রবিবার- ২০ এপ্রিল, ২০২৫

কলকাতায় পাচার হওয়া বোনকে নিতে এসে বিপাকে চট্টগ্রামের তরুণ

কলকাতায় পাচার হওয়া বোনকে নিতে এসে বিপাকে চট্টগ্রামের তরুণ

ভারতের কলকতায় পাচার হওয়া ষোল বছর বয়সি ছোট বোনকে ফেরত আনতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার তরুণ আশরাফ হোসেন রুবেল। গত ১০ দিন ধরে অবিরাম ছুটাছুটি করলেও বোনকে নিয়ে ফেরার অনুমতি এখনো মেলেনি তার।

কলকাতা থেকে সোমবার (২৯ এপ্রিল) বিকেলে মুঠোফোনের হুয়াটসঅ্যাপে এ তথ্য জানান রুবেল (২১)। তিনি বলেন, আমি গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। কলকাতা থেকে বোনের ফোন পেয়ে বন্ধু ও আত্নীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধার-কর্জ করে কিছু টাকা নিয়ে গত ২০ এপ্রিল কলকাতায় আসি। সেই টাকা এখন শেষ।

কিন্তু বোনকে ফেরানোর কোন ব্যবস্থা এখনো হয়নি। বোন এখন কলকাতার একটি আশ্রয়কেন্দ্রে আছে। ফেরার খরচের টাকা তো দুরের কথা আমার এখন খাওয়া-দাওয়া বা থাকার টাকাও হাতে নেই। এখন আমি কী করব বুঝতে পারছি না।

তিনি বলেন, কলকাতায় এর আগে আমি কখনো আসিনি। জীবনের প্রথম আসলাম। এখানে কোন জায়গা ও কাউকে চিনি না। কোন আত্নীয়-স্বজনও নেই। কলকাতার স্থানীয় অনেকের কাছে সাহায্য চাইলেও কেউ সাহায্য করেনি। ফলে চোখে আমি এখন অন্ধকার দেখছি।

চট্টগ্রামের ওই তরুণ বলেন, আমার ছোট বোন নবম শ্রেণির ছাত্রী। সে বাড়ি থেকে গত বছরের ৩ ডিসেম্বর পালিয়েছিল। কিছু লোক তাকে টোপ দিয়েছিল তার পছন্দের হিরোর সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবে। তাদের কথায় বিশ্বাস করে সে চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনে চেপে বসে। অথচ সে তার আগে ঢাকা তো দূরস্থান চট্টগ্রাম শহরেও কোনো দিন যায়নি।

এই তরুণের ভাষ্য, ট্রেনে ওঠার কিছুক্ষণ পরেই সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। যখন তার জ্ঞান ফেরে সে দেখে স¤পূর্ণ অচেনা এক জায়গায় তাকে কয়েকজন বাসে করে নিয়ে যাচ্ছে। আশপাশের লোকের কথাবার্তা শুনে সে বুঝতে পারে এরা বাঙালি হলেও জায়গাটা বাংলাদেশ নয়! বিপদ বুঝে সে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করে ওঠে।

বলে, আমাকে এরা ধরে নিয়ে যাচ্ছে! সঙ্গে সঙ্গে বাসের অন্য যাত্রীরা হস্তক্ষেপ করেন। তাদের সাহায্যেই শেষ পর্যন্ত আমার বোন উদ্ধার হয়। মোট পাঁচ পাচারকারী বোনকে নিয়ে যাচ্ছিল, তাদের মধ্যে তিন জন পালিয়ে গেলেও বাকি দু‘জনকে ধরে যাত্রীরা পুলিশের হাতে তুলে দেয়।

ঘটনাটি ঘটেছিল গত বছরের ৬ ডিসেম্বর। অর্থাৎ বাড়ি থেকে নিখোঁজ হওয়ার ঠিক তিন দিন পর। যে জায়গায় ঘটনাটি ঘটে, সেটি কলকাতার কাছেই বেলুড়ের। স্থানীয় হাওড়া জেলার পুলিশ বিষয়টি তদারকি করছে, পাচারের মামলাও দায়ের করা হয়েছে। সেইসঙ্গে আমার বোনকে রাখার ব্যবস্থা করা হয় লিলুয়া নামক এক স্থানে সরকারি হোম বা আশ্রয়কেন্দ্রে। গত কয়েক মাস ধরে ওই হোমই তার ঠিকানা। সেখানে দেখা করার পর ঘটনার এই আদ্যোপান্ত জানায় আমার বোন।

এর আগে কলকাতা থেকে আমরা বোনের ফোন পায় গত ৮ ডিসেম্বর। কান্নাকাটির পর বোনকে ফিরিয়ে আনার আকুতি জানায়। এরপর কলকাতা যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। অনেক ঝক্কিঝামেলা সামলে, আত্নীয়-বন্ধুদের কাছ থেকে টাকা ধার করে অবশেষে কলকাতা এসে পৌঁছায় গত শনিবার (২০ এপ্রিল) রাতে।

কলকাতায় পৌঁছে প্রথমে যায় শিয়ালদহ স্টেশনের রেল পুলিশের থানায়। যে স্টেশন দিয়ে বোনকে পাচার করা হয়েছিল। সেখানে কর্তৃপক্ষ তাকে যোগাযোগ করিয়ে দেন শক্তিবাহিনী নামে একটি এনজিও-র সঙ্গে। যারা পাচারের ভিক্টিম নারীদের পুনর্বাসন ও প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ করেন। শক্তিবাহিনীর কর্মীরাই তাকে নিয়ে যান লিলুয়ার সেই হোমে, যেখানে এখন বোন রয়েছে।

হোমের সুপার প্রথমে বোনের সঙ্গে আমার দেখা করিয়ে দিতে রাজি হননি। কারণ সরকারি নিয়ম অনুসারে বাবা-মা ছাড়া কেউ হোমের আশ্রিতাদের সঙ্গে দেখা করতে পারেন না। পরে শক্তিবাহিনীর কর্মীদের হস্তক্ষেপে ও আমার কাকুতি-মিনতিতে তারা কয়েক মিনিটের জন্য অনুমতি দেন।

এনজিও শক্তিবাহিনী-র আইনজীবী গার্গী সরকার জানিয়েছেন, কেসটি নিয়ে তারা কলকাতায় বাংলাদেশ উপদূতাবাসে যোগাযোগ করেছেন গত মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল)। এনজিও-র বন্ধুদের সহায়তায় ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সচিবালয় নবান্ন এবং কলকাতায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দফতরেও যোগাযোগ করেছেন রুবেল।

উভয় বিভাগের কাছেই তার কাতর আবেদন ছিল, দয়া করে বিষয়টি দ্রুত হস্তক্ষেপ করে দিন, যাতে বোনকে নিয়ে সে দেশে ফিরতে পারে। আমরাও বিষয়টি যাতে দ্রুত সম্ভব নি®পত্তি করা যায় সেই চেষ্টাই করছি।

শক্তিবাহিনী এনজিও-র মুখপাত্র কৃষ্ণা সরকার বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাচার হওয়া নারী উদ্ধার হলেও তারা জানেনই না আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তাদের কী কী অধিকার প্রাপ্য। আইনি সহায়তাও তারা পান না অনেক সময়ই। তবে এ ক্ষেত্রে যাতে প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করে তাকে ঘরে ফেরানো যায়, আমরা সে চেষ্টাই করছি। সব ছাড়পত্র যদি মেলেও, তারপরও আর একটা সমস্যা হলো ভাই যে বোনকে নিয়ে দেশে ফিরবেন, সেই দুটো টিকিট কাটার পয়সাও তার হতে নেই! তবে আগে আমরা ওর দেশে ফেরার জন্য সব নথিপত্র হাতে পাওয়ার অপেক্ষায় আছি। এরপর দেখা যাবে কী ব্যবস্থা করা যায়।

এনজিও সংস্থার তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাচার হওয়া এমন শত শত নারী আছে। যাদের কাহিনী প্রায় একই। তবু অনেকের চেয়ে এই কিশোরিকে ভাগ্যবান বলতে হবে। কারণ তাকে ভারতের মেট্রো শহরের কোনও যৌনপল্লীতে বা ম্যাসাজ পার্লারে গিয়ে ঠেকতে হয়নি, ঠিক সময়ে অ্যালার্ম রেইজ করতে পারায় করুণ পরিণতির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে সে।

আর এসব গল্পের টুইস্ট এখানেই শেষ নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় পাচার হওয়া নারীদের উদ্ধার করার পর যখন তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় তখন তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে পরিবারের সদস্যদের দিক থেকেই একটা তীব্র অনীহা কাজ করে।

তারা মনে করেন, একবার পাচার হওয়া নারীকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিলে তাদের সামাজিক মানসম্মান ধুলোয় মিশে যাবে। তার চেয়ে বাড়ির মেয়ে বরং দূরেই থাকুক, পরিবারের বাকিরা অন্তত নিজেদের এলাকায় মাথা উঁচু রেখে বাঁচার চেষ্টা করুক! তবে চট্টগ্রামের এই মেয়ের পরিবার কিন্তু ব্যতিক্রম।

কলকাতার শহরতলীতে উদ্ধার হওয়ার পর যখন সে বাংলাদেশে নিজের বাড়ির ঠিকানা ও ফোন নম্বর জানায়। সে অনুযায়ী তাদের সঙ্গে যোগাযোগও করা হয়। তার পরিবারও সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দেয়। কীভাবে বাড়ির মেয়েকে কলকাতা থেকে ফিরিয়ে আনা যায়। গরিব ওই পরিবারটি সেই চেষ্টাও শুরু করে। প্রায় মাস চারেকের চেষ্টার পর কিছু টাকাপয়সা জোগাড় করে, মালিকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে ভারতের ভিসা প্রক্রিয়া স¤পন্ন করেন ভাই রুবেল। তার বয়সও মাত্র ২১ বছর।

অল্পবয়সী এই ছেলেটিই বোনকে বিদেশ থেকে ফেরানোর কঠিন দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে কলকাতায় চলে এসেছেন নয়দিন আগে। আর্থিক সম্বলও একেবারেই নেই, তার ওপর ভারত ও বাংলাদেশ, দুই দেশের সরকারের কারও কাছ থেকেই এখনও অনুমতি না-মেলায় বোনকে নিয়ে তার দেশে ফেরাও এখন অনিশ্চিত।

ফেরার প্রক্রিয়া :
ভারতের সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র উদ্ধার হওয়া নারীর সব কাগজপত্র (পুলিশ রিপোর্ট, কোথায় উদ্ধার হয়েছেন, কী ঠিকানা দিয়েছেন) দিল্লিতে ভারতের স্বরাষ্ট্র আর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে থাকে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তখন সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশ মিশনে যোগাযোগ করে।

বাংলাদেশ দূতাবাসের দায়িত্ব হল ওই ঠিকানা যাচাই করে জানানো, ওই মেয়েটি সত্যিই ওই অঞ্চলের বাসিন্দা এবং বাংলাদেশের নাগরিক কি না। এভাবে দুই দেশের সরকারের কাছ থেকে সবুজ সংকেত পাওয়ার পরই তাকে দেশে ফেরানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বা এনজিও এই পুরো প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকে ও ভিক্টিমদের সাহায্য করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই মেয়েটির ক্ষেত্রে এখনও দুই দেশের সরকারের কাছ থেকে সেই ছাড়পত্র আসেনি। ফলে তার বড় ভাই কলকাতায় এসে পড়েছেন নিদারুণ এক অসহায় অবস্থায়। শহরের সরকারি দফতরে আর বাংলাদেশ উপদূতাবাসে দৌড়োদৌড়ি করেই দিন কাটছে তার!।

ঈশান/খম/সুম

আরও পড়ুন

No more posts to show

You cannot copy content of this page