়ানোর পর উচ্চ আদালতে মামলা দায়ের করে টেন্ডার কার্যক্রম পরিচালনায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে শাহ আলম সিন্ডিকেট। আদালতে মামলা নি®পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এই মাফিয়া ইজারাদার সিন্ডিকেট লুটেপুটে খাচ্ছে রেলের এই ভুসম্পত্তি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সাবেক একজন কর্মকর্তা বলেন, যারা টেন্ডার কার্যক্রম পরিচালনা করেন তাঁরাই দেখিয়ে দেন আদালতের স্থগিত আদেশ নিয়ে আসার যাবতীয় বিষয়। তাহলে কীভাবে টেন্ডার কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়, কর্মকর্তা আর ইজারাদার আলাদা ব্যক্তি হলেও অংশীদারত্বের ভিত্তিতে সবাই সমান সুযোগ সুবিধায় মত্ত।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, নামজারী জালিয়াতি, লাইসেন্স নবায়নসহ নানা কারসাজি করে লিজের নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন রেলওয়ের ভুসম্পত্তি বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আবার এ নিয়ে ক্ষুব্দ ভুসম্পত্তি বিভাগের কতিপয় কর্মচারী। কারণ তারা অবৈধ অর্থের ভাগ থেকে বঞ্চিত। এ বিষয়ে বিভাগীয় ভুসম্পত্তি বিভাগের এক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রেলের বিভাগীয় ভুসম্পত্তির জমিদার হচ্ছে বড়বাবু জুয়েল। বড় স্যারকে নিয়ে সে সব লুটেপুটে খাচ্ছে। আমরা তো কানাকড়িও পায় না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিভাগীয় ভুসম্পত্তি বিভাগের বড়বাবু আমিনুল ইসলাম জুয়েল বলেন, আপনাকে কে বলেছে এসব কথা। নাম বলেন, তাকে আমি দেখে ছাড়ব। এদিকে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় ভূ-স¤পত্তি কর্মকর্তা হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্বে রয়েছেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সেতু প্রকৌশলী জীষান দত্ত। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রেলের জমি নিয়ে কিছু জটিলতা রয়েছে। পাহাড়তলী বাজারেও একটি বাণিজ্যিক প্লটের নামজারি নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর বেশি কিছু বলা যাচ্ছে না।
জানতে চাইলে প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা সুজন চৌধুরী বলেন, রেলওয়ের অসংখ্য জমি বেদখলে রয়েছে। যা আমি আসার পর থেকে উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। এরমধ্যে অনেকগুলো জমি উদ্ধার করে নতুন করে লিজ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে নগরীর ভেলুয়ার দিঘী, আগ্রাবাদ দিঘীও রয়েছে। গত ২২-২৩ অর্থবছরে জমি লিজ থেকে ৪৪ কোটি ৫৩ লাখ ৭৭ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা সরকারের রাজস্ব জমা হয়েছে।
লিজের সমপরিমাণ টাকা অগোচরে ভুসম্পত্তি বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পকেটে ঢুকার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এ অভিযোগ মোটেও সত্য নয়। এ বিষয়ে কে কি বলছে, তাতে আমার কিছুই যায় আসে না।
এ বিষয়ে জানতে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ও চিফ কমার্শিয়াল অফিসারের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। ফলে তার বক্তব্য উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি।
ঈশান/মখ/সুপ