
সারাদেশে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে রাসেলস ভাইপার সাপ। গত কয়েক মাস ধরে এই বিষধর সাপটি নিয়ে ফেসবুকসহ নানা মাধ্যমে নেতিবাচক খবর দেখা যাচ্ছে। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও এই সাপের কারণে মানুষ মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে।
গত শুক্রবার ফরিদপুর সদর উপজেলার নর্থচ্যানেলের দুর্গম চরে বিষধর রাসেলস ভাইপার সাপের কামড়ে একজন কৃষকের মৃত্যর খবর পাওয়া গেছে। ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। মারা যাওয়া কৃষকের নাম হোসেন বেপারী (৫১)। তিনি সদর উপজেলার নর্থচ্যানেল ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের পরেশউল্লা ব্যাপারীর ছেলে।
এদিকে জেলার পার্শ্ববর্তী ডিক্রিরচর ইউনিয়নে বৃহস্পতি ও শুক্রবার দুদিনে দুটি রাসেলস ভাইপার সাপ দেখতে পেয়ে সেগুলো পিটিয়ে মেরেছে গ্রামবাসী।
শুক্রবার সকালে সদর উপজেলার ডিক্রিরচর ইউনিয়নের আইজউদ্দীন মাতুব্বরের ডাঙ্গি গ্রামে ক্ষেতে কাজ করার সময় একটি রাসেলস ভাইপার সাপ দেখতে পান ওই গ্রামের তোতা মোল্লার ছেলে মুরাদ মোল্লা (৪৫)। মুরাদ মোল্লা বলেন, সকালে বাদামের জমিতে কাজ করার সময় সাপটি নজরে পড়ে। এরপর লাঠি এনে তিন-চারটি বাড়ি মেরে সাপটি মেরে ফেলি।
এর আগের দিন (বৃহস্পতিবার) ওই গ্রামের হারুন শেখের ছেলে ইউসুফ আরও একটি রাসেলস ভাইপার সাপ পিটিয়ে মেরে ফেলেন বলে জানান।
সম্প্রতি বিষাক্ত সাপ রাসেলস ভাইপারকে কেন্দ্র করে সারা দেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ কেউ আবার বলছেন, এসব নাকি গুজব। কেউ আবার এই সাপ মারতে পারলে পুরস্কারও ঘোষণা করেছেন। সব মিলিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
এ বিষয়ে এক বন কর্মকর্তার ভাষ্য, যেকোনো বন্যপ্রাণী নিধন আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। রাসেলস ভাইপার এ দেশ থেকে বিলুপ্ত হওয়ার পরে ২০১৪ সাল থেকে আবার সাপটির দেখা যাচ্ছে। এ সাপের বংশবৃদ্ধির হার বেশি। একবারে একটি মা সাপ ৬০-৭০টি বাচ্চা দেয় এবং প্রায় সবকটি বাচ্চা বেঁচে যায়। এ সাপ সাধারণত চর এলাকায় থাকে। এদের খাবার ব্যাঙ ও ইঁদুর।
বন কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘পুরস্কারের এ ঘোষণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কেউ যদি রাসেলস ভাইপার সাপ ধরতে অথবা মারতে গিয়ে সাপের কামড়ে মারা যান, তাহলে এর দায় কে নেবে?’
জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে বেড়ে যাওয়া মারাত্মক বিষধর সাপ রাসেলস ভাইপারের উপদ্রবে ও দংশনে বাড়ছে মৃত্যুও। বিশেষ করে ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, রাজশাহীসহ পদ্মা নদী-তীরবর্তী এলাকায় দেখা দিয়েছে আতঙ্ক।
পদ্মা-তীরবর্তী মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলা। এই এলাকার মূল ভূখণ্ড থেকে লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের এনায়েতপুর গ্রামে যেতে হয় নৌকায়, সময় লাগে ১ ঘণ্টা। এই চরেই জেঁকে বসেছে রাসেলস ভাইপারের আতঙ্ক। কেননা গত ৩ মাসে এই সাপের কামড়ে মারা গেছেন ৫ জন। স্থানীয়রা পিটিয়ে মেরেছেন অন্তত ৩৫ থেকে ৪০টি সাপ।
ভুক্তভোগীর একজন স্বজন জানান, তার বোনজামাই ভুট্টা আনতে গিয়ে সাপের কামড় খান। সেই সাপটি রাসেলস ভাইপার ছিল। পরে তার বোন জামাইকে ফরিদপুর মেডিকেলে নেওয়া হয়েছিল। সেখানে ১০টি ভ্যাকসিন দিলেও বিষ নামেনি। পরে ঢাকায় আনার পথে তার বোন জামাইয়ের মৃত্যু হয়।
শুধু মানিকগঞ্জ নয়, ফরিদপুর জেলার পদ্মা তীরবর্তী চরাঞ্চলেও দেখা মিলছে রাসেলস ভাইপারের। ফলে আতঙ্কে চরে কৃষি কাজ করতে ভয় পাচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
কৃষকরা জানান, এই সাপের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। কারণ কৃষকরা আতঙ্কে জমিতে কাজ করতে পারছেন না। সব সময় তাদের ভয়ের মধ্যে থাকতে হচ্ছে।
রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপ। যাকে বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হলেও পদ্মা-তীরবর্তী বিভিন্ন এলাকায় আবারও দেখা মিলছে বিষধর এই সাপের। গবেষকরা বলছে, প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে স্বভাব পরিবর্তন করছে রাসেলস ভাইপার।
সাপ ও সরীসৃপ গবেষক বোরহান বিশ্বাস রমন বলেন, সঠিক সার্ভে না করেই বাংলাদেশ থেকে রাসেলস ভাইপার বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের বিভিন্ন অঞ্চলে এই সাপটি টিকে ছিল। পরবর্তীতে গঙ্গা হয়ে পদ্মা দিয়ে ২০০৯-১০ সালে ভেসে এসে পদ্মার চরাঞ্চলে অবস্থান নেয়। তারা বংশ বিস্তার করে এবং বন্যায় এগুলো বিভিন্ন জেলায় ভেসে যায়।
বর্তমানে এই সাপ দেশের ২৮টি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। অন্য সাপ যেমন পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে সেখানে এই সাপগুলো এটা করে না। এ ধরনের সাপগুলোর কাছাকাছি যখন মানুষ চলে আসে তারা শব্দ করতে থাকে আবার যখন তার রেঞ্জে মানুষ চলে যায় তখনই আতঙ্কিত হয়ে কামড় দিয়ে বসে।
চন্দ্রবোড়া সাপের দেখা মিলছে যেসব এলাকায়, সেখানকার সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানালেন, সংকট আছে অ্যান্টি ভেনমের। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, অ্যান্টি ভেনেমের কোনো সংকট নেই।
স্বাস্থ্য সচিব জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এই সাপগুলোর প্রভাব আগে ছিল না। ভারত থেকে এসেছে বলেই এটি বেড়ে যাচ্ছে। আমাদের কাছে রাসেলস ভাইপারের যে ন্যাচারাল ক্যারেক্টার আছে এখন এই ক্যারেক্টার অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। ফলে যে অ্যান্টি ভেনম আমরা পুশ করি, সেটি এখন কার্যকর হচ্ছে না।
ছোবল দিলে যা করতে হবে
প্রায় ৪০০০-এর বেশি সর্প দংশনের রোগীর চিকিৎসা দেওয়া ডা. ফরহাদ উদ্দীন হাসান চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের প্রধান ৩টি বিষাক্ত সাপ হলো গোখরা (কোবরা), কেউটে (ক্রেইট) এবং রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া। রাসেলস ভাইপার অপেক্ষাকৃত বেশি বিষধর। অতিসম্প্রতি এই সাপটির প্রকোপ বেড়ে গেছে। তবে এই সাপটি নিজ থেকে তাঁড়া করে কাউকে দংশন করে না। মূলত অসাবধানতাবশত কেউ এই সাপের গায়ে পাড়া দিলে এই সাপটি ছোবল দেয়।
তিনি বলেন, এই সাপের বিষ শরীরে প্রবেশ করলে মূলত শরীরের রক্ত পাতলা হয়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে স্বতঃস্ফূর্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে, কিডনি বিকল হতে পারে, স্নায়ু অবশ হয়ে ফুসফুসের কার্যকারিতা হারিয়ে যেতে পারে এমনকি হার্ট অ্যাটাকও হতে পারে। বাংলাদেশে সর্প দংশন প্রতিরোধী যে অ্যান্টিভেনম রয়েছে সেগুলো কোবরা এবং ক্রেইটের বিপরীতে ভালোভাবে কাজ করলেও রাসেলস ভাইপারের বিরুদ্ধে ভালোমতো কাজ করে না। এই এন্টিভেনমটিতে ভারতীয় রাসেলস ভাইপারের বিরুদ্ধে উপাদান রয়েছে। ভারতীয় রাসেলস ভাইপারের বিষ এবং বাংলাদেশের রাসেলস ভাইপারের বিষের ভেতরে উপাদানগত বৈসাদৃশ্য বেশি হওয়ায় এটি পুরাপুরি কাজ করে না।
ডা. ফরহাদ বলেন, আমাদের দেশের এই সাপটির বিরুদ্ধে একটি কার্যকরী অ্যান্টিভেনম তৈরি করার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের চিকিৎসা বিজ্ঞানী অধ্যাপক অনিরুদ্ধ ঘোষের নেতৃত্বে একদল গবেষক বিগত প্রায় ৪-৫ বছর নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। আশা করি আমরা অদূর ভবিষ্যতে রাসেলস ভাইপারের বিরুদ্ধে কার্যকরী দেশীয় একটি অ্যান্টিভেনম পেতে পারি।
তিনি বলেন, বিষাক্ত আর অবিষাক্ত মিলিয়ে আমি জীবনে ৩০০০-৪০০০ এর বেশি সর্প দংশনের রোগী নিজেই চিকিৎসা করেছি। কোবরা, ক্রেইট, রাসেলস ভাইপার সব ধরনের সাপের কামড়ের চিকিৎসা করেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত রাসেলস ভাইপারের ক্ষেত্রে ৫০%-এর বেশি রোগীকে বাঁচাতে পারিনি। তবে আক্রান্ত হওয়ার পরপরই দ্রুততম সময়ে হাসপাতালে এলে অতিদ্রুত অ্যান্টিভেনম শুরু করলে ও সাপোর্টিভ চিকিৎসা যেমন ডায়ালাইসি, ভেন্টিলেশন ইত্যাদি দিলে রোগী বাঁচানো সম্ভব বলে মনে করি।