
# বাস্তবায়নে পছন্দের তিন ঠিকাদার আওয়ামী লীগের!
# প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রমাণ পেয়েছে দুদক
চট্টগ্রাম মহানগরীর আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনিতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বসবাসের জন্য ৯টি ২০ তলা ভবন নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে গণপূর্ত বিভাগ। শুরু থেকেই এ প্রকল্পে লুটপাট চালিয়েছে সংস্থার প্রকৌশলীরা।
এর মধ্যে ভবনগুলো নির্মাণে আওয়ামী লীগপন্থি তিন ঠিকাদার কার্যাদেশ পাওয়ায় ছিল অন্যতম কারসাজি। যাদের মাধ্যমে কমিশন বাণিজ্য চালিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন গণপূর্ত বিভাগ, চট্টগ্রাম সার্কেল-২ এর সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা। ফলে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে ভবনগুলো নির্মাণ করেন ঠিকাদাররা। যা প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রমাণ পেয়েছে দূর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বৃহস্পতিবার ( ১৮ ডিসেম্বর) এ তথ্য জানান দুর্নীতি দমন কমিশন চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২ এর উপ-পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন। তিনি বলেন, গণপূর্তের সরকারি আবাসন প্রকল্পে দুর্নীতি অনুসন্ধান চলছে। ইতোমধ্যে ভবনগুলো পরিমাপ করেছি। দূর্নীতির প্রাথমিক তথ্যও মিলেছে। অনুসন্ধান শেষ হলেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।
তিনি বলেন, বেসরকারি আবাসন কোম্পানি যে দামে ফ্ল্যাট বিক্রি করে জমির মূল্য বাদে গণপূর্তের এসব ফ্ল্যাট নির্মাণে তার কাছাকাছি খরচ পড়েছে বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রমাণ পেয়েছে দুদক। প্রকল্পে ৯টি ভবন নির্মাণে প্রায় ৩৯৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়, প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ শুরুর এক বছরের মধ্যে অনিয়মের অভিযোগ উঠে। ২০২০ সালে প্রকল্পটির অনিয়ম তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়ে অনুসন্ধান কর্মকর্তাও নিয়োগ দেয় দুদক। করোনার পরপরই অনুসন্ধান শুরু করেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। সেসময় প্রকল্পের যাবতীয় তথ্য চেয়ে গণপূর্তের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীকেও চিঠি দেয় দুদক। কিন্তু দুদকের এ অনুসন্ধান থেমে যায়।
গত বছর আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর প্রকল্পটির দুর্নীতি অনুসন্ধানে আবারো মাঠে নামে দুদক। গত ৯ সেপ্টেম্বর প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন এবং ভবনের বিভিন্ন অবকাঠামো পরিমাপ করে দুদক। প্রাথমিক তদন্তে দুদক অনিয়মের সত্যতা পেয়েছে। ঠিকাদার ও প্রকৌশলীরা যোগসাজশ করেই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বসবাসের
জন্য নির্মিত ৯টি ভবন নির্মাণে বড় ধরনের দুর্নীতি করেছেন।
গণপূর্তের দু‘জন ঠিকাদার জানান, তিনটি করে ভবন নিয়ে তিনটি প্যাকেজ করার কারণে এই ভবন নির্মাণে প্যাকেজ মূল্য বেড়ে যায়। প্যাকেজ মূল্যের কারণে সেসময় অনেক অভিজ্ঞ ঠিকাদার টেন্ডারে অংশ নিতে পারেননি। চট্টগ্রামের বিভিন্ন দপ্তর নিয়ন্ত্রণ করা একটি ঠিকাদারি সিন্ডিকেটকে সুবিধা দিতেই মূলত গণপূর্তের প্রকৌশলীরা প্যাকেজ মূল্য বড় করেছিলেন।
মূলত ঠিকাদার ও প্রকৌশলীরা মিলে এই প্রকল্পটির অর্থ লোপাট করেছেন। প্রকল্পের কাজ করা তিনজন ঠিকাদারই আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের বিভিন্ন দায়িত্বে ছিলেন। ভবন নির্মাণে প্রতি বর্গফুটে যে ব্যয় দেখানো হয়েছে তা অনেক বেশি। বেসরকারি আবাসন কো¤পানি জমিসহ ফ্ল্যাট বিক্রিতে যে দাম ধরে জমির মূল্য ছাড়াই ফ্ল্যাট নির্মাণে তার চেয়ে বেশি ব্যয় করেছে গণপূর্ত বিভাগ।
সরেজমিনে দেখা যায়, আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনির ভেতরে এক জায়গায় ৯টি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। নদীর নামে নাফ, কাসালং, রানখিয়াং, সাঙ্গু, মাতামুহুরি, ইছামতি, হালদা, কর্ণফুলী, বাঁকখালী নাম দেয়া হয়েছে ভবনগুলোর। দুইপাশে যাতায়াতের জন্য ৯টি ভবনের মাঝখানে দুটি রাস্তা রাখা হয়েছে। অধিকাংশ ভবনেই বরাদ্দ পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারিরা বসবাস করছেন।
ভবনের একজন নিরাপত্তারক্ষী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বহিরাগত কেউ এসব ভবনগুলোতে উঠতে পারে না। ভবনগুলোতে বর্তমানে ৯ম থেকে ১২তম গ্রেডের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিরা বসবাস করছেন। এক হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাটগুলোতে তিনটি বেডরুম, ড্রয়িং-ডাইনিং, তিনটি ব্যালকনি এবং ওয়াশরুম আছে। ভবন নির্মাণে দুর্নীতি হয়েছে জানিয়ে কিছুদিন আগে দুদক এসে তদন্ত করেছে।
গণপূর্ত বিভাগ চট্টগ্রাম সার্কেল-২ সূত্র জানায়, আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনিতে জরাজীর্ণ ১১টি ভবনের স্থলে ৯টি বহুতল আবাসিক ভবনে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের জন্য ৬৮৪টি ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে গণপূর্ত বিভাগ-৪।
৩৯৫ কোটি ৪৩ লাখ ৪৭ হাজার ৯২৭ টাকায় ভবনগুলোর নির্মাণ কাজ করেছে রয়েল এসোসিয়েট, ফ্রেন্ডস এসোসিয়েট ও জামাল এন্টারপ্রাইজ নামে তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান তিনিটিই ছিল ফ্যাসিবাদদুষ্ট আওয়ামী লীগ আশীর্বাদপুষ্ঠ।
তৎকালীন সময়ে এ সরকারের প্রভাব খাটিয়ে ভাগিয়ে নেন লাভজনক এই প্রকল্পের কাজ। পছন্দের প্রতিষ্ঠান হিসেবে এ কাজ পেতে সহযোগীতা করেছেন গণপূর্তের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা। বিনিময়ে প্রকৌশলীরা প্রকল্প বাজেটের ১০% কমিশন হাতিয়ে নিয়েছেন সহজেই।
ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো তিনটি প্যাকেজের প্রতিটিতে তিনটি করে ভবন নির্মাণ করে। একেকটি ভবনে ৭৬টি করে ফ্ল্যাট রয়েছে। ভবনগুলোর প্রত্যেকটি ফ্লোরে রয়েছে চারটি করে ফ্ল্যাট। ৯টি ভবনে ৬৫০ বর্গফুটের ১৫২টি ফ্ল্যাট, ৮৫০ বর্গফুটের ৩০৪টি ফ্ল্যাট এবং ১ হাজার বর্গফুটের ২২৮টি ফ্ল্যাট রয়েছে।
এক হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাটের তিনটি ভবনের প্রত্যেকটি একই ডিজাইন ও মাপের। ২০ তলা বিশিষ্ট ভবনের প্রত্যেকটি ফ্লোরের আয়তন ৬ হাজার ৮০০ বর্গফুট। সেই হিসেবে প্রতি প্যাকেজে ৩টি ভবনে ফ্লোরের আয়তন দাঁড়ায় ৪ লক্ষ ৮ হাজার বর্গফুট।
প্রকল্পে আধুনিক সুযোগ-সুবিধার সন্নিবেশ ঘটানো হয়েছে। এতে সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, গভীর নলকূপ, ভূগর্ভস্থ জলাধার, পা¤প হাউজ, অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা, সোলার সিস্টেম, সিকিউরিটি লাইট, লাইটেনিং এরেস্টর, ক¤পাউন্ড ড্রেন, অভ্যন্তরীণ রাস্তা ও কমিউনিটি ভবন রয়েছে। প্রত্যেকটি ভবনে তিনটি করে লিফট রয়েছে। কমিউনিটি ভবনেও রয়েছে লিফট। ভবনগুলোতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কিন্তু পুরো ভবনগুলোতে ব্যবহার করা হয়েছে অত্যন্ত নিম্নমানের সামগ্রী। ফলে ভূমিকম্প প্রবণ চট্টগ্রামে মাঝাারি আকারের ভুমিকম্প হলেও এসব ভবন ধসে পড়ার আশঙ্কা করছে সচেতন মহল।
ছয় দশমিক ১৬ একরজুড়ে ভবন তিনটি নির্মাণ করা হয়েছে। পুরো জায়গার মাত্র ২৫ শতাংশ ব্যবহার করা হয়েছে ভবন নির্মাণে। অবশিষ্ট ৭৫ শতাংশ ফাঁকা ও সবুজ আচ্ছাদন করা হয়েছে। এরই মধ্যে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার বিভিন্ন ফলদ, ওষুধি, বনজ এবং সৌন্দর্যবর্ধনকারী গাছ লাগানো হয়েছে।
প্রকল্পটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেছেন চট্টগ্রাম গণপূর্ত বিভাগের বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মুহম্মদ আশিফ ইমরোজ ও গণপূর্ত বিভাগ-৩ এর নির্বাহী প্রকৌশলী জহির উদ্দিন আহমেদ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গণপূর্ত চট্টগ্রাম সার্কেল-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী-৩ জহির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ভবনগুলো নির্মাণে প্রতিবর্গফুটে খরচ পড়েছে ৩ হাজার টাকা। বর্তমানে চট্টগ্রাম শহরে কি এ দামে কোন ফ্ল্যাট পাওয়া যায়? তাছাড়া এখানে নিম্নমানের কোন উপকরণ ব্যবহার হয়নি। দুদক পরিমাপ করেছে। আমাদের কাছে তথ্যও চেয়েছে। সেটা আমরা দিয়েও দিয়েছি।
আওয়ামী লীগের ঠিকাদার কাজ পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আপনারাই বলুন তখন কি তাদের বাইরে কিছু করা সম্ভব হয়েছে। বরং তাদের সামলাতে আমাদের হিমশিম খেতে হয়েছে। কমিশন হাতানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। এ বিষয়ে কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম গণপূর্ত সার্কেল-২ এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মুহম্মদ আশিফ ইমরোজ বলেন, আমি চট্টগ্রাম সার্কেলে নেই, ঢাকায় বদলি হয়েছি। বিষয়টি নির্বাহী প্রকৌশলী জহির উদ্দিন আহমেদ ভালো জানবেন। ভবনগুলো নির্মাণে কোন অনিয়ম হয়নি, মানদন্ড মেনেই নির্মাণ করা হয়েছে। ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়া ঢাকা থেকেই সম্পন্ন হয়েছে। কমিশন নেওয়া বিষয়টি আমার জানা নেই। বিষয়টি অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী তদারকি করেছেন। দুদকও বিষয়টি যাচাই করছে।
বিষয়টি জানতে গণপূর্ত চট্টগ্রাম সার্কেল-২ এর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবুল খায়ের এর মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। হোয়াটস অ্যাপে ক্ষুদে বার্তা প্রেরণ করলেও তিনি কোনরকম উত্তর প্রেরণ করেননি।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ২৬ জুন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়। গত ১১ জুলাই তিন প্যাকেজের মাধ্যমে প্রকল্পের দরপত্র আহ্বান করে চট্টগ্রাম গণপূর্ত বিভাগ। ১৩ আগস্ট দরপত্র উম্মুক্ত করা হয়। ৮ সেপ্টেম্বর গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তিন প্যাকেজে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়।
২০২৩ সালের মঙ্গলবার (১৪ নভেম্বর) ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। এরপর কিছু ফ্লাটে লোকজন বসবাসও করছেন। ফ্ল্যাটগুলো পুরোপুরি বরাদ্দ হলে চট্টগ্রামে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের আবাসন সংকট অনেকাংশে ঘুচে যাবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।











































