চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মোহাম্মদ কামরুল হাসানের স্ত্রী সায়মা বেগমের নামে সাগরে রয়েছে পাঁচটি জাহাজ (বার্জ)। যেগুলো নৌপথে মালামাল পরিবহনে ব্যবহৃত হয়।

জাহাজগুলো হচ্ছে-এমভি প্যাসিফিক রাইডার, এমভি পানামা ফরেস্ট-১, এমভি রাইসা তারাননুম, বার্জ আল বাইয়েত। এ পাঁচটি জাহাজের মধ্যে এক তৃতীয়াংশের মালিক সায়মা বেগম। এসব জাহাজে কাগজে-কলমে বিনিয়োগ দেখানো হয়েছে এক কোটি ৫১ লাখ ৩১ হাজার ৩৮০ টাকা। অথচ বাস্তবে এ বিনিয়োগ তিন থেকে চার গুণ বেশি।

আর এসব জাহাজ পরিচালনা করছে সওদাগর নেভিগেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠানের মালিকও সায়মা বেগম। চট্টগ্রাম মহানগরীর আগ্রাবাদের পোর্টল্যান্ড সাত্তার টাওয়ারের চতুর্থ তলায় রয়েছে সওদাগর নেভিগেশনের অফিস।

এসব জাহাজ এডিসি কামরুল হাসান অবৈধভাবে অর্জিত অর্থেই স্ত্রীর নামে কিনেছেন বলে উঠে এসেছে দুদকের প্রতিবেদনে। দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-১-এর সহকারী পরিচালক মো. এমরান হোসেন গত সোমবার ( ৮ জুলাই) প্রতিবেদনটি আদালতে দাখিল করেন।

প্রতিবেদনে এডিসি কামরুল হাসানের নামে ১২ কোটি ৭২ লাখ ৯২ হাজার ৬৯৫ টাকার স্থাবর স¤পদ এবং এক কোটি ২৩ লাখ ৩৯ হাজার ২১৬ টাকার অস্থাবর স¤পদসহ মোট ১৩ কোটি ৯৬ লাখ ৩১ হাজার ৯১১ টাকার স¤পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া পায় দুদকের অনুসন্ধানে। পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয়সহ তার মোট অর্জিত স¤পদের পরিমাণ ১৪ কোটি ৬৬ লাখ ৬০ হাজার ১৫২ টাকা। তার অর্জিত স¤পদের চেয়ে ৯ কোটি ৮৬ লাখ ২৮ হাজার ৬৫ টাকার বৈধ আয়ের উৎস পায়নি দুদক।

আদালতে দুদক কর্মকর্তার জমা দেওয়া তালিকায় এডিসি মোহাম্মদ কামরুল হাসানের নামে রয়েছে নগরীর পাহাড়তলী থানাধীন উত্তর হালিশহর মৌজায় ৪০ শতক জমি। যার মূল্য এক কোটি ২০ লাখ টাকা। পাহাড়তলী থানাধীন উত্তর হালিশহর মৌজায় ৪০ শতক জমি। যার মূল্য এক কোটি ২০ লাখ টাকা। পাহাড়তলী থানাধীন পশ্চিম নাছিরাবাদ মৌজায় ৩.৩৩ শতক জমি। যার মূল্য ৩ লাখ টাকা। পাহাড়তলী থানাধীন পশ্চিম নাছিরাবাদ মৌজায় জমি, যার মূল্য ৮০ হাজার টাকা।

পাহাড়তলী থানাধীন পশ্চিম নাছিরাবাদ মৌজায় জমি, যার মূল্য ৮৫ হাজার টাকা। ঢাকা জেলার সাভার থানা ও পৌরসভার অধীন মৌজা জালেশ্বর ও টাট্টী এলাকার ১০৭ শতাংশ জমির মধ্যে ২৬.৭৫ শতাংশ তার। অর্থাৎ চার জনে মিলে জমিটি কেনেন; যার মূল্য ধরা হয়েছে ৭ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকা। ঢাকায় সাভার সিটি সেন্টার অ্যান্ড সাভার সিটি সেন্টার টাওয়ার নামে ১২ তলা ভবনে রয়েছে তার অংশীদার। কামরুল হাসানসহ চার জন অংশীদার মিলে এ ভবন নির্মাণ করেন। যার মূল্য ৫ কোটি ২ লাখ ৬২ হাজার ২২৯ টাকা।

চট্টগ্রামের খুলশী থানাধীন খুলশী মৌজায় চিটাগং কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিমিটেড লে-আউট প্ল্যানের প্লট নং-১/সি-তে নির্মিত ফয়জুন ভিস্তা নামে অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে .৭৪ শতক ভিটাজমি। ওই অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের অষ্টম তলার (সি-৭) পশ্চিমাংশে সি-টাইপ অ্যাপার্টমেন্টের পরিমাণ ২ হাজার ৫৭০ বর্গফুট এবং নিচতলার আছে ১৩৬ বর্গফুট ¯েপসের গাড়ি পার্কিং; যার মূল্য ধরা হয় ১২ লাখ ১০ হাজার টাকা। পাহাড়তলী থানাধীন পশ্চিম নাছিরাবাদ মৌজার জমির মূল্য ধরা হয় ৪০ লাখ টাকা। পাহাড়তলী থানাধীন পশ্চিম নাছিরাবাদ মৌজায় ১২.৭৫ শতাংশ জমি; মূল্য ধরা হয়েছে ৪৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা। পাহাড়তলী থানাধীন পশ্চিম নাছিরাবাদ মৌজায় ৬.৫৯ শতাংশ জমি; মূল্য ধরা হয়েছে ২৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা। পাহাড়তলী থানাধীন পশ্চিম নাছিরাবাদ মৌজায় চারতলা ভবনসহ সাত শতক জমি, মূল্য ধরা হয়েছে এক কোটি ৭৮ লাখ ৫৮ হাজার টাকা।

ঢাকার সাভার থানাধীন আনন্দপুর মৌজায় রয়েছে ৫.২০ শতাংশ জমি; যার মূল্য ধরা হয়েছে ১৭ লাখ ৪৬ হাজার ২৫০ টাকা। সাভারের সাভার সিটি টাওয়ার নামে ১০ তলা ভবনটি করা হয় ২৬ শতক জমির ওপর। কামরুল হাসানসহ তিন জনের মালিকানাধীন এ ভবন। যার মূল্য ৬৯ লাখ ৫৪ হাজার ৪৪০ টাকা। চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানাধীন চান্দগাঁও মৌজায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বাস্তবায়নাধীন অনন্যা আবাসিক এলাকায় ৩ হাজার ৫৯৮.৫৬ বর্গফুট আয়তনের এ-২৫৯নং প্লট; যার মূল্য দেখানো হয় ৩১ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ টাকা।

অস্থাবর স¤পদের মধ্যে কামরুল হাসানের আছে সোনালী ব্যাংক লিমিটেড চট্টগ্রাম ওয়েজ আনার্স করপোরেট শাখায় আছে তিন মাস অন্তর মুনাফা ভিত্তিক ১৫ লাখ টাকা করে মোট ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র।

এছাড়া স্ত্রী সায়মা বেগমের নামে এক কোটি ২৫ লাখ টাকার স্থাবর স¤পদ এবং এক কোটি ৯৯ লাখ ২৮ হাজার ২৪০ টাকার অস্থাবর স¤পদসহ মোট ২ কোটি ৫৩ লাখ ২৪০ টাকার স¤পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া যায়। তার পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয়সহ মোট অর্জিত স¤পদের পরিমাণ ২ কোটি ২ লাখ ৯৯ হাজার ৬২১ টাকা। এই স¤পদ অর্জনের বিপরীতে তার বৈধ ও গ্রহণযোগ্য আয়ের উৎস পাওয়া যায় ৪০ লাখ ১৪ হাজার ৪৩৩ টাকা।

সায়মা বেগমের স্থাবর স¤পদের মধ্যে আছে, নগরীর পাহাড়তলী থানাধীন উত্তর হালিশহর মৌজায় ৪০ শতক জমি। যার মূল্য দেখানো হয়েছে এক কোটি ২৫ হাজার টাকা। সায়মার নামে অস্থাবর স¤পত্তির মধ্যে আছে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঁচ বছর মেয়াদি ৪৫ লাখ টাকার পরিবার সঞ্চয়পত্র। এ ক্ষেত্রে তার অর্জিত স¤পদের চেয়ে এক কোটি ৬২ লাখ ৮৫ হাজার ১৮৮ টাকার বৈধ কোনও উৎস পায়নি দুদক।

দুদক কর্মকর্তার প্রাথমিক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, মোহাম্মদ কামরুল হাসান ও তার স্ত্রী সায়মা বেগমের জ্ঞাত আয় বর্হিভূত স¤পদের পরিমাণ ১১ কোটি ৪ লাখ ৩৫ হাজার ৯১৯ টাকা। এসব টাকা কামরুল হাসান পুলিশের দায়িত্ব পালনকালে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করেছেন। জ্ঞাত আয় বর্হিভূত অর্জিত এসব স¤পদ ক্রোকের আদেশ দিয়েছেন চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ বেগম জেবুন্নেছা।

সোমবার (৮ জুলাই) দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-১-এর সহকারী পরিচালক মো. এমরান হোসেনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এ আদেশ দেন বলে জানান দুদকের পিপি কাজী ছানোয়ার আহমেদ লাভলু।

তিনি বলেন, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মোহাম্মদ কামরুল হাসান ও তার স্ত্রী সায়মা বেগমের নামে দুদক প্রাথমিক অনুসন্ধানে জ্ঞাত আয়ের বাইরে ১১ কোটি ৪ লাখ ৩৫ হাজার ৯১৯ টাকার স¤পদ অর্জনের তথ্য পেয়েছে। কোনও ধরনের বৈধ আয়ের উৎস ছাড়াই সায়মা বেগম কয়েক কোটি টাকা দামের পাঁচটি জাহাজের মালিক বনে যাওয়াকে অবিশ্বাস্য বলছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এসব স¤পদ ক্রোক ও জব্দ করা না গেলে তা হস্তান্তর হয়ে যেতে পারে। পরে রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা সম্ভব হবে না।

দুদক কর্মকর্তা মো. এমরান হোসেনের আদালতে করা আবেদনে বলা হয়, প্রাথমিক অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিলের পর থেকে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তাদের নামে অসাধু উপায়ে অর্জিত অপরাধলব্ধ স¤পদ হস্তান্তর বা বিক্রি করার চেষ্টা করছেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়। অপরাধলব্ধ আয়ের মাধ্যমে অর্জিত স¤পদ বা স¤পত্তির বিষয়ে দ্রুত কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে তা বেহাত হয়ে রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা ২০০৭ (সংশোধনী ২০১৯)-এর বিধি ১৮ মোতাবেক বর্ণিত স্থাবর ও অস্থাবর স¤পত্তি ক্রোক বা অবরুদ্ধ করা একান্ত প্রয়োজন।

এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত তাদের নামে থাকা বিভিন্ন স¤পত্তির দলিল, ফ্ল্যাট ও কো¤পানির আংশিক শেয়ারসহ স্থাবর ও অস্থাবর স¤পত্তি ক্রোক এবং অবরোধের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এখন থেকে এসব স¤পত্তি দুদক দেখভাল করবে। পরবর্তীতে এসব স¤পত্তি তদারকির জন্য রিসিভার নিয়োগের আবেদন করা হবে।

কামরুল হাসান বর্তমানে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট (ডিওএম) বিভাগে অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) হিসেবে কর্মরত আছেন। এর আগে তিনি মেট্রো কোর্টে সিএমপির এডিসি (প্রসিকিউশন) এবং এডিসি (ক্রাইম) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

কামরুল হাসান ১৯৮৯ সালে উপপরিদর্শক (এসআই) পদে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করেন। তিনি নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানাধীন মীরওয়ারিশপুর এলাকার মৃত মোহাম্মদ গোলাম কবিরের ছেলে। থাকেন চট্টগ্রাম নগরীর পশ্চিম নাসিরাবাদ এলাকায়।

ঈশান/খম/সুম