“ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের নিয়োজিত সাইট ইঞ্জিনিয়ার মেহেদি হাসান বলেন, কংক্রিটের খুটিগুলো ৫০ ফুট লম্বা। এগুলো গেড়ে পাইলিং করা হচ্ছে। তার উপরে ৩৬ ফুট উচু ও ৩ মিটার প্রশস্ত গাইডওয়াল তৈরী করা হচ্ছে। কিন্তু গাইডওয়াল পরিমাপ, পাইলিং ও রডের মেজরমেন্টের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি দ্রুত ওই স্থান থেকে সটকে পড়েন।”
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত বোড়িবাঁধ কাম রিং রোড নির্মাণ প্রকল্পে ব্যবহার হচ্ছে নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী। প্রকল্পে নতুন ও মানসম্পন্ন ইট এবং বালু ব্যবহারের নিয়ম থাকলেও ব্যবহার করা হচ্ছে শহরের ভাঙা ভবন ও সড়কের রাবিশ। এছাড়া শুভঙ্করের ফাঁকি চলছে গাইড ওয়ালের মেজরমেন্টেও।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে পুরোনো ভবন ভাঙা পচাঁ ইট, পলেস্তরা, রাবিশ ও মাটি ব্যবহার করছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স। আর বিষয়টি দেখেও রহস্যজনক নিরবতা পালন করছে প্রকল্পের তদারকির দায়িত্বে থাকা চউকের প্রধান প্রকৌশলী ও পিডিহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ।
গতকাল বৃহস্পতিবার (২৮ ডিসেম্বর) এ বিষয়ে জানতে চাইলে চউকের প্রধান প্রকৌশলী হাসান বিন সামশ বলেন, আপনারা কি ইঞ্জিনিয়ার, এ বিষয়ে আপনারা কি বুঝবেন। আর বিষয়টি নিয়ে হুট করে আমার কাছে আসলেন কেন? আগে পিডির কাছে যান। তার কাছ থেকে বিষয়টি জেনে নিন। তার সাথে কথা বলুন। এ কথা বলেই তিনি উত্তেজিত হয়ে যান।
পরে এ বিষয়ে জানতে চউকের এই প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) রাজিব দাশের কাছে গেলে তিনি বলেন, না আমার জানামতে প্রকল্পের কাজে নিম্নমানের কোন সামগ্রী ব্যবহার হচ্ছে না। রাবিশগুলো ডাইবারশন সড়কের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।
বাঁধের কাজে মাটি এবং গাইডওয়াল তৈরীর কাজে রাবিশ ব্যবহারের ছবি দেখালে তিনি বলেন, ঠিক আছে আমাকে একদিন নিয়ে যান আপনারা। কোথায় কোথায় নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে আমি সচক্ষে দেখব। কোথায় মেজরমেন্টে ফাঁকি চলছে আমাকে দেখাতে হবে। দেখাতে পারলে আমি অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।
এদিকে প্রকল্প এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কল্পলোক আবাসিক এলাকার ২ নম্বর রোডের শেষ মাথায় প্রকল্পটির সাইট অফিস। অফিসটির বাম পাশে বিভিন্ন এলাকা থেকে আনা হয়েছে ভবনে ব্যবহৃত পুরাতন ইট ও রাবিশ। বিশাল পুরাতন ইটের স্তুপ। একদল ইট ভাঙার মেশিন দিয়ে পুরাতন ইট ভাঙছে। শ্রমিকরা তা ট্রাকে তুলছে। পুরাতন ইট ভেঙে কংক্রিট তৈরি করছে। আর এসব কংক্রিট প্রকল্পের বিভিন্ন ঢালাইয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন নিয়োজিত শ্রমিক ও স্থানীয়রা।
সাইট অফিসের দক্ষিণে শাহ আমানত সেতুর দিকে কর্ণফুলী নদির তীরে বেড়িবাঁধ ও সড়ক রক্ষনাবেক্ষনের লক্ষ্যে তৈরী গাইডওয়ালের পাইলিং কাজের জন্য তৈরী করা হচ্ছে কংক্রিটের খুটি। যেগুলোতে পুরোনো ভবনের ভাঙা রাবিশ ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানান নিয়োজিত শ্রমিক ফোরকান। তিনি বলেন, সাইটে কন্ট্রাক্টরের ইঞ্জিনিয়ার আমাদের যেভাবে বলছেন আমরা সেভাবে কাজ করছি। আর এসব খুটি গেড়ে গাইডওয়ালের পাইলিং করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের নিয়োজিত সাইট ইঞ্জিনিয়ার মেহেদি হাসান বলেন, কংক্রিটের খুটিগুলো ৫০ ফুট লম্বা। এগুলো গেড়ে পাইলিং করা হচ্ছে। তার উপরে ৩৬ ফুট উচু ও ৩ মিটার প্রশস্ত গাইডওয়াল তৈরী করা হচ্ছে। কিন্তু গাইডওয়াল পরিমাপ, পাইলিং ও রডের মেজরমেন্টের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি দ্রুত ওই স্থান থেকে সটকে পড়েন।
এ বিষয়ে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্সের প্রকৌশলী ও প্রজেক্ট ম্যানেজার (পিএম) অসিম কুমার হালদার বলেন, পুরাতন ইট দিয়ে কংক্রিট তৈরি করা হচ্ছে ঠিক আছে। এসব কংক্রিট প্রকল্পে ব্যবহার করব না। অন্য জায়গায় ব্যবহার করব। অন্য কোন জায়গা বা কোন প্রকল্পে ব্যবহার করবে তা নিশ্চিত করতে পারেননি।
চউকের তথ্যমতে, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী তীরবর্তী কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত চার লেনের সড়ক কাম বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের অক্টোবরে। সাড়ে আট কিলোমিটার দীর্ঘ এই বাঁধের ব্যয় ধরা হয় ২ হাজার ২৭৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা।
প্রকল্পটি তিন বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। তবে প্রায় পাঁচ বছর সময় পার হলেও গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পটির কাজ এখনও শেষ করতে পারেনি বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক)। এই সময়ে দুই দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর পাশাপাশি ৪৭১ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। এতে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা জানান, ‘প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ও ঠিকাদাররা যোগসাজশে বারবার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়েছে মূলত হরিলুট করার জন্য। প্রকল্প নেওয়ার আগেই প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় নির্ধারিত থাকে। সেই অনুসারে প্রকল্পের কাজ শেষ করা হয় না কেন? তিন থেকে চারবার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হবে কেন? এর কারণ হচ্ছে প্রকল্পে অনিয়ম আর হরিলুট করা।
তিনি আরও বলেন, প্রায় প্রত্যক বড় বড় প্রকল্পে এমন হচ্ছে। জবাবদিহিতা না থাকায় দেশের বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়ম হচ্ছে এবং অসংগতিই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আমাদের। নয়তো এভাবে সরকারি টাকা নয়ছয় হতেই থাকবে।
কর্মকর্তাদের অভিযোগ , গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটির পিডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন নির্বাহী প্রকৌশলী রাজিব দাশ। তিনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের টাকায় ইতোমধ্যে কয়েকবার বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। একইভাবে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়েছেন প্রধান প্রকৌশলী হাসান বিন সামশও। এই সুযোগে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করে চলছে।
ঈশান/খম/সুপ
You cannot copy content of this page