
চট্টগ্রাম শহরের কোল ঘেষে বয়ে যাওয়া হালদা নদিতে গত এক সপ্তাহে মারা গেছে ৪টি রুই জাতীয় মা মাছ ও একটি ডলফিন। মাছ ও ডলফিনের এই মৃত্যুর মিছিল বঙ্গবন্ধু হ্যারিটেজ ঘোষিত দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্রের জন্য অশনি সংকেত হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, নদি দূষণ, মাছ শিকারের জন্য বিষ প্রয়োগ, রাবার ড্যামে জমে থাকা রাসায়নিক ও কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি এবং মা মাছ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার কারণে প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদার জৈব-বৈচিত্র ধ্বংসের পথে। এ কারণে হালদায় মা মাছ ও ডলফিনের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এ জন্য দায়ী হালদা তীরবর্তি রাউজান ও হাটহাজারী উপজেলার মাছ চোরেরা। যারা রয়েছেন স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়।
এমন মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা রিসোর্চ সেন্টারের গবেষক ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া। তিনি বলেন, হালদা নদিতে বিগত দুই বছর পরে কয়েকদিনের ব্যবধানে চারটি মা মাছ এবং একটি ডলফিনের মৃত্যু ঘটেছে। যা অস্বাভাবিক একটি ঘটনা।
সেই সাথে হতাশাজনক বিষয় হলো ২০১৬ সালের পর হালদা নদিতে এ বছর সবচেয়ে কম পরিমাণ ডিম দিয়েছে, যা পরিমাণে নমুনা ডিমের চেয়ে একটু বেশি। হালদা তীরের দুই উপজেলা রাউজান ও হাটহাজারীর শাখা খালসমূহের দূষণের কারণে পরিবেশগত বিপর্যয় এবং বিষ প্রয়োগে মাছ মারার প্রবণতা বৃদ্ধিই এর অন্যতম কারণ।
তিনি জানান, রাউজান উপজেলার সর্তা খালের উজানে ছিপাতলী, তেলপারই খালের মুখ, পেশকারহাট এলাকায় পেশাদার বড়শি দিয়ে মাছ ধরার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব এলাকায় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে প্রশাসনিক নজরদারি বাড়াতে হবে। অন্যথায় বঙ্গবন্ধু হ্যারিটেজ ঘোষিত দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা নদি রক্ষা করা যাবে না। এই নদি রক্ষায় বিষয়টিকে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। এই বিপর্যয় রোধে মৎস্য ও প্রাণিস¤পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দ্রুত একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে কারণ উদঘাটনের দাবি জানাচ্ছি।
সূত্র মতে, গত শুক্রবার (২৮ জুন) হালদা নদির হাটহাজারীর উত্তর মাদার্শা ইউনিয়নের কুমারখালী এলাকা থেকে দুটি কাতলা ব্রুড মাছ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে একটির ওজন ১০ কেজি এবং দৈর্ঘ্য ৫৮ সেন্টিমিটার, অপরটির ওজন সাড়ে ১২ কেজি। এটির দৈর্ঘ্য ৯৮ সেন্টিমিটার। মাছটি পচে যাওয়ায় মাটি চাপা দেওয়া হয়।
তবে মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণের জন্য ১২ কেজি ৫০০ গ্রাম ওজনের কাতলা মাছটি হাটহাজারী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার মাধ্যমে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এটি উদ্ধারের একদিন আগে আরও একটি ১২ কেজি ওজনের মরা কাতলা মাছ নদিতে ভেসে এলে সেটিও ডাঙায় তুলে মাটি চাপা দেয় স্থানীয়রা।
এর একদিন আগে ২৬ জুন হালদা নদির রাউজান উপজেলার উরকিরচর ইউনিয়নের বাকর আলী চৌধুরী ঘাট এলাকায়ও ১০ কেজি ওজনের একটি মা রুই মাছ মরে ভেসে ওঠে। পরে স্থানীয়রা এটি উদ্ধার করে মাটি চাপা দেয়। একই দিনে হাটহাজারীর গড়দুয়ারা ইউনিয়নের সিপাহীরঘাট এলাকা থেকে নদিতে ভাসমান অবস্থায় একটি মৃত ডলফিন উদ্ধার করা হয়। এটি উদ্ধার করে ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (আইডিএফ) কর্মীরা।
এ নিয়ে গত সাড়ে পাঁচ বছরে হালদা থেকে ৪১টি মৃত ডলফিন উদ্ধার হয়। এর আগে সর্বশেষ ২০২২ সালের ৩ নভেম্বর হালদা নদি থেকে একটি মৃত ডলফিন উদ্ধার করা হয়েছিল।
হালদার স্বেচ্ছাসেবী রাউজানের উরকিরচর ইউনিয়নের বাসিন্দা মুহাম্মদ মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, নদীতে আগে যান্ত্রিক নৌযানের পাখার আঘাতে ডলফিন ও মা মাছ মরে ভেসে উঠতো। যান্ত্রিক নৌ যান চলাচল বন্ধ ঘোষণার পর এখন ভেসে ওঠা মা মাছ ও ডলফিনে সেরকম আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে না। মূলত নদির হাটহাজারী অংশে যে ৪টি খাল হয়ে নগরীর বিভিন্ন কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য হালদা নদিতে পড়ছে, এসবের বিষক্রিয়ায় মা মাছ ও ডলফিন মারা যেতে পারে।
হালদার ডিম সংগ্রহকারী হাটহাজারীর গড়দুয়ারা ইউনিয়নের নতুনহাট এলাকার বাসিন্দা মো. কামাল উদ্দিন সওদাগর বলেন, হালদা নদির শাখা খালের মুখে স্লুইচ গেট এলাকায় কিছু কুম রয়েছে। এসব এলাকায় বিষ ঢেলে মাছ শিকার করে অসাধু ব্যক্তিরা। খালে ফেলা এসব বিষ নদিকে দূষণ করছে। ফলে মা মাছ মৃত্যুর মুখে পড়ছে। হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলার মাছ চোরেরা প্রভাবশালী ব্যক্তির ছত্রছায়ায় হালদা নদির মাছ লুটে খাচ্ছে। তাদের পরিবেশ বিধ্বংসি অপতৎপরতার কারণে হালদা নদি নিশ্চিহ্ন হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
ডিম সংগ্রহকারীদের অভিযোগ, ডিম দেওয়ার দু‘দিন আগে হালদা নদির ফটিকছড়ির ভূজপুর ও হারুয়ালছড়ি এলাকার দুই রাবার ড্যামের পানি ছেড়ে দেওয়া হয়। এতে রাবার ড্যামে ৬ মাস ধরে জমে থাকা রাসায়নিক ও কেমিক্যাল হালদা নদির পানির সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়। তাতে ৭ মে মা মাছ নদিতে স্বাভাবিক পরিবেশ না পেয়ে ডিম ছাড়েনি। তাছাড়া মা মাছ নদিতে পুরো ডিম ছেড়ে দিতে না পারলে প্রাকৃতিকভাবে এগুলো নিজ শরীরে ধারণ করে ফেলে। কিন্তু পানির গুণাগুণ ও পরিবেশগত কোন সমস্যা থাকলে এ শারীরবৃত্তীয় কাজটি স¤পন্ন করার সময় অনেকক্ষেত্রে মা মাছ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
ডিম সংগ্রহকারীদের ভাষ্য, প্রভাবশালী রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় হালদা নদিকে সোনার ডিম পাড়া হাঁস মনে করছে। ডিম পাড়ার আগেই তারা পেট কেটে ডিম বের করে আনার কাজে লিপ্ত। উপজেলা প্রশাসন হালদা নদির সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা মাছ চোরদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে। এ কারণে হালদায় গত এক যুগের তুলনায় তেমন ডিমও মিলছে না।
ডিম সংগ্রহকারীদের তথ্যমতে, গত ৭ মে হালদায় সীমিত আকারে ডিম ছাড়ে মা মাছ। তাতে প্রায় ২০০ নৌকা নিয়ে হালদায় ডিম সংগ্রহ করেন আহরণকারীরা। পরে তা পরিচর্যা করে আহরণকারীরা প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ কেজি রেণু পান। অথচ আগের বছর ২০২৩ সালে রেণু পাওয়া যায় প্রায় ৪৩৭ কেজি। ২০২২ সালে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কেজি। ২০২১ সালে সাড়ে ৮ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ হয়েছিল। ২০২০ সালে হালদা নদিতে রেকর্ড ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি ডিম পাওয়া গিয়েছিল। ২০১৯ সালে প্রায় সাত হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল।
২০১৮ সালে স্থানীয়রা ডিম সংগ্রহ করেছিলেন ২২ হাজার ৬৮০ কেজি, ২০১৭ সালে মাত্র ১ হাজার ৬৮০ কেজি, ২০১৬ সালে ৭৩৫ (নমুনা ডিম) কেজি, ২০১৫ সালে ২ হাজার ৮০০ কেজি এবং ২০১৪ সালে ১৬ হাজার ৫০০ কেজি ডিম সংগ্রহ করেছিলেন ডিম সংগ্রহকারীরা। এবারও স্বাভাবিকভাবে ডিম সংগ্রহকারীরা আশা করেছিলেন পরবর্তী জো গুলোতে আরও ডিম পাওয়া যাবে। কিন্তু গত ২৫ জুন ডিম দেওয়ার সর্বশেষ জো ভরা পূর্ণিমা শেষ হয়ে গেলে আশাহত হন ডিম সংগ্রহকারীরা।