
শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা সাবেক সংসদ সদস্যদের হ্যারিয়ার, র্যাভ ফোর ও টিএক্স ব্রান্ডের ২৪টি গাড়ি নিলামে তুলেছে চট্টগ্রাম কাস্টমস। তবে এসব গাড়িতে মন বসছে না কারোই। বিডাররা বলছেন, গাড়ির মূল্য বেশি ধরা হয়েছে। ফলে নিলামে এসব গাড়ি ক্রয় অনেকটা চ্যালেঞ্জিং হবে।
বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে এসব কথা বলেন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের নিলাম ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ স¤পাদক মো. এয়াকুব চৌধুরী। তিনি বলেন, ২৪টি এমপিভুক্ত গাড়ি ও চায়না ডা¤প ট্রাকগুলো নতুন। এর মধ্যে মনে হচ্ছে ডা¤প ট্রাকগুলো ভ্যালু বেশি ধরা হয়েছে।
এছাড়া এমপিদের গাড়িগুলোর ভ্যালু ঠিক আছে। ঠিক থাকলে কি হবে, কাস্টমসে বিড করে ৬০ শতাংশ কভার করে ফার্স্ট (প্রথম) বিডে আমার মনে হয় না আগ্রহ তেমন থাকবে। কোনো সহৃদয়বান ব্যক্তি বিড করলে করতে পারেন। তবে আমরা যারা ৩০-৪০ বছর ধরে এ ব্যবসার সাথে জড়িত, আমরা মনে হয় এ সাহস করবো না।
তিনি আরও বলেন, আমরা নিলামে কিনে ব্যবহার করি না। বিক্রি করার বিড করি। এমপিদের গাড়িগুলো বিক্রি করার মতো কোনো কাস্টমার আমাদের কাছে এখনও আসেনি। তবে আগ্রহ আছে হ্যারিয়ার, র্যাভ ফোর ও টিএক্স গাড়িতে। এগুলো ভালো বিড হবে।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের নিলাম শাখার তথ্যমতে, এবারের নিলামে ২৪ জন সাবেক এমপির গাড়ি তোলা হয়েছে। আরও সাতজন সাবেক এমপির গাড়ি আগামী নিলামে তোলা হবে। সকল সাবেক এমপিদের গাড়ি জাপানের ২০২৪ মডেলের ল্যান্ড ক্রুজার। তবে এবারের নিলামে ওঠা জাপানের ২৬টি তৈরি ল্যান্ড ক্রুজার, পাঁচটি টয়োটা হ্যারিয়ার, দুইটি টয়োটা র্যাভ ফোর, একটি টয়োটা এস্কোয়ার ও চীনের তৈরি হেভি ডিউটি সিনো ডা¤প ট্রাক ১০টি নিলামে তোলা হয়েছে।
বিডার ছাড়াও ব্যক্তি পর্যায়ের অনেকে নিলামে তোলা গাড়িগুলো দেখতে ভিড় করছে কার শেডের সামনে। বুধবার দুপুরেও বন্দরের নিরাপত্তাকর্মীরা ক্যাটালগসহ তাদের প্রবেশ করান। এরপর আগ্রহীরা শত শত গাড়ির ভিড় থেকে গাড়ি ক্যাটালগ দেখে নিলামের গাড়িগুলো চিহ্নিত করে দেখছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, প্রবেশমুখের ডান পাশে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছে ল্যান্ড ক্রুজারগুলো। তাই আগ্রহী বিডাররা শুরুতেই যাচ্ছেন এ গাড়িগুলো দেখতে। জিরো মাইলেজে থাকা সাবেক এমপিদের গাড়ি দেখার পরেই তারা ঘুরে ঘুরে দেখছেন পুরো কার শেড।
এদের মধ্যে কাউছার নূর নামে একজন বিডার বলেন, এবারতো একদম ফ্রেশ গাড়ি নিলামে উঠেছে। এ ধরনের নিলাম বাংলাদেশে কখনও হয়নি। তাই বিডারদের আগ্রহ বেশি এই নতুন গাড়িগুলোতে। এরপরও আমি ব্যক্তিগতভাবে নিলামে বিড করার চেষ্টা করছি। বিডাররাও আমাকে সহযোগিতা করছেন। তবে গাড়ির মূল্য বেশি ধরা হয়েছে। তবে আমি মনে করি, কাস্টমস দাম একটু বেশি রাখায় বিডিং বেশি হবে।
নিলামের সংরক্ষিত মূল্য নিয়ে বিডার গোলাম কিবরিয়া খোকন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আমি বিডে অংশগ্রহণ করি। এবারের নিলামে নতুন গাড়ি থাকায় আমাদের আগ্রহটা অনেক বেশি ছিল। কারণ এখানে প্রায়ই একদম আপডেট গাড়ি। ২৩-২৪ সালের গাড়ি হওয়ায় কাস্টমস এসেসমেন্ট করার সময় একবার ভ্যাট নেয়। বিডের পরে আবার আমাদের ভ্যাট দিতে হয়। কাস্টমস এসেসম্যান্টে ভ্যাট ধরার কারণে গাড়ির ভ্যালুয়েমন বেড়ে যায়। এ উচ্চমূল্যের উপর নিলামের স্থায়ী আদেশ অনুযায়ী নিলাম দর রাখতে হয় ৬০ শতাংশের উপর। ৬০ শতাংশের উপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ১০ শতাংশ ট্যাক্স দিতে হয়। তারমানে প্রায় ৮৫ শতাংশ দাম দিয়ে গাড়িটি নিলে আমাদের পক্ষে তা বিক্রি করা সম্ভব হয় না।
বিডারদের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে কথা হয় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের নিলাম শাখার সহকারী কমিশনার মো. সাকিব হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের কাছে সাবেক সংসদ সদস্যদের গাড়ি ছিলো মোট ৩২টি। এবার ৩২টি গাড়ি নিলামে তোলার কথা। তবে ৭টি গাড়ি যারা এনেছেন তাদের কারো ঠিকানায় ও কারো আনা গাড়ির চেসিজ নম্বরে ভুল থাকায় চিঠি চালানে আইনগতভাবে পিছিয়ে যায়।
এছাড়া অন্য একটি গাড়ি শুল্কায়নের নির্ধারিত মূল্যে একজন সাবেক সংসদ সদস্য নিয়ে যান। তাই আমরা আশা করছি সংরক্ষিত মূল্য বেশি ধরা হয়নি। বিডাররা আগ্রহ রাখবেন। যদি বেশি হতো তাহলে শুল্কায়ন শাখার মূল্যে এ গাড়ি নিতো না।
তিনি আরও বলেন, আগ্রহীরা এসে গাড়ি দেখছেন। এরপরও নিলাম যখন ওপেন (উন্মুক্ত) হবে, তখন আমরা বলতে দরদাতাদের অংশগ্রহণ নিয়ে বলতে পারবো। এমপিদের আরও সাতটি গাড়ি আছে। ওগুলো জন্য আমরা আরেকটি নোটিশ দিয়েছি। সাড়া পাবো বলে মনে হচ্ছে না। যদি সাড়া না পাই তাহলে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি গাড়িগুলো নিলামে তোলা হবে।
প্রসঙ্গত, দ্বাদশ জাতীয় সংসদের ৫১ জন সদস্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আমদানিতে লেটার অফ ক্রেডিট (এলসি) খোলেন। এর মধ্যে গাড়ি এনে ছাড় করান ছয়জন। আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আমদানি করা এসব গাড়ির শুল্কমুক্ত সুবিধা বাতিল করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
এরপর ফরিদপুর-৩ আসনের সাবেক সাংসদ এ কে আজাদ শুল্ক-কর দিয়ে ১ কোটি ৩ লাখ টাকার একটি গাড়ি ৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকায় ছাড় করান। বাকি গাড়ির বিষয়ে দু‘দফা নোটিশ জারির পরও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এরপর এসব গাড়ি নিলামের ঘোষণা দেয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
তম্মধ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা ২৪টি তৈরি ল্যান্ড ক্রুজারের সংরক্ষিত মূল্য ধরা হয়েছে ৯ কোটি ৬৭ লাখ ৩ হাজার ৮৯৯ টাকা। এছাড়া দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম বন্দরে পড়ে থাকা দুইটির মধ্যে একটির মূল্য ১ কোটি ৬২ লাখ ৭৩ হাজার ৮৪ টাকা এবং অন্যটি ১ কোটি ৩৭ লাখ ৯৬ হাজার ১২১ টাকা ধরা হয়েছে।
এছাড়া ২০২২ সালে তৈরি ২৪৮৭ সিসির একটি হ্যারিয়ার গাড়ির মূল্য ৭৬ লাখ ১৪ হাজার ৬৭৩ টাকা, ২০২২ সালে তৈরি ১৯৮৬ সিসির হ্যারিয়ার আইচি মূল্য ৮২ লাখ ৩ হাজার ৬৬৭ টাকা, ২০২০ সালে তৈরি ১৯৮৬ সিসি গাড়ির মূল্য ৬১ লাখ ৬১ হাজার ৩৪৯ টাকা, ২০১৯ সালের ১৯৮৬ সিসি আরেকটি হ্যারিয়ার গাড়ি ৫৫ লাখ ৫১ হাজার ৪৮২ টাকা এবং ২০১৮ সালের ১৯৮৬ সিসি আরেকটি হ্যারিয়ার গাড়ি ৫৫ লাখ ৫১ হাজার ৭৮৭ টাকা ধরা হয়েছে।
দুইটি র্যাভ ফোরের মধ্যে ২০১৯ সালের মডেলের মূল্য ৫৪ লাখ ৫৪ হাজার ৬৪৪ টাকা ও ২০২০ সালের গাড়িটির মূল্য ৫৬ লাখ ২২ হাজার ১০৭ টাকা ধরা হয়েছে। ২০১৯ সালের ১৯৮৬ সিসি টয়োটা এস্কোয়ারের দাম ৩০ লাখ ৩৮ হাজার ১৬৮ টাকা এবং চীনের তৈরি ১০টি হেভি ডিউটি সিনো ডা¤প ট্রাকের ৬টির প্রতিটি ৮৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯৩২ টাকা ও বাকি ৪টি ৮৫ লাখ ৬৭ হাজার ৭৮১ টাকা ধরা হয়েছে।
এদিকে বিদেশ থেকে আমদানি করা ৭৪টি গাড়িও স্ক্র্যাপ হিসেবে ২৪ টাকা ৫০ পয়সা কেজি দরে বিক্রী করেছে চট্টগ্রাম কাস্টমস। বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের নিলাম শেড চত্বরে রাখা কাটা গাড়ির টুকরোগুলো উন্মুক্ত নিলাম হয়। এতে চট্টগ্রামের ১৫টির বেশি রি-রোলিং মিল অংশ নেয়।
তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন কাস্টমসের নিলাম শাখার সহকারী কমিশনার মো. সাকিব হোসেন। তিনি বলেন, ৫৮টি লটে ৭৪টি গাড়ি নিলামে বিক্রির জন্য প্রতি টনের ভিত্তি মূল্য ধরা হয়েছিল ৫৩ হাজার টাকা। কিন্তু নিলামে দর উঠে ২৪ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত। অবশ্য ১৩ হাজার টাকা থেকেই শুরু হয়েছিল ডাক। কেজি প্রতি হিসেব করতে হলে প্রতি কেজির দাম পড়েছে ২৪ টাকা ৫০ পয়সা।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের মুখপাত্র ও উপ কমিশনার মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, মামলাসহ নানা জটিলতায় গাড়িগুলো আগেই চলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়েছিল। এ কারণে এনবিআরের (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) অনুমতি নিয়ে গাড়িগুলো স্ক্র্যাপ আকারে বিক্রি করা হয়েছে।
মূল্যবান ৭৪টি গাড়ি ভাঙারি হিসেবে বিক্রি করা নিয়ে বিডারদের অনেক অভিযোগ আছে। কিন্তু বিভিন্ন আইনি জটিলতার কারণে গাড়িগুলো বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া আজকের (বুধবার) উন্মুক্ত নিলামে শর্ত অনুযায়ী রি-রোলিং মিলগুলোকেই অংশ নেয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। তাই বিডারের সংখ্যা ১৫ বা তার কিছুটা বেশি হবে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের নিলাম শাখা ২০২৩ সালের ৩১ অক্টোবর এ গাড়িগুলোকে স্ক্র্যাপ হিসিবে বিক্রি করার সুপারিশ দেয়। পর্যায়ক্রমে গাড়িগুলো ২০২৪ সালে কেটে স্ক্র্যাপ করা হয়। সম্প্রতি বন্দরে পড়ে থাকা গাড়ির নিলাম কার্যক্রমে গতি আসায় স্ক্র্যাপ গাড়িগুলো কেজি দরে নিলামে তুলে বিক্রি করা হয়।