চোখে ছিল উন্নয়নের স্বপ্ন, হাতে ছিল হাজার কোটি টাকার বাজেট, কাঁধে ছিল গ্রামীণ জীবনের হৃৎস্পন্দনে নতুন প্রাণের ছোঁয়া আনার দায়িত্ব। কিন্তু বাস্তবতা বড়ই করুণ। দুই হাজার ১৮০ কোটি টাকার যে প্রকল্প নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি), সেটি এখন অদক্ষতা আর অব্যবস্থাপনার এক বিষাদে গাঁথা।
৫৭ মাসের সেই প্রকল্প ৫৩ মাসে এসে কেবল ২৭ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। খরচ হয়েছে মাত্র ৬০১ কোটি টাকা। আর সেখানেই প্রায় এক চতুর্থাংশ বা দেড়শ কোটি টাকা লুটের অভিযোগ ওঠেছে! আর্থিক ও কাঠামোগত এই স্থবিরতা নিয়ে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছে সরকারের তদারকি সংস্থা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালে ‘ওয়েস্টার্ন ইকোনমিক করিডোর অ্যান্ড রিজিওনাল এনহ্যান্সমেন্ট প্রোগ্রাম (উইকেয়ার) ফেজ-১: রুরাল কানেক্টিভিটি, মার্কেট অ্যান্ড লজিস্টিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইমপ্রুভমেন্ট’ শীর্ষক প্রকল্পটি হাতে নেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। লক্ষ্য ছিল যশোর, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহ জেলার ১৮টি উপজেলায় গ্রামীণ যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, ৬১১ কিলোমিটার সড়ক আপগ্রেড এবং ৩২টি গ্রামীণ বাজার আধুনিকায়ন।
এই প্রকল্পের মূলে ছিল অর্থনৈতিক করিডোরে প্রবেশাধিকার বাড়িয়ে কৃষির উৎপাদনশীলতা ও বাজার সংযোগ বৃদ্ধি করে স্থানীয় অর্থনীতিকে টেনে তোলা। বিশ্বব্যাংক ও সরকারের অর্থায়নে শুরু হওয়া প্রকল্পের মেয়াদ জুন ২০২৫ পর্যন্ত নির্ধারিত হলেও বাস্তবতা বলছে, তার অনেক আগেই ব্যর্থতার গ্লানিতে ঢাকা পড়েছে সেই স্বপ্ন।
আইএমইডির নিবিড় তদারকি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, একদিকে প্রকল্পের কাজ প্রায় নেই বললেই চলে, অন্যদিকে জমি অধিগ্রহণ পর্যন্তও শেষ করা হয়নি। যেখানে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) ভূমি অধিগ্রহণে ৩৩৫ কোটি টাকা সংরক্ষিত রয়েছে। এমনকি প্রকল্পের মেয়াদ শেষের পথে থাকলেও ১৯টি প্যাকেজের একটিও এখনো সম্পন্ন হয়নি।
শুধু বাস্তবায়নের ধীরগতি নয়, আর্থিক ব্যবস্থাপনাতেও নজিরবিহীন অনিয়ম ধরা পড়েছে। যে কাজ হয়েছে সেখানেও নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয়নি। ২০২০-২০২১ অর্থবছর থেকে শুরু করে ২০২৩-২০২৪ পর্যন্ত সময়কালে মোট ১৮টি অডিট আপত্তি উত্থাপিত হয়েছে। যার বেশির ভাগই এখনো নিষ্পত্তিহীন। এসব আপত্তির মোট আর্থিক পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই তথ্য।
প্রকল্পের নিরীক্ষা প্রতিবেদনের বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে তিনটি আপত্তি উত্থাপিত হয়, যার মধ্যে একটি নিষ্পত্তি হয়েছে। বাকি দুটি আপত্তির আর্থিক পরিমাণ ৬ লাখ ৪৬ হাজার ২১০ টাকা। যা এখনো অনিষ্পন্ন। পরের বছর অর্থাৎ ২০২১-২০২২ অর্থবছরেও তিনটি অডিট আপত্তি ওঠে। এর মধ্যে একটি নিষ্পত্তি হলেও বাকি দুটির মধ্যে রয়েছে ৬১ লাখ ১৫ হাজার ৪৯৩ টাকা ১৬ পয়সার অনিষ্পন্ন অর্থ।
সবচেয়ে বেশি আপত্তি এবং আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠে এসেছে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে। এ বছরে ৬টি আপত্তি উত্থাপিত হয়, যার সবকটির জবাব দেওয়া হলেও নিরীক্ষকের পর্যবেক্ষণে তা অপর্যাপ্ত বলে বিবেচিত হয়েছে। এসব আপত্তির মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩৩ কোটি ২৩ লাখ ৮৫ হাজার ৭৮২ টাকা, যা এখনো নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
সবশেষ ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরেও ৬টি নতুন আপত্তি উত্থাপিত হয়েছে। একটির জবাব জমা দেওয়া হলেও তা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি, বাকি ৫টির জবাব প্রক্রিয়াধীন। এই বছরের অনিষ্পন্ন আপত্তিকৃত অর্থের পরিমাণ ৮ কোটি ৯৬ লাখ ৪৪ হাজার ১৭১ টাকা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অডিট আপত্তির জবাব যথাযথ না হওয়া প্রকল্প পরিচালনায় দায়িত্বশীলতার ঘাটতির প্রমাণ বহন করে। পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদে এইসব অনিয়ম সরকারকে আর্থিক ক্ষতির মুখে ফেলেছে।
এই সংকটে এলজিইডির যুক্তি, কোভিড-১৯, প্রকল্প অনুমোদনে বিলম্ব, ঠিকাদার নিয়োগে গড়িমসি, চুক্তির অসম্পূর্ণতা ও ভূমি অধিগ্রহণ না হওয়াকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। এমনকি তারা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নির্মাণ সামগ্রীর দামের ঊর্ধ্বগতি এই প্রকল্পের বাস্তবায়নকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।
তবে দায় এড়ানো সহজ হলেও প্রকল্পের ব্যর্থতা বাস্তব। কৃষকের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো তো দূরের কথা, সড়ক নিরাপত্তা বা বাজার ব্যবস্থার উন্নয়নেও পড়েনি কোনো দৃশ্যমান ছোঁয়া।
ক্রয় পরিকল্পনায় একই প্যাকেজে সড়ক, ব্রিজ, কালভার্ট ও মার্কেট একত্রে অন্তর্ভুক্ত করার মতো জটিলতাও প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দরপত্র মূল্যায়ন ও অনুমোদনে দীর্ঘসূত্রতা, প্যাকেজওয়াইজ ব্যয় ও দাফতরিক প্রাক্কলিত ব্যয়ের ব্যবধান প্রকল্পের দুর্বল পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন কাঠামোর নগ্ন চিত্র হিসেবেই উঠে এসেছে আইএমইডির পর্যবেক্ষণে।
প্রশ্ন উঠেছে উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের এই করুণ চিত্রে দায় কার? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি প্রকল্পের ব্যর্থতা কেবল একটি জেলার ক্ষতি নয়, তা পুরো দেশের উন্নয়ন দর্শনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। প্রয়োজন পরিকল্পনার স্বচ্ছতা, বাস্তবায়নের দক্ষতা এবং দুর্নীতিমুক্ত আর্থিক ব্যবস্থাপনা। আর পাঁচ বছরেও যেখানে প্রকল্পের আলো জ্বলেনি, সেখানে দেশের মানুষের চোখে উন্নয়নের প্রদীপ নিভে যাওয়া খুব কি অস্বাভাবিক? তার প্রতিফলনও জাতি দেখতে পাচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অদক্ষতা আর গাফিলতির এই করাল ছায়া থেকে বেরিয়ে না এলে কোটি কোটি টাকার প্রকল্প কেবল হয়ে থাকবে কাগুজে উন্নয়নের অন্তঃসারশূন্য প্রতিশ্রুতি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ‘আমাদের দেশে প্রকল্প নেওয়া ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানা ভুল ও অনিয়মের চিত্র স্বাভাবিকতায় রূপ নিয়েছে। প্রকল্প পরিকল্পনায় ভুল হলে বাস্তবায়নেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে- এটা তো স্বাভাবিক। কিন্তু এটিকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করিয়ে অনিয়মের প্রবণতাও রয়েছে। সবশেষে রাষ্ট্র এখানে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জায়গা শক্তিশালী না হলে এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইএমইডির সচিব মো. কামাল উদ্দিন দৈনিক ঈশানকে বলেন, ‘যেসব প্রকল্পে অগ্রগতি খুবই কম, সেগুলোর তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। প্রয়োজনে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে।
You cannot copy content of this page