
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ড সমুদ্র উপকূলে বনের ৫০ একর জমি দখল করে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ইউনিটেক্স গ্রুপের বিরুদ্ধে। দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ভাড়াটে সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে বনের এসব জমি দখল করে প্রতিষ্ঠানটি।
দখলে বাধা দিতে গেলে ভাড়াটে সন্ত্রাসীর ধাওয়ার শিকার হয়েছেন বন কর্মকর্তারা। পরে এ ঘটনায় ইউনিটেক্স কর্মকর্তাসহ ৩ জনের নাম উল্লেখ করে মোট ২৮ জনের বিরুদ্ধে সীতাকুণ্ড থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছে বাঁশবাড়িয়া বিট কর্মকর্তা মো. আব্দুস সালাম সরদার। একই ঘটনায় চট্টগ্রাম বন আদালতেও মামলা হয়েছে বলে জানান তিনি।
বিট কর্মকর্তা আব্দুস সালাম সরদার এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, বুধবার (৭ জুন) সকাল দশটায় নড়ালিয়া মৌজার সমুদ্র উপকূলে বন পাহারাদার টহল দল নিয়ে টহল দিতে যান বাঁশবাড়িয়া বিটের একটি টিম। এসময় তারা দেখতে পান সেখানে ২০-২৫ জন সন্ত্রাসী দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বনের জায়গা দখল করছে। স্কেভেটর দিয়ে মাটি কেটে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে এবং চারপাশে উঁচু বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। বনের জায়গায় কেন এসব করা হচ্ছে কারণ জানতে চাইলে কর্মরতরা ইউনিটেক্স গ্রুপের নির্দেশে তারা কাজ করছেন বলে জানান।
এসময় বিট কর্মীদের নানাভাবে হুমকি-ধমকি ও ভয়ভীতি দেখানো হয়। পরক্ষণে বন পাহারাদার টহল দল নিয়ে শক্ত অবস্থানে গেলে এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করলে সন্ত্রাসীরা পিছু হটে। একপর্যায়ে তারা ইউরো গ্যাসের অফিসে যেতে চাপ প্রয়োগ করেন। পরে সীতাকুণ্ড উপকূলীয় রেঞ্জ বন কর্মকর্তা বিষয়টি সীতাকুণ্ডের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আশরাফুল আলমকে জানালে তিনি ভূমি অফিস থেকে সার্ভেয়ার পাঠিয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেন।
এ ঘটনায় বুধবার বিকেলে সীতাকুণ্ড থানায় হাজির হয়ে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়। অভিযোগে ইউনিটেক্স গ্রুপের (এস্টেট এণ্ড ল্যাণ্ড) এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার গোলাম মাওলা, বাড়বকুণ্ডের মিয়াজী পাড়ার সিরাজুল হকের ছেলে মো. জাহেদ (৪৫) ও একই এলাকার ফসিউল আলমের ছেলে মো. হাসানের (৪০) বিরুদ্ধে জোরপূর্বক সংরক্ষিত বনের ৫০ একর জায়গা দখল, সরকারি কাজে বাধা, বারবার সরকারি নির্দেশ উপেক্ষা, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপর হামলা ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযোগ আছে, গত কয়েকবছর ধরে সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ডে বেড়িবাঁধের পশ্চিমে সমুদ্র উপকূলের ৫০ একর বনভূমি দখলের চেষ্টা করে আসছে ইউনিটেক্স গ্রুপ। জায়গাগুলো চর প্রকৃতির ও সবুজ ঘাস বিস্তৃত। যেখানে একসময় কেওড়া বন ছিল বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা। বেশ কয়েক বছর আগে সেখানে ইউরো গ্যাস নামে ইউনিটেক্স গ্রুপের একটি এলপি গ্যাস ফ্যাক্টরি গড়ে উঠে। এরপর সেখানে গেড়ে বসে প্রতিষ্ঠানটি। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠানটি সংরক্ষিত ম্যানগ্রোভ বন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের জমি গ্রাস করা শুরু করে। ২০২১ সালের শেষের দিকে তারা সমুদ্র উপকূলে লাল সাদা খুঁটি স্থাপন করে জায়গাগুলো নিজেদের বলে দাবি করে।
২০২২ সালের শুরুর দিকে বিস্তৃত বনের কেওড়া, বাইন, গেওয়াসহ হাজার হাজার গাছপালা নির্বিচারে ধ্বংস করে দেয় ইউনিটেক্স, ক্যাপিটালসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। সে বছরের এপ্রিলে বন বিভাগের সঙ্গে ইউনিটেক্সের বিরোধ প্রকাশ্যে আসে। ৩০ একর বনভূমি জবরদখলের অভিযোগ পেয়ে একই বছরের ১২ এপ্রিল চট্টগ্রামের সহকারী বন সংরক্ষক সাইফুল ইসলাম, সীতাকুণ্ড রেঞ্জ বন কর্মকর্তা ও বাঁশবাড়িয়া বিট কর্মকর্তাসহ বন বিভাগের একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ইউনিটেক্সের মুখোমুখি হতে হয়।
সেসময় ইউনিটেক্স গ্রুপের পরিচালক (লিগ্যাল অ্যান্ড এস্টেট) ফারহান আহমেদ বাড়বকুণ্ড ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছাদাকাত উল্লাহ মিয়াজী ও তার কোম্পানির অন্যান্যদের সঙ্গী করে সমুদ্র উপকূলে হাজির হন। ওইদিন বন কর্মকর্তারা ফারহান আহমেদের কাছে কেন অবৈধভাবে সমুদ্র উপকূলে অসংখ্য খুঁটি স্থাপন করা হয়েছে জানতে চান। উত্তরে ফারহান আহমেদ জায়গাগুলো তাদের কোম্পানির নামে নামজারি আছে বলে দাবি করেন। কিন্তু সেদিন তিনি সঙ্গে কোনো কাগজপত্র আনেননি এবং বন কর্মকর্তাদের দেখাতেও ব্যর্থ হন। সেসময় ফারহান আহমেদ জায়গাগুলো ব্যক্তির নামে রেকর্ড আছে এবং তারা কিনে নিয়েছে বলেও দাবি করেন।
ফারহান আহমেদের সুরে বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছাদাকাত উল্লাহ মিয়াজী বলেন, জায়গাগুলো তাদের মৌরশি সম্পত্তি। যদিও বন কর্মকর্তারা ফারহান আহমেদের কথাকে পাত্তা দেননি। বরং অবৈধভাবে স্থাপিত খুঁটি অপসারণ শুরু করেন। এমন অবস্থায় ইউনিটেক্স গ্রুপের কর্মকর্তা ফারহান আহমেদ স্বপ্রণোদিত হয়ে সীতাকুণ্ডের এসিল্যান্ড মো. আশরাফুল আলমকে মুঠোফোনে কল করেন। পরে এসিল্যান্ড বন কর্মকর্তাদের পরদিন ভূমি অফিসে আসতে বলেন। পরবর্তীতে উপকূলীয় বন বিভাগের পক্ষ থেকে উপজেলা ভূমি অফিসে একটি নামজারি বাতিলের আবেদন (মিছ মামলা) করা হয়।
জানা যায়, দুই দফায় এসিল্যান্ড অফিসে শুনানি অনুষ্ঠিত হলেও উপযুক্ত কাগজপত্র দেখাতে পারেনি ইউনিটেক্স। সর্বশেষ গত ২৩ মে অনুষ্ঠিত শুনানিতেও জমির মালিকানা সংক্রান্ত কাগজপত্র দেখাতে ব্যর্থ হয় ইউনিটেক্স।
বন কর্মকর্তারা জানান, দফায় দফায় থানায় অভিযোগ ও এসিল্যান্ডের পক্ষ থেকে কাজ বন্ধ রাখতে বলা হলেও কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করছে না তারা। প্রায় সময় রাতের আঁধারে ইউনিটেক্স বন বিভাগের জায়গা ধীরে ধীরে দখলে নিচ্ছে। কখনও মাটি অপসারণ করছে, কখনও বাঁধ নির্মাণ করছে। আবার কখনও সীমানা পিলার স্থাপন করছে।
এ বিষয়ে উপকূলীয় বন বিভাগের বাঁশবাড়িয়া বিট কর্মকর্তা মো. আব্দুস সালাম সরদার বলেন, ইউনিটেক্স সংরক্ষিত বনের ৫০ একর জায়গা জবরদখল করে নিচ্ছে। আমরা বারবার বাধা দিলেও তারা সবকিছু উপেক্ষা করে সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে জবরদখলের চেষ্টা করে। গতকাল আমাকে ভয়ভীতি দেখানো হয়। এসময় সন্ত্রাসীরা দেশীয় অস্ত্র গামছায় পেছিয়ে মোড়ে মোড়ে অবস্থান নিয়েছিল। আমাকে ইউরো গ্যাসের অফিসে যেতে চাপ দিচ্ছিল।
উপকূলীয় বন বিভাগের সীতাকুণ্ড রেঞ্জ কর্মকর্তা কামাল হোসেন বলেন, আমাদের কর্মকর্তাদের ধাওয়া দেওয়া হয়েছে। মারধরের উদ্দেশ্যে হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। ইউনিটেক্স গ্রুপ ওই এলাকায় জবরদখল চালাচ্ছে। জায়গাগুলো বন বিভাগের আওতাধীন সংরক্ষিত ম্যানগ্রোভ বনে। যা ৪ ও ৬ ধারায় গ্রেজেট নোটিফিকেশনভুক্ত। তিনি আরও বলেন, ইউনিটেক্স গ্রুপ মালিকানা দাবি করলেও এখনও কোনো প্রকার কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। সেখানে কারও নামে কোন লিজও নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপকূলীয় বন বিভাগের চট্টগ্রাম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আব্দুর রহমান বলেন, থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে এবং আসামিদের বিরুদ্ধে মামলাও হচ্ছে। বন দখলের কোনো সুযোগ নেই। সরকারি সম্পত্তি রক্ষায় আমরা কঠোর অবস্থানে আছি।
দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সীতাকুণ্ডের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আশরাফুল আলম বলেন, এ বিষয়ে দুটো পক্ষকেই কাগজপত্র দেখাতে বলা হয়েছে। তারা কেউই এখনও কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। তবে আমি রেকর্ড দেখে জানতে পেরেছি জায়গাগুলো ব্যক্তির নামে আরএস, বিএস ও পিএস রয়েছে। ইউনিটেক্স দাবি করছে জায়গাগুলোর পূর্বের সকল রেকর্ড ব্যক্তির নামে এবং তারা ব্যক্তির কাছ থেকে কিনে নিয়েছে। বন বিভাগও তাদের নামে বলে দাবি করছে এবং নামজারি বাতিলের আবেদন করেছে। আগামী শুনানিতে উভয়পক্ষের কাগজপত্র প্রদর্শন করার কথা রয়েছে। এসময় কোন ব্যক্তির নামে জায়গাগুলো রেকর্ড রয়েছে তা জানাতে পারেননি এসিল্যান্ড।
এ বিষয়ে জানতে ইউনিটেক্স গ্রুপের পরিচালক (লিগ্যাল অ্যান্ড এস্টেট) ফারহান আহমেদকে বেশ কয়েকবার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।