# গন্তব্য ভারত-থাইল্যান্ড
# ডিএনসি চট্টগ্রাম মেট্রোর অভিযোগপত্র
# অভিযুক্তরা নাইজেরিয়ান, ধরা ছোঁয়ার বাইরে মূল হোতা
কোকেন পাচারের আন্তর্জাতিক রুট চট্টগ্রাম। দক্ষিণ আমেরিকা ও পূর্ব আফ্রিকা থেকে কোকেন এনে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর হয়ে ভারত ও থাইল্যান্ডে পাচার করছে নাইজেরিয়ানদের নেতৃত্বে গড়ে উঠা একটি আন্তর্জাতিক চক্র।
গত বছর ১৫ জুলাই চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কোকেন জব্দের ঘটনায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি) চট্টগ্রাম মেট্রোর দায়ের করা অভিযোগপত্রে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এতে চার নাইজেরিয়ান নাগরিককে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
এদের মধ্যে তিনজন নাইজেরিয়ান আটক হলেও মূল হোতা জ্যাকব ফ্র্যাঙ্ক ওরফে ডন ফ্র্যাঙ্কি ওরফে জন ল্যারি ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। বর্তমানে তিনি নাইজেরিয়ায় অবস্থান করছেন বলে জানিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) ও ডিএনসির পরিদর্শক লোকাশিষ চাকমা।
তিনি জানান, ঘটনার তদন্ত শেষে সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় মাদকদ্রব্য পাচার আইনে চট্টগ্রাম মহানগর আদালতে এই অভিযোগপত্র দায়ের করা হয়। যেখানে দক্ষিণ আমেরিকা ও পূর্ব আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে কোকেন এনে বিমানযোগে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর হয়ে ভারত ও থাইল্যান্ডে পাচার করা হতো বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
অভিযোগপত্রে থাকা অন্য তিন নাইজেরিয়ান হলেন- গ্র্যান্ড বাহামা দ্বীপের স্টাটিয়া শান্টিয়া রোল (৫৩), নাইজেরিয়ার লাগোসের আফিজ ওয়াহাব (৩৮) এবং আবুজার ইকেচুকু নওয়াগউ (৩১)। বর্তমানে তিনজনই কারাগারে আছেন। তদন্তে আংশিকভাবে চক্রটির কার্যকলাপ উন্মোচিত হলেও কোকেনের চূড়ান্ত গন্তব্য খুঁজে বের করতে পারেননি তদন্ত কর্মকর্তা।
অভিযোগপত্রের তথ্যমতে, ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গ্র্যান্ড বাহামা দ্বীপের নাগরিক স্টাটিয়া শান্টিয়া রোলকে (৫৩) গ্রেপ্তার করে বাংলাদেশ কাস্টমস গোয়েন্দা, নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও পুলিশ। তিনি পেশায় সেলসওম্যান এবং ক¤িপউটার ইউপিএসের ভেতরে লুকিয়ে কোকেন বহন করছিলেন।
এ সময় ৩ কেজি ৯ গ্রাম কোকেন জব্দের ঘটনায় পতেঙ্গা থানায় দায়ের হওয়া মামলা তদন্তে মূল হোতার নাম উঠে আসে। একই চক্র ২০২৪ সালের ২৪ জানুয়ারি ঢাকার শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে মালাউইয়ের নাগরিক নারী নোমথানদাজো টাওয়েরা সোকোর সহায়তায় ৮ কেজি ৩ গ্রাম কোকেন পাচার করেছিল। এটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কোকেন জব্দের ঘটনা।
তখন ডিএনসি কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, কোকেনের গন্তব্য ছিল ভারত এবং সেটি আফ্রিকা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। এ ঘটনায় তিন বিদেশি ও দুই বাংলাদেশিসহ মোট পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তখনই জ্যাকব ফ্র্যাঙ্ক ওরফে ডন ফ্র্যাঙ্কি ছিলেন ঘটনার মূল হোতা।
ডিএনসি চট্টগ্রাম মেট্রোর পরিদর্শক লোকাশিষ চাকমা বলেন, আমাদের দেশে এত বিপুল পরিমাণ কোকেন সেবনের মতো ব্যবহারকারী নেই। এগুলো বাংলাদেশ হয়ে ভারত বা থাইল্যান্ডে যাওয়ার জন্য আনা হয়েছিল। স্টাটিয়া শান্টিয়া রোল ব্রাজিল থেকে প্যাকেজটি পেয়েছিলেন। চট্টগ্রামের হোটেল আগ্রাবাদে মালামাল পৌঁছে দিলে তিনি ৫০ হাজার মার্কিন ডলার পেতেন।
তদন্তে আমরা প্রমাণ পেয়েছি যে, ওই নারী জ্যাকব ফ্র্যাঙ্ক ওরফে ডন ফ্র্যাঙ্কির সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করেছিলেন। তদন্তে আরও দুই নাইজেরিয়ান- আফিজ ওয়াহাব ও ইকেচুকু নওয়াগউ এর স¤পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তারা ঢাকায় বসবাস করে ওই নারীকে মালামাল বহনে তদারকি করতেন।
স্টাটিয়া শান্টিয়া রোল জিজ্ঞাসাবাদে তদন্তকারীদের জানান, তিনি অবিবাহিতা ও শারীরিকভাবে অসুস্থ, যার চিকিৎসার জন্য অর্থের প্রয়োজন ছিল। তিনি তার কাজিন ডিয়ন পিন্ডরের কাছে আর্থিক সহায়তা চান। কয়েক দিন পর একজন ল্যারি নামের ব্যক্তি তার মোবাইলে বার্তা পাঠিয়ে সহায়তার প্রস্তাব দেন। পরে জন ল্যারি তাকে ব্রাজিলের সাও পাওলোতে গিয়ে কিছু নথিতে সই করতে বলেন।
স্টাটিয়া ২০২৪ সালের ৭ জুলাই বাহামা থেকে ব্রাজিলে যান। সেখানে গিয়ে তাকে বলা হয়, একটি উপহার হাতে হাতে একজনের কাছে পৌঁছে দিতে হবে এবং তিনি রাজি হন। অ্যালান নামে এক ব্যক্তি তাকে লাগেজটি দেন। জন ল্যারির নির্দেশ অনুযায়ী লাগেজটি গ্রহণ করতেন জোসেফ নামের এক ব্যক্তি। হোয়াটসঅ্যাপে বার্তার মাধ্যমে জন স্টাটিয়াকে নির্দেশনা দেন।
নথি অনুযায়ী, ১৩ জুলাই ওই নারী চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে ৪ দিনের অন-অ্যারাইভাল ভিসা নেন। তিনি এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে আসেন। এর আগে স্থানীয় মুসাফির ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস এর মাধ্যমে হোটেল আগ্রাবাদে একটি কক্ষ বুকিং করা হয়। বিমানবন্দরে লাগেজ বেল্ট থেকে ব্যাগ হারিয়ে গেলে তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দেন।
১৫ জুলাই ব্যাগটি পাওয়া গেলে স্ক্যানিংয়ে সন্দেহজনক মনে হলে নিরাপত্তা কর্মকর্তারা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং কোকেন উদ্ধার হয়। অভিযুক্ত আফিজ ওয়াহাব একজন ফুটবল খেলোয়াড় এবং এক বাংলাদেশি নারীকে বিয়ে করেছেন। তিনি ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশে থাকছেন। তার ভিসার মেয়াদ ২০১২-২০১৩ সালে শেষ হয় এবং তিনি আগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
তদন্তে জানা গেছে, আরেক নাইজেরিয়ান নাগিন স্টাটিয়ার জন্য টিকিটের ব্যবস্থা করেছিলেন। তবে তার সন্ধান মেলেনি। তদন্ত কর্মকর্তা জানান, পুরো চক্রের সদস্যরা একে অপরকে চেনেন না, ওপর থেকে একজন মূল যোগাযোগ পরিচালনা করে। ফলে কয়েকজন ধরা পড়লেও হোতা অদৃশ্য থাকে।
মামলার বাদী জিল্লুর রহমান বর্তমানে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সার্কেলের পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। যোগাযোগ করা হেেল তিনি জানান, বাংলাদেশে কোকেনের বাজার নেই। বাংলাদেশকে কোকেন পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
তিনি আরও বলেন, ইউরোপ ও আমেরিকায় কোকেনের বাজার রয়েছে। ক্রিকেট ও ফুটবলসহ আন্তর্জাতিক বড় বড় খেলার খেলোয়াড়রা কোকেন সেবন করে থাকেন। বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের বিভিন্ন পণ্যের ব্যবসার আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করে আসছে একটি চক্র।
You cannot copy content of this page