
# অনুষ্ঠান করতে দিতে হবে প্রতি ঘন্টায় ১৭৫০ টাকা
# নিতে হবে অনুমতি, আবেদন করতে লাগবে ৫০০ টাকা
# সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিক্রিয়া
চট্টগ্রাম মহানগরে কমিউনিটি সেন্টার ও কনভেনশন হলের ভাড়া নৈরাজ্যের খড়গ এবার জুড়ে বসছে শান্ত, সবুজ-প্রকৃতির উন্মুক্ত স্থান সিআরবির শিরীষতলায়। যেখানে এখন যে কোন অনুষ্ঠান আয়োজনে গুণতে হবে ঘন্টাপ্রতি ভাড়া।
সিআরবির প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় এবং শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি রেলওয়ের আয় বাড়াতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। তবে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠছেন নগরীর বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও দাতব্য সংস্থাগুলো। সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন সংগঠনের নেতারা।
সংগঠনের নেতাদের ভাষ্য, বর্তমানে আধুনিক ও শহুরে জীবনে মেজবান, বিয়ে-শাদিসহ যেকোনো সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানের জন্য কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া, খাবার সরবরাহ, সাজসজ্জার নামে ইভেন্ট ম্যানেজম্যান্টের অন্তরালে চরম নৈরাজ্য চলছে চট্টগ্রাম জুড়ে। হিন্দু ধর্মালম্বীদের লগ্ন ধরে এসব নৈরাজ্যের মাত্রা আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
কিছু কিছু অত্যাধুনিক কমিউনিটি সেন্টার নামের কনভেনশন হলে চলে খাবার সরবরাহের নামে প্লেট প্রতি গলাকাটা বিল আদায়ের প্রতিযোগিতা। বছরের পর বছর কমিউনিটি সেন্টার ও কনভেনশন হল ভাড়া নিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের ইচ্ছে মাফিক অবৈধ ব্যবসা চলে আসছে। যেখানে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানের চোখ তুলে তাকানোর সুযোগ নেই।
এ অবস্থায় রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মালিকানাধীন সিআরবির শিরীষতলায় অনুষ্ঠান আয়োজনে এতোদিন কেবল অনুমতি নিলেই হতো। কোনো ভাড়া পরিশোধ করতে হতো না। ফলে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনকারীদের প্রথম পছন্দে পরিণত হয়েছে সিআরবির শিরীষতলা।
এরইমধ্যে ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং বিনামূল্যে উন্মুক্ত ও ছায়াঘেরা বড় জায়গা ব্যবহারের সুযোগ থাকায় সিআরবিতে অনুষ্ঠানের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। এ সুযোগে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ কমিউিনিটি সেন্টারের ভাড়ার খড়গ জুড়ে দিয়েছে এই শিরীষতলায়। যা দেশ ও জাতির সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য বড় বাধা। যা কোনভাবেই কাম্য নয়।
ঘন্টায় ১৭৫০ টাকা ভাড়া নির্ধারণ:
রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, সিআরবির শিরীষতলা মাঠের আয়তন ৬২ হাজার ৬১৭ বর্গফুট। এই মাঠের ভাড়া প্রতিঘণ্টায় ১ হাজার ৭৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া প্রতিদিনের ভাড়া ৪২ হাজার, প্রতিমাসের ভাড়া ১২ লাখ ৫২ হাজার ৩৪০ এবং বাৎসরিক ভাড়া ১ কোটি ৫০ লাখ ২৮ হাজার ৮০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর সঙ্গে ১৫ শতাংশ ভ্যাট যোগ হবে।
সম্প্রতি রেলভূমি বরাদ্দ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে সিআরবিতে অনুষ্ঠান আয়োজনকারীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায়ের এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এরই প্রেক্ষিতে বাণিজ্যিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ সব ধরনের অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রতি বর্গফুট জায়গা অনুসারে ঘণ্টাপ্রতি ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। অনুষ্ঠান আয়োজনে অনুমতির আবেদনের সঙ্গে এই ভাড়া আদায়ের সিদ্ধান্ত হয়।
সিআরবিতে অনুষ্ঠান অয়োজনের অনুমতি সংক্রান্ত বিষয়গুলো তদারকি করছে রেলওয়ের সিনিয়র ওয়েলফেয়ার অফিসারের কার্যালয়। এই কার্যালয়ের ওয়েলফেয়ার ইন্সপেক্টর মাহবুবুর রহমান বলেন, রেলভূমি বরাদ্দ কমিটির সুপারিশ রেলওয়ের ডিজির দপ্তর থেকে অনুমোদনের পর চলতি মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে সিআরবিতে অনুষ্ঠান আয়োজনের ক্ষেত্রে ভাড়া আদায় শুরু হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, অনুষ্ঠান আয়োজনের ক্ষেত্রে আগের মতোই সোনালী ব্যাংকের নির্দিষ্ট একাউন্টে ৫০০ টাকা জমা দিয়ে একটি আবেদনপত্র সংগ্রহ করতে হবে। এরপর নির্ধারিত ভাড়া সোনালী ব্যাংকের নির্দিষ্ট একাউন্টে জমা দিয়ে রিসিভ কপি আবেদনপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হবে। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপকের দপ্তর সবকিছু যাচাই-বাছাই শেষে অনুমতি দেবেন।
সিআরবির প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় এই সিদ্ধান্ত:
রেলভূমি বরাদ্দ কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, গত কয়েক বছরে সিআরবিতে অনুষ্ঠানের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। এসব অনুষ্ঠানের শব্দদূষণ ও জনসমাগমের কারণে সিআরবির প্রাণ-প্রকৃতি হুমকির মুখে পড়েছে। ভাড়া আদায়ের সিদ্ধান্ত গণহারে অনুষ্ঠান আয়োজনে নিরুৎসাহিত করার একটি পদক্ষেপ।
তিনি আরও বলেন, শুধু অনুষ্ঠান থেকে ভাড়া আদায় নয়- সিআরবি এলাকায় বসা ফুড কোর্ট গুলোকেও আমরা নিয়মের মধ্যে এনেছি। তাদের কাছ থেকেও বাৎসরিক ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এতে সিআরবি এলাকায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি রেলওয়ের আয় বাড়বে বলে আমরা আশা করছি।
সামাজিক সংগঠনগুলোর প্রতিবাদ:
সিআরবিতে অনুষ্ঠান আয়োজনে ভাড়া আদায়ের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে মাঠে নেমেছে চট্টগ্রাম নগরে কাজ করা সামাজিক সংগঠনগুলোর এলায়েন্স-সোশ্যাল অর্গানাইজেশন ফোরাম। ভাড়া আদায়ের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে গত বুধবার রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক বরাবর স্মারকলিপি প্রদান ও সিআরবিতে মানববন্ধনও করেছে সংগঠনটি।
সোশ্যাল অর্গানাইজেশন ফোরামের প্রধান সমন্বয়ক বায়েজিদ সুমন জানান, রেলওয়ের এই সিদ্ধান্ত গণবিরোধী। আমরা সামাজিক অনুষ্ঠান করি। ভাড়া বাবদ যদি বড় অঙ্কের টাকা খরচ হয়, তাহলে মানুষের জন্য কাজ করবো কীভাবে। অবিলম্বে সামাজিক ও দাতব্য অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে ভাড়া আদায়ের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে। অন্যথায় আমরা আন্দোলনে যাবো।
চট্টগ্রামের মানুষ কষ্ট পাবে:
সিআরবিতে রেলওয়ের ধার্য করা ভাড়া যৌক্তিক নয় বলে মনে করছেন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার। তিনি বলেন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের জন্য ডিসি হিলের দুয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সিআরবি খুলে দেওয়ায় চট্টগ্রামের মানুষ রেলওয়ের প্রতি কৃতজ্ঞ। তবে এখন তারা যে হারে এখানে ভাড়া বসিয়েছে তা অযৌক্তিক। এতে চট্টগ্রামের মানুষ কষ্ট পাবে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য সিআরবির ভাড়া দৈনিক ১ হাজার টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়।
ক্যাব ও নাগরিক অধিকার সংগ্রাম কমিটির উদ্বেগ:
সিআরবির শিরীষতলায় ভাড়া আদায়ের সিদ্ধান্তে উদ্বেগ জানিয়ে গণমাধ্যমে বিবৃতি প্রেরণ করেছে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগ ও নগর কমিটির নেতৃবৃন্দ। বিবৃতিতে বলা হয়, চট্টগ্রাম নগরীতে কমপক্ষে ৩০০ অতিথির বিয়ে কিংবা গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানের জন্য দৈনিক লাখ টাকার (বড় আয়োজনের জন্য ৫-৭ লাখ টাকা) নিচে কোনো কমিউনিটি সেন্টারের ভাড়া নেই। শিরীষতলায় অনুষ্ঠান আয়োজনে তার চেয়েও কম ভাড়া নির্ধারণ করেনি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। আর শিরীষতলায় যারা অনুষ্ঠান আয়োজন করে তার সবই দাতব্য ও স্বেচ্ছাসেবি সংস্থা। যা দেশের জাতীয় স্বার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট। এসব বিবেচনা করে এই ভাড়া আদায় বাতিল করা দরকার বলে মনে করছেন তারা।
বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন ক্যাব কেন্দ্রিয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন, ক্যাব বিভাগীয় সাধারন স¤পাদক কাজী ইকবাল বাহার ছাবেরী, ক্যাব চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি জেসমিন সুলতানা পারু, সাধারন স¤পাদক অজয় মিত্র শংকু, যুগ্ন স¤পাদক মো. সেলিম জাহাঙ্গীর, দক্ষিন জেলা সভাপতি আলহাজ্ব আবুদল মান্নান, যুব ক্যাব চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি আবু হানিফ নোমান, পলিসি ইনফ্লেুয়েন্স গ্রুপ চট্টগ্রামের সভাপতি কলামিস্ট মুসা খান, সদস্য সচিব আবু মোশারফ রাসেল ও যুগ্ন সদস্য সচিব সাঈদুর রহমান মিন্টু প্রমুখ।
এদিকে এ নিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন চট্টগ্রাম নাগরিক অধিকার সংগ্রাম কমিটির সাধারণ স¤পাদক লায়ন এম এ হোসেন বাদল ও যুগ্ম সাধারণ স¤পাদক স ম জিয়াউর রহমানও। তারা বিবৃতিতে বলেন, চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে কমিউনিটি সেন্টার ও কনভেনশন হলের ভাড়া নৈরাজ্য, যেন এটা দেখার কেউ নেই। এ অসহনীয় ও অকল্পনীয় ভাড়া নৈরাজ্যের কারণে সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব এবং সাধারণ মানুষ হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত। এখন শিরীষতলা নিয়ে একই নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এটা চট্টগ্রামের সত্তার প্রতি চপেটাঘাত। তারা অবিলম্বে এ নৈরাজ্য বন্ধের দাবি জানান।