
প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রথম মেয়াদ ছিল ২০২১ সালের ডিসেম্বও পর্যন্ত। এরপর নির্ধারণ করা হয় ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। সবাই তখন আশা করেছিল নির্ধারিত ওই সময়ে উদ্বোধন হবে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। কিন্তু এই সময়ে দেখা গেল টানেলের উত্তর প্রান্তের টিউবের কাজ প্রায় ৬ শতাংশ বাকি।
সাথে বাকি আনোয়ারা প্রান্তে এপ্রোচ সড়কের কাজ। এখন এপ্রোচ সড়কের কাজও শেষ। এরপরও চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে এসেও বলা হচ্ছে টানেলের উত্তরপ্রান্তের টিউবের কাজ ৯৯ দশমিক ৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। আর প্রকল্পের সার্বিক কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৯৭ দশমিক ৫ শতাংশ।
এই অবস্থায়ও এই টানেল ঠিক কবে উদ্বোধন সম্ভব হবে তাও সঠিকভাবে বলতে পারছেন না প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শুক্রবার (১৪ জুলাই) বিকেলে প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী হারুন উর রশিদ বলেন, মূল টানেলের ৯৯ দশমিক ৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের নির্মাণকাজের সার্বিক অগ্রগতি ৯৭ দশমিক ৫ শতাংশ।
তিনি বলেন, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের দুটি টিউব বা সুড়ঙ্গের মধ্যে দক্ষিণ টিউবের পূর্তকাজ শেষ হয়েছে ২০২১ সালের জুন মাসে। এই টিউব চট্টগ্রামের আনোয়ারা প্রান্ত থেকে শুরু হয়ে নগরের পতেঙ্গা প্রান্ত পর্যন্ত। বর্তমানে উত্তর টিউবের কাজ চলছে। এর মধ্যে পূর্তকাজ স¤পন্ন হয়েছে। টানেলের বর্তমান অগ্রগতি ৯৯ দশমিক ৫ শতাংশ।
টানেলের যান্ত্রিক, বৈদ্যুতিক ও সিভিল ওয়ার্ক চলছে এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজও শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ক্রস প্যাসেজ ও টানেল স¤পর্কিত টোল প্লাজার নির্মাণকাজও প্রায় শেষ। এখন টানেলের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের কাজ চলছে। কাজ শেষ করতে আরো দুয়েক মাস সময় লাগতে পারে। সে হিসেবে এ বছরের সেপ্টেম্বরে যানবাহন চলাচলের জন্য টানেল খুলে দেওয়া যাবে। তবে তাও নির্ভর করছে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের উপর।
প্রকল্প পরিচালক বলেন, ৩৫ ফুট চওড়া ও ১৬ ফুট উঁচু দুটি টিউব ১১ মিটার ব্যবধানে নির্মাণ করা হয়েছে। যাতে ভারী যানবাহন সহজে টানেলের মধ্যদিয়ে চলাচল করতে পারে। টানেলের দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৩ দশমিক ৪০ কিলোমিটার। এতে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটারের একটি অ্যাপ্রোচ রোড ও একটি ৭৪০ মিটার ব্রিজের পাশাপাশি মূল শহর, বন্দর এবং নদীর পশ্চিম দিককে পূর্ব দিকের সঙ্গে সংযুক্ত করবে।
টানেল প্রকল্পের নথিপত্র অনুযায়ী, টানেল নির্মাণের ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে উঠবে। এতে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার কমিয়ে দেবে। এই টানেল দিয়ে যানবাহন ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার বেগে চলবে।
টানেল চালু হলে শিল্পায়ন, পর্যটনশিল্পের বিকাশ এবং সহজ যোগাযোগব্যবস্থার কারণে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে। ফলে দারিদ্র দূরীকরণসহ দেশের ব্যাপক আর্থসামাজিক উন্নয়ন সাধিত হবে। এ ছাড়া জিডিপিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। টানেলে যানবাহন চলাচলের টোলহারও নির্ধারণ করা হয়েছে।
সেতু কর্তৃপক্ষের উপসচিব মো. আবুল হাসান স্বাক্ষরিত গেজেট অনুযায়ী, টানেলের ভেতর দিয়ে চলতে হলে কার ও জিপকে টোল দিতে হবে ২০০ টাকা। একই হারে টোল দিতে হবে পিকআপকে। আর মাইক্রোবাসকে টোল দিতে হবে ২৫০ টাকা। বাসের ক্ষেত্রে ৩১ আসন বা এর কম আসনের গাড়িকে দিতে হবে ৩০০ টাকা, ৩২ আসন বা এর বেশি বাসগুলোকে পরিশোধ করতে হবে ৪০০ টাকা। বাসের (৩ এক্সেল) জন্য টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০০ টাকা।
এছাড়া ৫ টনের ট্রাকের জন্য ৪০০ টাকা, ৫ থেকে ৮ টনের ট্রাকের জন্য ৫০০ এবং ৮ থেকে ১১ টনের ট্রাকের জন্য ৬০০ টাকা টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। টানেলের ভেতর দিয়ে যেতে হলে ৩ এক্সেলের ট্রাক বা ট্রেইলরকে দিতে হবে ৮০০ টাকা। ৪ এক্সেলের ট্রাক বা ট্রেইলরের জন্য ১০০০ টাকা। ৪ এক্সেলের বেশি হলে প্রতি এক্সেলের জন্য বাড়তি ২০০ টাকা করে দিতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের সম্ভাব্যতা সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, টানেল চালু হওয়ার পর ২০২৫ সালে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে। এছাড়া ২০৩০ সালে যানবাহন চলাচলের প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি এবং ২০৬৭ সালে যানবাহনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রতিদিন গড়ে ১ লাখ ৬২ হাজার।
সূত্রমতে, টানেলের ভেতর দিয়ে ১২ ধরনের যানবাহনের জন্য টোলের হার চূড়ান্ত করা হয়েছে। গত বছরের ২০ ডিসেম্বর টোলের হার প্রস্তাব করেছিল সেতু কর্তৃপক্ষ। প্রস্তাবিত টোলের হারে কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। টানেলের ভেতর দিয়ে মোটরসাইকেল বা দুই চাকার কোনো যান চলাচল করতে পারবে না।
প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার বন্দরনগরীকে চীনের সাংহাই নগরীর মতো ওয়ান সিটি, টু টাউন মডেলে পরিণত করতে দক্ষিণ চট্টগ্রামের পতেঙ্গা ও আনোয়ারা উপজেলাকে সংযুক্ত করতে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে এই টানেল নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি ২০১৫ সালের নভেম্বরে ৮ হাজার ৪৪৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকা ব্যয়ে মাল্টিলেন রোড টানেল প্রকল্পটি অনুমোদন করে। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছিল।
পরবর্তী সময়ে খরচ বাড়িয়ে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা করা হয় এবং প্রকল্পের মেয়াদ ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। সর্বশেষ সংশোধিত বাজেটে, প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এতে ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১৬৪ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ও চীন সরকারের যৌথ অর্থায়নে টানেল প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। চীনের এক্সিম ব্যাংক ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে। বাকি অর্থ দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। চীনের এক্সিম ব্যাংক ২ শতাংশ হারে সুদে এই ঋণ দিয়েছে। চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কো¤পানি লিমিটেড প্রকল্পের ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে।