শুক্রবার- ১৪ মার্চ, ২০২৫

সমুদ্রসীমার গ্রে এরিয়ার বিরোধ নিষ্পত্তিও জাতিসংঘে

print news

সমুদ্রে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমানার মধ্যবর্তী গ্রে এরিয়া নিয়ে বিদ্যমান মতবিরোধ শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘেই নিষ্পত্তি হচ্ছে। জাতিসংঘের সমুদ্রসীমা বিষয়ক কার্যালয়ে এ বিরোধ নিষ্পত্তি করতে শুনানির তালিকায় ৫৪ নম্বরে রয়েছে। এখন ৪৫ নম্বরের শুনানি চলছে। আশা করা হচ্ছে, দ্রুতই বাংলাদেশের বিষয়টি শুনানি হবে এবং নিষ্পত্তি ঘটবে।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সমুদ্রসীমার গ্রে এরিয়া নিয়ে বাংলাদেশ-ভারতের মতবিরোধ রয়েছে। দুই পক্ষ নিজেদের মধ্যে এ বিরোধ নিষ্পত্তি করতে একমত হয়েছিল, কিন্তু তা বেশিদূর এগোয়নি। এখন জাতিসংঘেই বিরোধের নিষ্পত্তি ঘটবে। গ্রে এরিয়ার মোট কত অংশ বা কোন অংশ নিয়ে এ বিরোধ সে বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

কূটনৈতিক সূত্র জানায়, ২০১৪ সালে সমুদ্রসীমা বিরোধ সংক্রান্ত হেগের স্থায়ী আদালতে (পারমান্যান্ট কোর্ট অব আর্বিট্রেশন বা পিসিএ) বাংলাদেশ-ভারত সমুদ্রসীমা বিরোধের নিষ্পত্তি ঘটে। আদালতের রায়ে বঙ্গোপসাগরের ৫০ বর্গ কিলোমিটারের (কিমি) একটি গ্রে এরিয়া উল্লেখ করা হয়। ২০১৯ সালে এ ৫০ বর্গ কিমি গ্রে এরিয়ার পূর্ণ সার্বভৌম অধিকার নয়াদিল্লির কাছে চেয়েছে ঢাকা। ওই বছরই নয়াদিল্লি সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের হায়দরাবাদ হাউসে ৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে গ্রে এরিয়ার সার্বভৌম অধিকার বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত দেন। এর আগে ২০১১ সালে গ্রে এরিয়াসহ সমুদ্রের মহীসোপান সংক্রান্ত বিষয়ে জাতিসংঘের সমুদ্রসীমা বিষয়ক কার্যালয়ে ভারতের বিপক্ষে আপত্তি দাখিল করে বাংলাদেশ।

২০১৯ সালে ভারত সফর শেষে শেখ হাসিনা এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, ঢাকা-নয়াদিল্লি আন্তরিক পরিবেশে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সমুদ্রের গ্রে এরিয়া নিয়ে দুই দেশের মধ্যে কিছু সমস্যা আছে। তবে সমস্যাটি দুই দেশ নিজেরা আলোচনা করে মিটিয়ে ফেলতে ভারত প্রস্তাব দিয়েছে। ভারতের প্রস্তাবে আমরা সম্মত হয়েছি।

প্রধানমন্ত্রী আরও জানান, গ্রে এরিয়া সমস্যাটি খুব বেশি কিছু না। ওই এরিয়ার ওপরের অংশের মালিকানা ভারতের আর নিচের অংশ বাংলাদেশের। কিন্তু আমরা উভয় অংশের পূর্ণ অধিকার চাই। ওই সময়ে প্রধানমন্ত্রীর সফরের আগে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ঢাকা সফর করেন। ঢাকা সফর শেষে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, সমুদ্রসীমা বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে থাকা আপত্তি আমরা নিজেরাই আলোচনা করে মিটিয়ে ফেলতে চাই। এ বিষয়ে দুই দেশই একমত প্রকাশ করেছি।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো আরও জানাচ্ছে, দুই পক্ষ ভালোভাবেই কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে সমুদ্র বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে এগিয়ে যাচ্ছিল। এরপর ২০২০ সালের ২২ অক্টোবর সিএলসিএস (জাতিসংঘের সদর দফতরে ২১ সদস্যের কমিশন অন দ্য লিমিটস অব দ্য কন্টিনেন্টাল শেল্ফ)-এ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের মহীসোপানের সংশোধিত তথ্য দাখিলের ৬ মাসের মধ্যে ভারত জাতিসংঘে আপত্তি জানায়। ভারতের আপত্তির পর কূটনৈতিক চ্যানেলে বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়টি থমকে যায়।

এরপর গত বছরের ২ মার্চ নিউইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন জানায়, সিএলসিএস-তে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের মহীসোপানের সংশোধিত তথ্য দাখিলের পর গত ১ মার্চ এ সংক্রান্ত হালনাগাদ তথ্য উপস্থাপন করেছে বাংলাদেশ। এ সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব ও প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল মো. খুরশেদ আলম এবং এ-সংক্রান্ত কমিটির অন্যান্য কারিগরি বিশেষজ্ঞরা।

এদিকে বাংলাদেশের মহীসোপান সীমা-সংক্রান্ত দলিলাদি ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথমবারের মতো সিএলসিএস-তে জমা দেওয়া হলেও মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত সমুদ্রসীমা বিরোধের কারণে কমিশন বাংলাদেশ দাখিল করা দলিলাদি ওই সময় পরীক্ষা করতে পারেনি। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিচারিক সংস্থার মাধ্যমে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধের সমাধান করে।

সর্বশেষ সংশোধিত ও হালনাগাদ দলিলাদি উপস্থাপনার মাধ্যমে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানে তার অধিকার রক্ষা ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত তথ্য সরবরাহ করেছে। এরপর সিএলসিএসর নিয়ম অনুযায়ী, এ উদ্দেশে গঠিত একটি সাব-কমিশন বাংলাদেশ উপস্থাপিত দলিলাদি পরীক্ষা করে বাংলাদেশের মালিকানার বিষয়ে সুপারিশ দেবে। ফলে বাংলাদেশ ওই এলাকায় প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান শুরু করতে পারবে।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানাচ্ছে, ২০১২ সালে জার্মানির হামবুর্গে অবস্থিত সমুদ্র আইন বিষয়ক আন্তর্জাতিক আদালতের (ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য ল অব সি) এক রায়ের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্র বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। অন্যদিকে ২০১৪ সালে সমুদ্রসীমা বিরোধ-সংক্রান্ত হেগের স্থায়ী আদালতে বাংলাদেশ-ভারত সমুদ্রসীমা বিরোধের নিষ্পত্তি ঘটে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ার পর বাংলাদেশ ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটারের বেশি টেরিটোরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে।

বাংলাদেশ-ভারত সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির রায় পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বঙ্গোপসাগরের ৫০ বর্গ কিলোমিটারের একটি গ্রে এরিয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালত নির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি। আদালত রায়ে বলেছেন, এ বিষয়টি দুই পক্ষ নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ঠিক করে নেবে। আন্তর্জাতিক আদালত সমতার ভিত্তিতে সমুদ্রসীমা ঠিক করায় এ গ্রে এরিয়ার সৃষ্টি হয়। আদালতের রায় অনুযায়ী, বাংলাদেশের সীমানার ৫০ বর্গ কিমি এরিয়া ভারতের মধ্যে ঢুকে গেছে বা ওভার ল্যাপিং হয়েছে। গ্রে এরিয়ার সমুদ্রের তলদেশের সম্পদের একক মালিকানা বাংলাদেশের। আর সমুদ্রের উপরিভাগের সম্পদের মালিকানা উভয় দেশের।

আরও পড়ুন

No more posts to show

You cannot copy content of this page