চট্টগ্রামে প্রায় অর্ধসহস্র মশার প্রজননক্ষেত্র থেকে ছড়াচ্ছে ডেঙ্গু। যেগুলোকে চিহ্নিত করেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৫২টি মশার প্রজননস্থল রয়েছে চসিকের ৫ নম্বর মোহরা ওয়ার্ডে। চসিকের ম্যালেরিয়া ও মশক নিয়ন্ত্রণ বিভাগের উদ্যোগে পরিচালিত জরিপে এসব প্রজননস্থল চিহ্নিত করা হয়। আর এসব প্রজননক্ষেত্র ধ্বংসে মাঠে নামছে চসিক।
শুক্রবার (৭ জুলাই) দুপুরে এ তথ্য জানান চসিকের ম্যালেরিয়া ও মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা মো. শরিফুল ইসলাম মাহী। তিনি বলেন, চট্টগ্রামে মশার প্রজনন এবং ডেঙ্গু আক্রান্তের হার বিবেচনায় ৪৯১টি হট¯পট চিহ্নিত করা হয়েছে। এরমধ্যে অনাবাদি জমি, নালা ও ঝোঁপঝাড়, ডোবা, খাল, পুকুর-জলাশয় ও পরিত্যক্ত বাড়ি রয়েছে।
প্রজননস্থলগুলোতে কীটনাশক ছিটালে মশার বংশবিস্তার অনেকটা কমে আসবে। বলা যায় প্রজননস্থলেই মশার লার্ভা ধ্বংস করলে মশা নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে। এতে শহরের মানুষ কিছুটা হলেও মশার উৎপাত থেকে রক্ষা পাবেন।
প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি চসিকে যোগ দিয়েছি মাত্র কয়েক মাস আগে। দায়িত্ব নেয়ার পর শহরের মশার প্রজননস্থলগুলো চিহ্নিত করার জন্য নিজ উদ্যোগে কাজ শুরু করি। নিজে মাঠ পর্যায়ে জরিপ করে স্থানগুলো চিহ্নিত করি। ডেঙ্গু শনাক্ত হিসেবে চিহ্নিত হট¯পটগুলোর বা যে ঘরে ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে তার আশেপাশে এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এখন কীটনাশক ছিটানো হচ্ছে।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, নগরীর ১ নং দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডে ২৫টি, ২ নং জালালাবাদ ওয়ার্ডে ১৫টি, ৪ নং চান্দগাঁও ওয়ার্ডে ১৬টি, ৫ নং মোহরা ওয়ার্ডে ৫২টি, ৬ নং পূর্ব ষোলশহর ওয়ার্ডে ২৯টি, ৭ নং পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ডে ১৭টি, ৮ নং শোলকবহর ওয়ার্ডে ৩০টি, ৯ নং উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডে ১৩টি, ১০ নং উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডে ৬টি।
১১ নং দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ডে ১৬টি, ১২ নং সরাইপাড়া ওয়ার্ডে ১২টি, ১৩ নং পাহাড়তলী ওয়ার্ডে ৩টি, ১৪ নং লালখান বাজার ওয়ার্ডে ৭টি, ১৫ নং বাগমনিরাম ওয়ার্ডে ৫টি, ১৬ নং চকবাজার ওয়ার্ডে ৯টি, ১৭ নং পশ্চিম বাকলিয়া ওয়ার্ডে ৭টি, ১৮ নং পূর্ব বাকলিয়া ওয়ার্ডে ১৩টি, ২০ নং দেওয়ানবাজার ওয়ার্ডে ১২টি।
২১ নং জামালখান ওয়ার্ডে ১৪টি, ২২ নং এনায়েত বাজার ওয়ার্ডে ৭টি, ২৩ নং উত্তর পাঠানটুলী ওয়ার্ডে ৮টি, ২৪ নং উত্তর আগ্রাবাদ ওয়ার্ডে ২টি, ২৫ নং রামপুর ওয়ার্ডে ১২টি, ২৬ নং উত্তর হালিশহর ওয়ার্ডে ১০টি, ২৮ নং পাঠানটুলী ওয়ার্ডে ১২টি, ২৯ নং পশ্চিম মাদারবাড়ি ওয়ার্ডে ১৬টি, ৩০ নং পূর্ব মাদারবাড়ি ওয়ার্ডে ৮টি।
৩১ নং আলকরণ ওয়ার্ডে ৩টি, ৩২ নং আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডে ৫টি, ৩৪ নং পাথরঘাটা ওয়ার্ডে ৫টি, ৩৫ নং বক্সিরহাট ওয়ার্ডে ৫টি, ৩৭ নং মুনিরনগর ওয়ার্ডে ৫টি, ৩৮ নং দক্ষিণ মধ্যম হালিশহর ওয়ার্ডে ১টি, ৩৯ নং দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডে ১৪টি, ৪০ নং উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ডে ১৬টি এবং ৪১ নং দক্ষিণ পতেঙ্গা ওয়ার্ডে ৪টি মশার প্রজননস্থল রয়েছে।
তবে ৩ নং পাঁচলাইশ ওয়ার্ড, ১৯ নং দক্ষিণ বাকলিয়া ওয়ার্ড, ২৭ নং দক্ষিণ আগ্রাবাদ ওয়ার্ড, ৩৪ নং ফিরিঙ্গিবাজার ওয়ার্ড এবং ৩৬ নং গোসাইলডাঙা ওয়ার্ডে কোনো ব্রিডিং পয়েন্ট নেই বলে জরিপের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
আর ডেঙ্গু রোগী শনাক্তের ভিত্তিতে চিহ্নিত হট¯পটগুলো হচ্ছে আকবর শাহ হাউজিং, উত্তর কাট্টলী, কর্ণেল হাট, বিশ্বকলোনী, বাদামতলী, আলকরণ, কোতোয়ালী, মাদামবিবির হাট, সদরঘাট, পশ্চিম বাকলিয়া, পূর্ব বাকলিয়া, দক্ষিণ বাকলিয়া, দক্ষিণ খুলশী, পশ্চিম খুলশী, দক্ষিণ আগ্রাবাদ, উত্তর আগ্রাবাদ, বন্দর টিলা, চান্দগাঁও আবাসিক, নাছিরাবাদ প্রপার্টিজ, মেহেদীবাগ, সিডিএ আবাসিক এলাকা, এনায়েতবাজার, গোয়ালপাড়া, কালিরহাট, পূর্ব মাদারবাড়ী, পলোগ্রাউন্ড মাঠ সংলগ্ন এলাকা, সরাইপাড়া কাজিরদিঘী, শাপলা আবাসিক এলাকা হালিশহর ঈদগাহ মুন্সিপাড়া, নাজিরপুল কলাবাগান ডবলমুরিং, কৈবল্যাধাম হাউজিং সোসাইটি, বায়েজিদ এলাকা, পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা, অক্সিজেন, সিটি গেইট এলাকা, ফৌজদারহাট, চট্টগ্রাম কলেজ সংলগ্ন এলাকা, কাঠগড় মাইজপাড়া, বহদ্দারহাট ফরিদের পাড়া খাল ও আশেপাশের এলাকা, খতিববাড়ি খাল, কাতালগঞ্জ আবাসিক এলাকা, হিলভিউ আবাসিক এলাকা, হামজারবাগ কলোনী সংলগ্ন ফরেস্ট একাডেমি, সমবায় আবাসিক এলাকা, পাহাড়িকা আবাসিক এলাকা ও পূর্ব ষোলশহরের আমিন শ্রমিক কলোনি।
চট্টগ্রাম সিভিল সার্জনের তথ্যমতে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) একটি প্রতিনিধিদল চট্টগ্রাম মহানগরে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ পাঁচটি স্থান চিহ্নিত করে তা চসিককে অবহিত করে। এসব স্থানের মধ্যে রয়েছে হালিশহর, আগ্রাবাদ, আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতাল এলাকা, ডবলমুরিং এবং বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল এলাকা।
এছাড়া একই বিভাগের শুরুতে পরিচালিত মশা জরিপে দেখা গেছে, নগরে মশার ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। এর আগে চসিকের উদ্যোগে ২০২১ সালে গবেষণা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক নগরের ৯৯টি স্থান পরিদর্শন করে ৫৭টি স্থান থেকে মশার লার্ভা সংগ্রহ করে। এর মধ্যে ৩৩ স্থানে এডিস, ৩৯ স্থানে এনোফিলিস ও ২২ স্থানে এডিস ও এনোফিলিস দুটোই পাওয়া গেছে। তবে ১৮ স্থানে এডিস ও ১২ স্থানে এনোফিলিস পাওয়া যায়নি। এছাড়া ১৫ স্থানে শতভাগ এডিস ও দুই স্থানে শতভাগ এনোফিলিস পাওয়া গেছে।
এদিকে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাওয়ার পর মশক নিধনে জুন মাসে দুই দফা ক্রাশ প্রোগ্রাম শুরু করে চসিক। সর্বশেষ ২২ জুন শুরু হওয়া কর্মসূচিটির ১৫ দিন পেরিয়েছে। এরপরও মশা নিয়ন্ত্রণে আসছে না। নগরবাসীর অভিযোগ, ক্রাশ প্রোগ্রাম উদ্বোধন ছাড়া আরও কোথাও এর কার্যক্রম দেখা যায় না। নগরীর কোথাও মশক নিধন ওষুধ ছিটানো হয়েছে এর কোন তথ্য নেই নগরবাসীর কাছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চসিক মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, মশক নিধনে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। এখন মশার হট¯পটগুলোতেও ওষুধ ছিটানো হবে। মশার প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করা গেলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
এদিকে মশা নিয়ন্ত্রণে চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর বরাবরে চিঠি দিয়েছেন চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী। চিঠিতে বলা হয়, সম্প্রতি চট্টগ্রাম মহানগরে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে নতুন করে ২৬ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এ নিয়ে চলতি মৌসুমে চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৮৭ জনে। আক্রান্তদের মাঝে এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের। ফলে মশা নিয়ন্ত্রণে চসিককে কার্যকর ভুমিকা নিতে বলা হয়।
You cannot copy content of this page