
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রধান প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হিসেবে ঘোষিত চট্টগ্রামের হালদা নদীতে নমুনা ডিম ছেড়েছে কার্প জাতীয় মা মাছ। বজ্রসহ বৃষ্টির পর বুধবার রাতে নদীর তিনটি পয়েন্টে নমুনা ডিম পাওয়ার কথা জানান ডিম সংগ্রহকারীরা।
তবে বৃহস্পতিবার (১৮ মে) দিনভর জাল নিয়ে নামলেও নমুনা ডিম তেমন পাওয়া যায়নি বলে জানান চট্টগ্রামের হাটহাজারীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শাহিদুল আলম। তিনি বলেন, টানা তাপ প্রবাহের পর বজ্রসহ বৃষ্টি হয় মঙ্গলবার রাতে।
এরপর হালদা নদীতে মা মাছের আনাগোনা শুরু হয়। বুধবার রাত ১২টার দিকে নমুনা ডিম ছাড়ে মা মাছ। যা সংগ্রহ করতে নামেন সংগ্রহকারীরা। এর মধ্যে গড়দুয়ারার কাটাখালী এবং উত্তর মাদার্শার আমতুয়া ও নাপিতের ঘাট এলাকায় কিছু ডিম মিলেছে।
হালদা পাড়ের ডিম সংগ্রহকারী কামাল সওদাগর বলেন, মা মাছ এখনো ডিম পুরোদমে ছাড়েনি। নমুনা ডিম ছেড়েছে মাত্র। কয়েকজন ডিম সংগ্রহকারী ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম ডিম সংগ্রহ করেছেন। কেউ কেউ আরও কম পেয়েছেন। তবে দুই-একদিনের মধ্যে মেঘের গর্জন ও বৃষ্টিসহ পাহাড়ি ঢল হালদায় প্রবেশ করলে ডিম দেবে মা মাছ।
তিনি বলেন, নমুনা ডিম ছাড়ার পর নদী তীরের ডিম সংগ্রহকারীরা নিজেদের নৌকা নিয়ে নদীতে পর্যবেক্ষণ করছেন। ডিম সংগ্রহকারীরা প্রস্তুত আছেন। প্রতি নৌকায় দুয়েকজন নিয়ে পরিস্থিতি দেখছেন। ডিম ছাড়লে সবাই সংগ্রহে নামবেন। তিনটি সরকারি হ্যাচারিও প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী বলেন, প্রতি বছর এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে বজ্রসহ বৃষ্টি এবং পাহাড়ি ঢল নামলে অমাবস্যা বা পূর্ণিমা তিথিতে নদীতে জোয়ার ও ভাটার সময়ে নিষিক্ত ডিম ছাড়ে রুই, কাতল, মৃগেল, কালিবাউশ জাতীয় মা মাছ।
গত কয়েক বছরের মধ্যে শুধু ২০১৮ সালে এপ্রিল মাসে মা মাছ ডিম ছেড়েছিল। এছাড়া বাকি চার বছরই মে মাসের দ্বিতীয়ার্ধে মা মাছ ডিম ছাড়ে। চলতি মৌসুমে প্রথমবারের মতো মঙ্গলার রাতে চট্টগ্রামে বজ্রসহ বৃষ্টি হয়েছে। এর আগে পর্যন্ত পুরো চৈত্র ও বৈশাখ মাসজুড়ে বৃষ্টির দেখা মেলেনি।
বৃষ্টি না হওয়ায় কাপ্তাই হ্রদের পানি কমে যাওয়ার ফলে সাগর থেকে জোয়ারের পানি হালদায় বেশি মাত্রায় ঢুকে পড়ে, যা নদীতে লবণাক্ততা বাড়িয়ে তুলে। এতে হালদায় মা মাছের ডিম ছাড়া নিয়ে শঙ্কা তৈরী হয়েছিল। অবশেষে বজ্রসহ বৃষ্টির পর পানির লবণাক্ততা কমায় মা মাছ নমুনা ডিম ছেড়েছে।
হালদা গবেষণা কেন্দ্রের গবেষক অধ্যাপক মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, হালদা নদীর মদুনাঘাট থেকে সমিতির হাট পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার অংশে হাটাহাজারী এবং রাউজান উপজেলা সংলগ্ন অংশেই মেলে নিষিক্ত ডিম। এই অংশেই মা মাছের আনাগোনা বেশি হয়। নদীতে মা মাছের ছাড়া নিষিক্ত ডিম বিশেষ ধরনের জাল দিয়ে সংগ্রহ করে ডিম সংগ্রহকারীরা। পরে হ্যাচারিতে রেণু তৈরি করা হয়।
তিনি আরও বলেন, হালদা যেখানে কর্ণফুলীর সঙ্গে মিশেছে, সেই কালুরঘাট সেতুর কাছের অংশ থেকে উজানে মদুনাঘাট হয়ে নাজিরহাট পর্যন্ত প্রায় ৫০ কিলোমিটার অংশে নদীর দুই তীরে হাটহাজারী, রাউজান ও ফটিকছড়ি এই তিন উপজেলা। এসব উপজেলার সহস্রাধিক জেলে হালদা নদী থেকে প্রতিবছর ডিম সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করে।
স্থানীয় জেলেরা জানান, হালদা থেকে সংগৃহীত মাছের ডিম থেকে উৎপাদিত রেণু, পোনার দেশজুড়ে চাহিদা রয়েছে। দামও ভালো পাওয়া যায়। সাধারণ হ্যাচারিতে কৃত্রিম পদ্ধতিতে উৎপাদিত পোনার চেয়ে হালদার পোনা বড় হয় বেশি। এতে মৎস্যচাষীরা লাভবান হয়।
মূলত হালদার কাগতিয়ার আজিমের ঘাট, খলিফার ঘোনা, পশ্চিম গহিরা অংকুরী ঘোনা, বিনাজুরী, সোনাইর মুখ, আবুরখীল, সত্তারঘাট, দক্ষিণ গহিরা, মোবারকখীল, মগদাই, মদুনাঘাট, উরকিরচর এবং হাটহাজারী গড়দুয়ারা, নাপিতের ঘাট, সিপাহির ঘাট, আমতুয়া, মাদার্শা ইত্যাদি এলাকায় ডিম পাওয়া যায় বেশি।