মঙ্গলবার- ২৯ জুলাই, ২০২৫

হাটে আছে পাতে নেই

ইলিশ এখন গরিব-মধ্যবিত্তের অতীত স্মৃতি!

ইলিশ এখন গরিব-মধ্যবিত্তের অতীত স্মৃতি!

দেড় মাসের খরা কাটিয়ে অবশেষে সাগরে জেলেদের জালে ধরা পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ। ফলে চট্টগ্রামের সাগর উপকূল থেকে মাছের আড়ত, পাইকারি থেকে খুচরা হাঁট-বাজার পর্যন্ত সয়লাব এখন ইলিশ মাছে। কিন্তু আকাশচুম্বী দামের কারণে গরিব মধ্যবিত্তের পাতে নেই ইলিশ।

তারা ইলিশের স্বাদ মেটাচ্ছেন এখন জিভের জলে। আর হাতড়াচ্ছেন অতীত স্মৃতি। বলছেন, বাজারে এক সময় ৮-১০ টাকা কেজিতে পাওয়া যেতো বড় বড় ইলিশ। এরপরও বিক্রি না হওয়া ইলিশ পচে গেলে তা ওজন করা ছাড়ায় ৪-৫ টাকায় দিয়ে দিতো পুরোটা। এই পচা ইলিশ ভাজাও যে কত স্বাদের তা বলে বোঝাতে পারব না।

সেই দিন এখন আর নেই। গরিব মধ্যবিত্তের অতীতের স্মৃতি রোমন্থনের এই সময়ে ইলিশের মজা লুটছেন কালো টাকার মালিক লুটেরা-ঘুষখোরেরা। নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের ভাষ্য, নব্বই দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সহজ ছিল গরিবের ইলিশ খাওয়া। তখন সাগরে মাছ ধরায় সরকারি কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রতি বছর শুরু হয় সাগরে মাছের উৎপাদন বাড়ানোর নামে মাছ ধরায় সরকারি নিষেধাজ্ঞা। এতে মাছের উৎপাদন বেড়েছে ঠিকই। কিন্তু সেই ইলিশ ক্রমেই পাতে ওঠা কমছে গরিব মধ্যবিত্ত মানুষের। বর্তমানে সেই ইলিশ হয়ে উঠেছে ঘুষখোর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী অথবা লুটেরা দুর্নীতিবাজ শিল্পপতি, মন্ত্রী-এমপি ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের খাবার।

নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের ভাষ্যমতে, ভোট দিয়ে সরকার বানায় যারা তাদের কপালে জুটে শোষণ, বঞ্চনা আর দুর্গতি। কেউ কেউ রাতেও ভোট করেছে। কিন্তু এবার হবে ভোট বিরতির মহড়া। কারণ সরকারের কারণেই নিষ্পেষিত সাধারণ মানুষ। সরকার গরিবের মুখ থেকে ইলিশ কেড়ে নিয়ে বিদেশে রফতানি করে ডলার আনছে। আর সেই ডলার চোরাই পথে পাচার হচ্ছে বিদেশে। তাতে জনগণের লাভ কী হচ্ছে?

রোববার (২৭ জুলাই) ভোরে চট্টগ্রাম মহানগরীর কাট্টলী উপকূলে রাণী রাসমণির ঘাট এলাকায় মাছ আহরণকারী জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আহরণকারীর নৌকা থেকে এক কেজি বা তার বেশি ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ এখন পাইকারি বিক্রয় হচ্ছে ১৩৭৫ টাকায়। ৬০০-৮০০ গ্রাম ওজনের ১১০০ টাকায়, ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৯০০ টাকায়, ৩০০-৪০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৭০০-৭৫০ টাকায় বিক্রয় হচ্ছে।

আড়তে বরফ দিয়ে সংরক্ষণের পর এক কেজি বা তার বেশি ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ মাছ বিক্রয় হচ্ছে ১৪০০-১৪৫০ টাকায়, ৬০০-৮০০ গ্রাম ওজনের ১১৫০ টাকায়, ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৯৫০-১০০০ টাকায়, ৩০০-৪০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৮০০-৯৫০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।

আড়ত থেকে নগরীর ফিশারিঘাটসহ বিভিন্ন পাইকারি বাজারে পৌঁছার পর এক কেজি ওজনের ইলিশ মাছ ২ হাজার টাকা, দেড়-দুই কেজি ওজনের ইলিশ ৩ হাজার টাকা এবং ৫০০ গ্রাম বা তার কিছু কম-বেশি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকায়।

নগরীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে এবং ভ্রাম্যমাণ দোকানে ইলিশের দর যাচাই করে দেখা গেছে, এক-দেড় কেজি ওজনের ইলিশ মাছ বিক্রি হচ্ছে ২০০০-২২০০ টাকায়, কোথাও কোথাও আবার তার চেয়েও বেশি। তবে খুচরায় বেশি মিলছে ৫০০-৭০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ, যেগুলোর দাম চাওয়া হচ্ছে ১৩০০-১৫০০ টাকা। এক কেজির কিছু কম ওজনের ইলিশ ১৮০০ টাকা দাম চাওয়া হচ্ছে। আর ভ্রাম্যমাণ ভ্যানে জাটকা বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ৫০০-৫৫০ টাকায়। দুই-আড়াই কেজি ওজনের বড় ইলিশ মাছ প্রতিকেজি তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে নগরীর কাজির দেউড়ি বাজারে।

কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী ফিশারিঘাটে মাছ কিনতে যাওয়া নগরীর মোমিন রোডের বাসিন্দা মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, সাবএরিয়া বাজারে ইলিশ মাছ দেখেছি, ২২০০-২৫০০ টাকা দাম। ভেবেছিলাম ফিশারিঘাটে এলে কিছুটা কম পাব। এখানেও দেখি এক পিস, দুই পিস কিনতে গেলে দেড় হাজার টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না। এত টাকা দিয়ে ইলিশ মাছ কেনার সাধ্য তো আমাদের নেই। ইলিশ তো কয়েক বছর ধরে শুধু শিল্পপতিতের পাতে জুটছে। আমাদের মতো গরিব-মধ্যবিত্তের পাতে ইলিশ জুটছে না।

মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারাও বলছেন, সাগরে যে হারে ইলিশ ধরা পড়ছে, তাতে বাজারে এত চড়া দাম কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ইলিশের দামে আমরাও বিস্মিত। বছর কয়েক আগেও সাগর তীরে সদ্য ধরে আনা ইলিশ গড়পরতা প্রতিকেজি ১০০-১৫০ টাকায় পাওয়া যেত। এখন সাগরতীরেই ৫০০-৭০০ টাকার নিচে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। আবার খুচরায় ১৩০০ টাকার নিচে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। ইলিশের চড়া দামের জন্য সরবরাহ সিন্ডিকেটকে দায়ী করেছেন তারা।

তবে রাণী রাসমণির ঘাট এলাকায় আর জে মৎস্য আড়তের স্বত্বাধিকারী জাহেদ বাবুল জানান, ইলিশের দাম এখন একটু বেশি। কারণ এটি এখনো ইলিশের ভরা মৌসুম নয়। ভরা মৌসুম শুরু হতে আরও ১৫ দিনের মতো লাগবে। তখন আরও বেশি ইলিশ ধরা পড়বে। দামও কমবে। এখন যে পরিমাণ ইলিশ আমরা পাচ্ছি, বরফ, লেবার আর ট্রান্সপোর্ট কস্ট মিলিয়ে আমাদের আরও লস হচ্ছে। বিদেশে রফতানি না হলে এই দামেও ইলিশ জুটত না বাজারে।

খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, নৌকা থেকে আড়ত হয়ে খুচরা বাজার পর্যন্ত পৌঁছাতে চারবার হাতবদল হয় ইলিশের। এই চার হাত চক্রের সিন্ডিকেটবাজির কারণে দাম সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসছে না। এছাড়া, সংরক্ষণ ও পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ার প্রভাবও পড়েছে। তবে ভাদ্র-আশ্বিনে আরও বেশি ইলিশ আহরণ হবে এবং এতে দাম কমবে বলে আশা পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের।

নগরীর আসকার দিঘীর পাড় খুচরা কাঁচাবাজারের মাছ বিক্রেতা আলম খান বলেন, ইলিশ মাছ আমরা এখনো বাজারে সেভাবে আনতে পারছি না। আড়তে আর পাইকারিতে যে দামে বিক্রি করছে, সেই দামে আমরা কিনে খুচরায় বিক্রি করতে গেলে মাছ নিয়ে বসে থাকতে হবে। মাঝে মাঝে দুই-চার পিস নিয়ে আসি, সেগুলো বিক্রি করতেও কেয়ামত হয়ে যায়।

আলম খানের মতে, ইলিশ মাছের জোগান ও সরবরাহের ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু ইলিশের ব্যবসায় বিনিয়োগকারী, মৎস্যজীবী, আড়তদার এবং পাইকারি ব্যবসায়ীদের গড়ে তোলা অদৃশ্য সিন্ডিকেটের কারণে দাম কমছে না। প্রতি বছর ইলিশের বাজার এই চার হাতের চক্রের মধ্যে ঘুরতে থাকে।

আহরণকারী জেলেদের মতে, বৈশাখ থেকে আশ্বিন মাসকে ইলিশ আহরণের মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। আষাঢ় থেকে আশ্বিন-এই সময়ে সবচেয়ে বেশি ইলিশ ধরা পড়ে, যাকে ভরা মৌসুম বলা হয়। প্রতিবছরের মতো এবারও বৈশাখের শুরু অর্থাৎ ১৪ এপৃল মধ্যরাত থেকে ১১ জুন পর্যন্ত ৫৮ দিন বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। নিষেধাজ্ঞা শেষে ১২ জুন থেকে সাগরে আবার মাছ আহরণ শুরু হয়, যে সময়টিকে ইলিশ আহরণের ভরা মৌসুম হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

মৎস্যজীবীদের ও জেলা মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ১২ জুন থেকে প্রায় দেড় মাস চাহিদা অনুযায়ী সাগরে ইলিশ ধরা পড়েনি। আবহাওয়াজনিত কারণে সাগর উত্তাল থাকছে প্রায়ই। ফলে মাছ ধরার নৌযানগুলো গভীর সাগরে যেতে পারছে না। কিংবা গেলেও আহরণ কম ছিল।

কিন্তু চলতি সপ্তাহে এসে এ চিত্র পাল্টে গেছে। সপ্তাহজুড়ে নৌকাপ্রতি ইলিশ আহরণের পরিমাণ আগের চেয়ে দ্বিগুণ-তিনগুণ বেড়েছে। এ অবস্থায় শনিবার (২৬ জুলাই) বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর কাট্টলীর রাণী রাসমণি ঘাট এলাকায় বঙ্গোপসাগর উপকূলে সামুদ্রিক মাছ আহরণের চিত্র পরিদর্শনে যান জেলা মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা।

চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রীবাস চন্দ্র চন্দ বলেন, গত তিন দিনে ইলিশ মাছ আহরণের পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়েছে। গত মাসে একেকটি নৌকা মাত্র ১৫-২০ কেজি ইলিশ মাছ নিয়ে তীরে এসেছিল। গত তিনদিন ধরে একেকটি নৌকা একশ কেজিরও বেশি ইলিশ নিয়ে আসছে। এতে বোঝা যাচ্ছে সাগরে ইলিশের বিচরণ বেড়েছে। মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা নিয়ে নিয়মনীতি মানার কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। আশা করছি, এবার গত বছরের চেয়ে ইলিশ আহরণের পরিমাণ বেশি হবে।

মৎস্যজীবী জাহেদুল ইসলাম জানান, গত সপ্তাহে একেকটি নৌকায় ৭০-১০০ কেজি করে ইলিশ ধরা পড়েছে। দেশে সবচেয়ে বেশি ইলিশ আহরণ হয় চট্টগ্রাম বিভাগের সমুদ্র উপকূলবর্তী জেলাগুলোয়। অবশ্য মাছ ধরার সমুদ্রগ্রামী বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর হিসেব ওঠে চট্টগ্রামের তালিকায়। এর বাইরে পদ্মা-মেঘনার অববাহিকায় ভোলা, খুলনা, বরিশাল ও চাঁদপুর জেলায় প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ে।

মৎস্য অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, গত অর্থবছরে দেশে ইলিশ আহরণের পরিমাণ আগের বছরের চেয়ে কমে গিয়েছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে ইলিশ আহরণ হয়েছিল ৫ লাখ ২৯ হাজার মেট্রিকটন। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে পরিমাণ ছিল ৫ লাখ ৭১ হাজার ৩৪২ টন।

এর আগে ২০২১-২২ সালে ইলিশ আহরণ হয়েছিল ৫ লাখ ৬৬ হাজার ৫৮৩ টন। ২০২০-২১ সালে ৫ লাখ ৬৫ হাজার ১৮৩ টন, ২০১৯-২০ সালে ৫ লাখ ৫০ হাজার ৪২৮ মেট্রিকটন, ২০১৮-১৯ সালে ৫ লাখ ৩২ হাজার ৭৯৫ মেট্রিকটন, ২০১৭-১৮ সালে ৫ লাখ ১৭ হাজার ১৯৮ টন এবং ২০১৬-১৭ সালে ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৪১৭ মেট্রিকটন ইলিশ আহরণ হয়েছিল।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০০৪-০৫ অর্থবছরে ইলিশ আহরণ হয়েছিল ২ লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিকটন। এ হিসেবে গত দেড় যুগে ইলিশের আহরণ দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। এর মধ্যে গত সাত বছরে ইলিশ আহরণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে, শুধু ২০২৩-২৪ অর্থবছর ছাড়া।

কিন্তু এরপরও ইলিশের দাম ক্রেতাসাধারণের নাগালের মধ্যে থাকে না। গত আট বছরের রফতানির চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মোট আহরণের এক শতাংশেরও কম ইলিশ মাছ রফতানি হয়। বাকি ৯৯ শতাংশ ইলিশ মাছ দেশের বাজারেই বিক্রি হয়। এর পরও প্রতিবছর ইলিশের দাম ৩০ থেকে ৩৩ শতাংশ হারে বাড়ছে বলে কৃষি বিপণন অধিদফতরের তথ্যে জানা গেছে।

সংস্থাটির তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আট বছরে ইলিশের দাম গড়ে কেজিতে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা বেড়েছে। আর ১৮ বছরের ব্যবধানে দেশে ইলিশের দাম বেড়েছে প্রায় ১০০ শতাংশ। এ বছরও ভরা মৌসুমে ইলিশের দাম ক্রেতার নাগালের মধ্যে নেই।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজ উল্যাহ বলেন, বাজারে ইলিশ মাছের অতিরিক্ত দাম নেওয়ার অভিযোগ আমরা পেয়েছি। আমরা আগামী সপ্তাহ থেকে আড়তদার, পাইকারি এবং খুচরা বাজারে যাব। কে কত দামে ইলিশ কিনছে আর কত দামে বিক্রি করছে, ক্রয়-বিক্রয়ের ভাউচার আছে কি না এবং ক্রয়মূল্য আর বিক্রয়মূল্যের মধ্যে সামঞ্জস্য আছে কি না, সেটা আমরা তদারক করব।

ঈশান/খম/সুম

আরও পড়ুন

You cannot copy content of this page