বৃহস্পতিবার- ২৭ মার্চ, ২০২৫

শাহ আমানত সেতুর টোল আদায়ে কারচুপি, কমেছে কোটি টাকা রাজস্ব

শাহ আমানত সেতুর টোল আদায়ে কারচুপি, কমেছে কোটি টাকা রাজস্ব
print news

ট্টগ্রামের কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতুতে টোল আদায়ে কারচুপির অভিযোগ উঠেছে। কম্পিটারাইজড টোকেনে টোল আদায়ের কথা থাকলেও এখানে টোকেন না দিয়েই টাকা আদায় করা হচ্ছে। এতে তিন মাসের ব্যবধানে কমে গেছে কোটি টাকা সরকারি রাজস্ব আদায়। এতে জড়িত চট্টগ্রাম সড়ক ও জনপথ বিভাগের কর্মকর্তারাও।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চট্টগ্রামের কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতুতে টোল আদায়ে কারচুপির বিষয়টি সাধারণ মানুষের চোখে পড়ে। একাধিক যানবাহনের মালিক, চালক ও যাত্রীরা সম্প্রতি বিষয়টি জানিয়েছেন।

তারা বলেছেন, তাদের গাড়ি থেকে টোল আদায় করা হলেও কোনো টোকেন দেওয়া হচ্ছে না। ৫ আগস্ট থেকে এ অনিয়ম শুরু করেছে টোল আদায়কারী ভারতীয় জয়েন্ট ভ্যানচার প্রতিষ্ঠান ‘সেল ভ্যান জেভি’।

আরিফুর রহমান নামে একজন চাকরিজীবীর ভাষ্য, গত ২৯ আগস্ট পটিয়া থেকে আসার সময় তিনি দেখতে পান টোলপ্লাজার কর্মীরা টোকেন ছাড়াই টাকা নিয়ে মাইক্রোবাসকে যেতে দিচ্ছেন। তিনি ওই মাইক্রোবাসের যাত্রী ছিলেন। তার গাড়ির পেছনে থাকা আরও গাড়ির ক্ষেত্রেও তিনি একই অবস্থা দেখতে পান। কোনো গাড়িকেই টোলপ্লাজা থেকে টোকেন দিতে দেখা যায়নি।

পণ্যবাহী ট্রেলার চালক মহিউদ্দিন সোহেলের ভাষ্য, ‘টোকেন নিলে টোলপ্লাজায় একটি ট্রেলারকে ৭৫০ টাকা দিতে হয়। আর টোকেন ছাড়া কয়েকশ টাকা কম দিলেও হয়।’

বাঁশখালীর এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টে কাজ করা ইঞ্জিনিয়ার আবু সাঈদ বলেন, শাহ আমানত সেতু দিয়ে মাইক্রোবাসে করে কিছুদিন যাওয়া-আসা করতে হয়েছে। কিন্তু আগস্ট মাসের শেষদিকে কয়েকবার আসা-যাওয়ার সময় লক্ষ্য করলাম, টোলপ্লাজা থেকে কোনো টোকেন দেওয়া হচ্ছে না। টোকেন না দিলে তো টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হয় না।’

চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সদস্যসচিব মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, ‘ওই সেতু দিয়ে যাতায়াতকারী অনেক গাড়ির টোল আদায় করে টোকেন দেওয়া হয় না। এভাবে টোকেন না দিলে তো আদায়কারী প্রতিষ্ঠান টাকাগুলো রাজস্ব খাতে জমা না দেওয়ার সুযোগ পাবে। দেশকে নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে আনার জন্য বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে। রাজস্ব যেন সরকারি কোষাগারে সঠিকভাবে জমা হয়, এ জন্য টোল আদায়ে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।’

শাহ আমানত সেতুর টোল আদায়কারী প্রতিষ্ঠান ‘সেল ভ্যান জেভি’ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, গত ৪ এপ্রিল থেকে টোল আদায়ের দায়িত্ব পায় প্রতিষ্ঠানটি। এপ্রিল মাসে সাত লাখ ৭০ হাজার ৩৪২টি যানবাহন চলাচলের বিপরীতে পাঁচ কোটি ৮৭ লাখ ১৩ হাজার ৫৪১ টাকা টোল আদায় হয়েছে। মে মাসে সাত লাখ ৬০ হাজার ৩৭০টি যানবাহন চলাচল করেছে। টোল আদায় হয়েছে ছয় কোটি ৪৩ লাখ ২১ হাজার ২৭৬ টাকা। জুন মাসে সাত লাখ ৮৪ হাজার ৮৭৪টি যানবাহন থেকে টোল এসেছে ছয় কোটি ৫৮ লাখ ৫৭ হাজার ৪০৮ টাকা।

আর জুলাই মাসে ছয় লাখ ৪৭ হাজার ৩৯০টি যানবাহন থেকে রাজস্ব এসেছে পাঁচ কোটি ৭৮ লাখ ২০ হাজার ৪৯৮ টাকা। কিন্তু আগস্ট মাসে শাহ আমানত সেতু থেকে টোল আদায় হয়েছে পাঁচ কোটি ৪০ লাখ ৫৮ হাজার ২৯৬ টাকা। কিন্তু কী পরিমাণ গাড়ি চলাচল করেছে, সেই তথ্য দিতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। জুলাই মাস থেকে আগস্ট মাসে ২৭ লাখ ৬২ হাজার ২০২ টাকা কম আদায় হয়েছে। আবার জুন মাস থেকে আগস্টে এক কোটি ১৭ লাখ ৯৯ হাজার ১১২ টাকা কম আদায় হয়েছে।

শাহ আমানত সেতুর টোল আদায়ের হার হচ্ছে ট্রেলার ৭৫০ টাকা, বড় ট্রাক (সাড়ে সাত টন) ৩০০ টাকা, মাঝারি ট্রাক ২০০ টাকা, মিনি ট্রাক ১৩০ টাকা, বড় বাস ১৫৫ টাকা, মিনি বাস ৫০ টাকা, মাইক্রোবাস ১০০, প্রাইভেট কার ৫০ টাকা, তিন চাকার গাড়ি সিএনজি টেম্পো ৩০ টাকা, মোটরসাইকেল রিকশাভ্যান ১০ টাকা, কৃষিকাজের যানবাহন ১৩৫ টাকা।

সূত্রমতে, গত ১ এপ্রিল থেকে দুই বছরের জন্য চট্টগ্রামের কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতুর টোল আদায়ের দায়িত্ব পায় ‘সেল ভ্যান জেভি’। তারা দেশের আরও কয়েকটি সেতুর টোল আদায় করছে বলে জানা গেছে।

চুক্তি অনুযায়ী তারা টোল আদায়ের জন্য সরকারের কাছ থেকে অর্থ পায়, যা দিয়ে তাদের জনবলের বেতন-ভাতা দেওয়া হয়। তবে এখানে রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। টোল আদায়কারী প্রতিষ্ঠান তাদের জনবলের বেতন এবং অন্যান্য খরচের যে বিল দিচ্ছে, সেতু কর্তৃপক্ষ সেই বিল পরিশোধ করছে। এতে বিল আদায়কারী প্রতিষ্ঠান বিল তোলার সময় অনিয়ম করার সুযোগ পাচ্ছে। অন্যদিকে গাড়ির টোল আদায়ের সময় রসিদ না দেওয়ায় উত্তোলনকারীরা সেই টাকা নিজের পকেটে ভরছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এক সময় কমিশনের ভিত্তিতে এই সেতুতে টোল আদায় হতো। অর্থাৎ প্রতিমাসে যে পরিমাণ টোল আদায় হতো, তার থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিশন আদায়ের কাজে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান পেত। সম্প্রতি এই নিয়ম পরিবর্তন করে বার্ষিক চুক্তির ভিত্তিতে টোল আদায়ে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়া হয়।

শাহ আমানত সেতুর টোল আদায়কারী ‘সেল ভ্যান জেভ’র প্রজেক্ট ম্যানেজার সুমন ঘোষ বলেন, ‘টোকেন না দিয়ে টাকা আদায় করার অভিযোগটি সঠিক নয়। কিন্তু অনেক গাড়ি টোকেন না নিয়ে টাকা দিয়ে চলে যায় এটা সত্য। আমরা এখন থেকে টোকেন না নিয়ে কোনো যানবাহনের মালিক, চালককে যেতে দেব না।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. নিজাম উদ্দিন প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে সাফাই গাইতে শুরু করেন। তিনি বলেন, এখানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমরা জানতে পারছি কি পরিমাণ গাড়ি পাস হচ্ছে। সব গাড়ি থেকে টাকা আদায় হচ্ছে কি না, সেটিও দেখার সুযোগ রয়েছে। দৈনিক যে পরিমাণ টোল আদায় করবে, পরদিন সেই পরিমাণ টাকা ভাউচারের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে। সেই কাজ টোল আদায়কারী প্রতিষ্ঠান করে। আমরা এখান থেকে তা তদারকি করি। সুতরাং কারচুপি করার কোন সুযোগ নেই।

ঈশান/খম/সুম

আরও পড়ুন

No more posts to show

You cannot copy content of this page