রেলের উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্পে গত ১০ বছরে খরচ করা হয়েছে প্রায় ৭২ হাজার কোটি টাকা। নতুন রেলপথ নির্মাণের পাশাপাশি কেনা হয়েছে নতুন বগি ও ইঞ্জিন। কিন্তু বিনিয়োগ বাড়লেও সেবার মান যেমন বাড়েনি তেমনই কমানো যায়নি পরিচালন ব্যয়।
এ কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত এই সংস্থায় ভারী হয়েছে লোকসানের পাল্লা। গত দুই বছরে রেলের লোকসান দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। আর ১৩ বছরে ট্রেন চালিয়ে গচ্চা দিতে হয়েছে ১৬ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা।
যোগাযোগ ও পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনার কারণে পরিচালন ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি লোকসানও বাড়ছে। বিপুল বিনিয়োগের পরও ট্রেনের গতি তো বাড়েইনি, উল্টো কমেছে অনেক রুটে। সিডিউল বিপর্যয় আর টিকেট সংকটের ভোগান্তি নিয়েই চলছেন যাত্রীরা। অনিয়ম বন্ধ ও সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করা না গেলে রেলওয়ের লোকসান কমানো সম্ভব হবে না বলে মন্তব্য করেছেন তারা।
তুলনামূলক নিরাপদ ও আরামদায়ক ভ্রমণের জন্য দেশের বেশিরভাগ মানুষের প্রথম পছন্দ রেল। তবে প্রতিষ্ঠানের মানোন্নয়নে কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার অভাব আছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। সেবার মান ও রাজস্ব আয় না বাড়লেও বছর বছর বেড়েই চলেছে সংস্থাটির পরিচালন ব্যয়, যার বেশিরভাগই খরচ হয় এর কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতনের পেছনেই। আয়ের চেয়ে দ্বিগুণ ব্যয়ের কারণে ভারী হচ্ছে লোকসানের পাল্লা।
২০২১-২২ অর্থবছরে লোকসানের রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। বিনিয়োগ হওয়া অর্থ ফেরত তো দূরের কথা, ট্রেন পরিচালনার খরচের অর্ধেকও তুলতে পারেনি সংস্থাটি। ২০২১-২২ অর্থবছরে রেলে সরকারের খরচ হয় ১৬ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে রয়েছে রেলপথ নির্মাণ ও বগি-ইঞ্জিন কেনায় বিনিয়োগ ১২ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। আর ট্রেন পরিচালন ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৭৬২ কোটি। বিপরীতে আয় ১ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। রেকর্ড ২ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা পরিচালন লোকসান হয়েছে। এর আগের বছর ২০২০-২১ অর্থবছরে রেলের পরিচালন লোকসান হয়েছে ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। লোকসানের পাশাপাশি কমেছে রেলওয়ের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাও। ২৫ বছর আগে যেখানে ১ টাকা আয় করতে গিয়ে ৯৬ পয়সা ব্যয় করতে হতো সেখানে বর্তমানে ১ টাকা আয় করতে গিয়ে রেলওয়ের ব্যয় হয় ২ টাকা ৭৮ পয়সা। অর্থাৎ আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়েছে কয়েকগুণ। অথচ পঁচিশ বছর আগেও বাংলাদেশ রেলওয়ে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন করা আয় দিয়ে ট্রেন পরিচালনার সব ব্যয় মেটানোর পরও কিছু টাকা উদ্বৃত্ত থাকত। ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছর রেলের পরিচালন উদ্বৃত্ত ছিল প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা। আর বর্তমানে উদ্বৃত্ত তো দূরের কথা লোকসান ছাড়িয়েছে ২ হাজার কোটি টাকা।
রেলের কর্মকর্তারা জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০০৯ সাল থেকে বিগত ১৩টি বাজেটে রেলওয়ের জন্য ১ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে উন্নয়ন প্রকল্পে খরচ হয়েছে ৭২ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৩০ হাজার ২৮০ কোটি টাকা পরিচালন ব্যয়ের বিপরীতে আয় হয়েছে মাত্র ১৩ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা। তাই ট্রেন পরিচালনায় ১৩ বছরে রেলের গচ্চা গেছে ১৬ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে রেলের পরিচালন লোকসান দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রেলের ১ হাজার ৩৪ কোটি টাকা আয়ের বিপরীতে পরিচালনার জন্য ব্যয় হয়েছিল ২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ ওই বছর পরিচালন লোকসানই হয়েছিল ১ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। আর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মোট আয় হয়েছিল ৯৫৬ কোটি টাকা। ব্যয় হয়েছিল ১ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ লোকসান ছিল ৯২২ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রেলের আয় হয়েছিল ৯৩১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। ব্যয় হয়েছিল ১ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। লোকসান ছিল ৮০৩ কোটি টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে আয় ছিল ৮০৪ কোটি টাকা। ব্যয় হয়েছিল ১ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা। লোকসান হয়েছিল ৮৮১ কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে আয় হয়েছিল ৬২৯ কোটি টাকা। ব্যয় হয়েছিল ১ হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা। লোকসান হয়েছিল ১ হাজার ৫০ কোটি টাকা। ওই অর্থবছরেই রেলের লোকসান হাজার কোটি টাকা ছাড়ায় বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। তার আগে ২০১০-১১ অর্থবছরে লোকসান ছিল ৯৫৮ কোটি টাকা।
অথচ লোকসান কমাতে ২০১২ সালের ১ অক্টোবর থেকে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের ভাড়া ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে কার্যকর করা হয়েছিল। এরপর অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল চালু হলে আয়-ব্যয়ের ব্যবধান বেড়ে যাবে এ যুক্তি দেখিয়ে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে রেলের ভাড়া আরেক দফায় ৭ থেকে ৯ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। তবে ভাড়া বাড়ানোয় আয় কিছুটা বাড়লেও শেষ পর্যন্ত লোকসান কমেনি। গত অর্থবছরে যা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়।
লাগাতার লোকসান হলেও বিগত পাঁচ বছরে রেলের উন্নয়নে খরচ আরও বেড়েছে। এই সময়ে খরচ হয়েছে ৭৯ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা। আর উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৬১ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। বাকি ১৮ হাজার ৬৬ কোটি টাকা রেল পরিচালনায় খরচ করে। এর বিপরীতে আয় হয়েছে ৬ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিত উন্নয়নের খেসারত দিচ্ছে রেল। অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলেই প্রতি বছর ভারী হচ্ছে রেলের লোকসানের পাল্লা। এর হাত থেকে রেহাই পেতে দরকার সুষম উন্নয়ন পরিকল্পনা। রেলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দেশের ৬০ শতাংশ রেললাইন ঝুঁকিপূর্ণ এবং ৭০ শতাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন দিয়ে রেল চলছে। ৩০-৪০ বছর আগের ইঞ্জিন দিয়েও ট্রেন চালানো হয়। ইঞ্জিন পুরোনো হওয়ার কারণে কোনো কোনো রুটে ট্রেনের গতি কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। এ ছাড়া পরিস্থিতি অনুযায়ী কোথাও গতিসীমা ৩০ আবার কোথাও ১০ কিলোমিটার করে চালাতে হয়।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, বিগত এক যুগে রেলে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ হলেও মানোন্নয়নে সেভাবে ভূমিকা রাখতে পারেনি সংস্থাটি। সমন্বয়ের অভাবে কোন কাজটি আগে করতে হবে আর কোনটি পরে করতে হবে তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা হয়নি। পণ্য পরিবহন বাড়ানোর পাশাপাশি সুষ্ঠু সম্পদ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আয় বাড়ানো প্রয়োজন ছিল। একই সঙ্গে ট্রেনের গতি বাড়ানোর পাশাপাশি যাত্রী সেবার মানোন্নয়ন করা উচিত ছিল। কিন্তু রেল এটা করতে পারেনি। উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে এসব বিষয়কে প্রাধান্য না দেওয়ার কারণে লোকসানের পরিমাণ বাড়তে থাকবে। এ জন্য শুধু রেল দায়ী নয়, পরিকল্পনা কমিশনেরও দায় রয়েছে।
নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির (এনসিপিএসআরআর) সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, যাত্রী সেবার মান বাড়ানোর দিকে নজর না দিয়ে কর্তৃপক্ষ লোভনীয় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যস্ত হওয়ায় কাক্সিক্ষত সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। তা ছাড়া বিনিয়োগের প্রাধিকারের বিষয়টিও রেল ঠিকমতো দিতে পারেনি। কোনটি আগে করতে হবে আর কোনটি পরে করলে হবে তা নিয়ে তারা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। ফলে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প হলেও পুরোপুরি সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। তবে ঋণের বোঝা ঠিকই জনগণকে নিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, অনিয়ম বন্ধ ও সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করা না গেলে রেলওয়ের লোকসান কমানো সম্ভব হবে না।
তিনি বলেন, ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় নিয়মিত বিষয়। ট্রেনের গতিও কম। ট্রেন ছাড়ার পর শুরু হয় ভোগান্তির আরেক অধ্যায়। তা হলো হকারদের যন্ত্রণা। এসি থাকলেও তার সুবিধা ভোগ করতে পারেন না যাত্রীরা। গরমে তাদের বেহাল দশা। অথচ টিকেটের সঙ্গে ঠিকই নেওয়া হয় এসির চার্জ। তাই সেবার মান বাড়ানোর পাশাপাশি দুর্নীতি ও অপচয় বন্ধ করতে পারলেই লোকসান থেকে রেহাই পেতে পারে রেল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রেলের উন্নয়নে ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নিয়ে তা বাস্তবায়ন করেছে। এখনও অনেক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। তবে রেলের এই বিপুল বিনিয়োগের সুফল দ্রুত পাওয়া সম্ভব নয়। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। সুফল পাওয়া সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তারপরও বিগত এক যুগ আগের তুলনায় বর্তমানে রেলের সেবার মান বাড়ার পাশাপাশি আধুনিকায়ন হয়েছে। ট্রেন চলাচলের সময়সূচিতে উন্নতি হয়েছে। আধুনিক ইঞ্জিন-কোচ সংযোজন করা হয়েছে ও হচ্ছে। পুরোনো রেলপথ সংস্কার ও নতুন রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। যমুনা নদীতে রেলের জন্য পৃথক সেতু তৈরি হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ রেলপথগুলো ডাবল লাইনে উন্নীত করা হচ্ছে। ঢাকা-কক্সবাজার রেলপথের উদ্বোধন ও পদ্মা সেতু দিয়ে রেল চালু করা হয়েছে। এ ছাড়া চলমান প্রকল্পগুলো শেষ হলে রেলের সেবা বাড়ার পাশাপাশি লোকসানও কমে আসবে বলে মনে করেন রেলপথ মন্ত্রী।
ঈশান/খম/সুপ