শনিবার- ২৬ এপ্রিল, ২০২৫

সিন্ডিকেটের কবলে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়

উচ্চ আদালতে মামলা ঠুকে স্থগিতাদেশের মাধ্যমে ঠিকাদার ‍নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধের সুযোগে লুটপাট!

সিন্ডিকেটের কবলে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়

“মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও বছরের পর বছর ঠিকাদারি কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন অবৈধ ঠিকাদাররা। অথচ বিভিন্ন সময় পরিবহনকালে চাল-গম চুরি করতে গিয়ে তারা ধরাও পড়েছেন। কিন্তু প্রতিবারই কর্তাদের পকেট ভরিয়ে চুরির অভিযোগ থেকে পার পেয়ে গেছেন নির্বিঘ্নে”

সিন্ডিকেটের কবলে পড়েছে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়। ফলে ৬ বছর ধরে নতুন ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। উচ্চ আদালতে মামলা ঠুকে দিয়ে স্থগিতাদেশের মাধ্যমে ঠিকাদার ‍নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধের সুযোগে লুটেপুটে খাচ্ছে কতিপয় অসাধু ঠিকাদার।

সম্প্রতি এমন অভিযোগ করেছেন তালিকাভুক্ত প্রকৃত ঠিকাদাররা। তারা জানান,  চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক (আরসি-ফুড) কার্যালয়ে ৪৫৭ জন পরিবহন ঠিকাদার রয়েছে। কিন্তু তাদের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে প্রায় ৬ বছর। এরই মধ্যে নতুন ঠিকাদার নিয়োগের দরপত্রও আহ্বান করা হয়। তবে তালিকাভুক্ত ঠিকাদার নয়—এমন দু‘জন অসাধু ঠিকাদার ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে পৃথকভাবে আদালতে মামলা ঠুকে স্থগিত করে দিয়েছেন নিয়োগ কার্যক্রম।

ফলে মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও বছরের পর বছর ঠিকাদারি কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন অবৈধ ঠিকাদাররা। অথচ বিভিন্ন সময় পরিবহনকালে চাল-গম চুরি করতে গিয়ে তারা ধরাও পড়েছেন। কিন্তু প্রতিবারই কর্তাদের পকেট ভরিয়ে চুরির অভিযোগ থেকে পার পেয়ে গেছেন নির্বিঘ্নে।

ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের দাবি, নতুন ঠিকাদার নিয়োগ না হলেও দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে খাদ্য ঠিকাদারি কাজ চালানো হলে সরকারের অর্থ সাশ্রয় হত । এতে দুই নম্বরি ফন্দি ভেস্তে যেত অসাধু সিন্ডিকেটের। আর যদি পুরনো ঠিকাদাররা কাজে থাকেন, তাহলে খাদ্য পরিবহনে অনিয়ম ও চুরি দিন দিন বাড়তেই থাকবে।

ব্যবসায়ীরা জানান, ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে নিয়োগ পাওয়া ৪৫৭ জন পরিবহন ঠিকাদার দরপত্র ছাড়াই এখনো কাজ করছেন। ২০১৯ সালের জুনে মেয়াদ শেষ হয়। কিন্তু ওই সময় করোনা পরিস্থিতির ইস্যু দেখিয়ে তিন মাস করে মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে অন্তত দেড় বছর। পরবর্তীতে করোনার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও নতুন ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গেল কয়েক বছরে চট্টগ্রাম নগরের বেশ কয়েকটি এলাকায় সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির জন্য বরাদ্ধকৃত চাল ও গম পরিবহন করে নেওয়ার সময় নির্দিষ্ট গন্তব্যে না গিয়ে খালাস হয়েছে চোরাইপথে। এক-দেড় বছর ধরে খাদ্য বোঝাই চাল ও গমের ট্রাকগুলো অবৈধপথে খালাসের সময় একাধিকবার ধরা পড়েছে পুলিশ-র‌্যাবের হাতে। এসব ট্রাক বের হয়েছিল হালিশহর ও দেওয়ানহাট সিএসডি এবং পতেঙ্গা সাইলো ডিপো থেকে। সিন্ডিকেটটি সরকারের কোষাগার থেকে তুলে নিচ্ছে প্রতিমাসে কয়েক লাখ টাকা।

সূত্র জানায়, ২০২২ সালের ৬ জুলাইয়ের দিকে নতুন ঠিকাদার নিয়োগ দিতে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি জারি করে চট্টগ্রাম আরসি-ফুড। ২০২২ সালের ২৬ জুলাই ‘রক্তপাতের আশঙ্কা’ করে ঢাকার একটি আদালতে মামলা দায়ের করেন এক ব্যক্তি। যিনি মামলাটি করেছিলেন তিনি আরসি-ফুড চট্টগ্রামের তালিকাভুক্ত কোনো পরিবহন ঠিকাদার নন। মামলার পর নতুন ঠিকাদার নিয়োগ কার্যক্রমে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করেন আদালত।

ওই বছর একই ইস্যু তুলে নারায়ণগঞ্জ আদালতে আরও একটি মামলা দায়ের করেন আরেক ব্যক্তি। তিনিও আরসি-ফুডের তালিকাভুক্ত ঠিকাদার নন। এই মামলায়ও নতুন ঠিকাদার নিয়োগ কার্যক্রমে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করেন আদালত। পরবর্তীতে এই মামলার ইস্যু ধরে ৪৫৭ জন পরিবহন ঠিকাদারকে কাজ চালিয়ে যাওয়ার আদেশ জারি করে আরসি-ফুড।

রাঙামাটিতেও একই কৌশল :
সম্প্রতি নতুন ঠিকাদার নিয়োগ না করতে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করে মেসার্স এয়ার মোহাম্মদ অ্যান্ড ব্রাদার্স। রিটের প্রেক্ষিতে রাঙামাটি জেলার ভারপ্রাপ্ত খাদ্য কর্মকর্তার (এলএসডি) আওতায় নতুন ঠিকাদার নিয়োগ কার্যক্রম স্থগিত করার আদেশ দেন হাইকোর্ট। এর পর নতুন ঠিকাদার নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত রাঙামাটি জেলার এলএসডিগুলোর আওতায় দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে শ্রম ও হ্যাল্ডলিং কাজ চালিয়ে যাওয়ার আদেশ দেয় আরসি-ফুড।

রাঙামাটির মতো চট্টগ্রামেও একই উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘রাঙামাটির মতো চট্টগ্রামেও মাস্টাররোল অথবা দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে খাদ্য পরিবহনে শ্রম ও হ্যান্ডলিং কার্যক্রম পরিচালনা করা জরুরি। বছরের পর বছর ধরে পুরনো ঠিকাদাররা যদি কাজ করতে থাকেন, তাহলে তো একটা সিন্ডিকেট তৈরি হবে এটাই স্বাভাবিক। আর এই সিন্ডিকেট প্রায়ই চাল-গম পরিবহনের সময় খালাসের আগেই চুরি করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ছে। প্রশ্ন উঠেছে, তবু তাদের দিয়েই কেন পরিবহন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে? অভিযুক্ত ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ?’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক এস এম কায়ছার আলী বলেন, রাঙামাটির এলএসডিগুলোতে মাস্টারেরোলের ভিত্তিতে ঠিকাদারি কার্যক্রম চালানোর সিদ্ধান্তটি মন্ত্রণালয়ের। আরসি-ফুডের একক কোনো সিদ্ধান্ত নয়।’ চট্টগ্রামেও আরসি-ফুডের ঠিকাদারদের ব্যাপারে অনুরুপ সিদ্ধান্ত আছে কীনা—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় চাইলে হতে পারে।

ঈশান/খম/সুপ

আরও পড়ুন

No more posts to show

You cannot copy content of this page