রবিবার- ২০ এপ্রিল, ২০২৫

চট্টগ্রামে আসতেই প্রতিকেজি আলুর দাম বাড়ে ১৬ টাকা

সরকার নির্ধরিত দাম মানছে না কেউ

চলতি বছর প্রতি কেজি আলু উৎপাদনে কৃষকের খরচ পড়েছে প্রায় ১০ টাকা। কৃষকেরা সেই আলু বিক্রি করেছেন সর্বোচ্চ ১৮ টাকায়। পাইকারি ব্যবসায়ীরা এসব আলু কিনে কোল্ডস্টোরেজে সংরক্ষণ খরচ পড়েছে প্রতি কেজিতে ৫ টাকা। সবমিলিয়ে কেজিতে আলুর দাম পড়েছে ২৩ টাকা।

অথচ সেই আলু চট্টগ্রামের আড়তে আসার পর হয়ে যায় কেজিপ্রতি ৩৭ থেকে ৩৯ টাকা! অর্থাৎ কোল্ডস্টোরেজ থেকে আড়তে আসার পর দাম বাড়ে কেজিতে প্রায় ১৬ টাকা। আবার আড়ত থেকে খুচরা বাজারে ক্রেতাদের কাছে সেই আলু বিক্রি হচ্ছে কেজি ৫০-৫২ টাকায়। এই পর্যায়ে আলুর দাম বাড়ে ১০-১২ টাকা।

যা কিনতে এখন নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষও হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় বৃস্পতিবার দুপুরে সচিবালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি প্রতি কেজি আলু খুচরা পর্যায়ে ৩৫-৩৬ টাকা ও হিমাগার পর্যায়ে ২৬-২৭ হিসেবে দাম বেঁধে দেন। কিন্তু বেঁধে দেওয়া দাম অনুযায়ী ব্যবসায়ীরা বিক্রয় করছেন না আলু।

বৃহস্পতিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) দুপুর থেকে চট্টগ্রাম মহানগরীর চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ ও রিয়াজ উদ্দিন বাজারের পাইকারি আড়তদার ও বিভিন্ন হাট-বাজারের খুচরা আলুর ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, চট্টগ্রাম মহানগরীর সবকটি হাটবাজারে প্রতি কেজি সাদা আলু বা বাদামি রুসেট আলু এখন বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫২ টাকায়। অথচ গত সপ্তাহে বিক্রি হয়েছিল ৩৫ থেকে ৩৮ টাকায়। লাল আলুর কেজি ৪৫ টাকা থেকে ৪৮ টাকা। গত সপ্তাহে ছিল ৩২ টাকা থেকে ৩৫ টাকা।

প্রতিদিনের খাবারের তালিকার থাকা আলুর এমন বাড়তি দামে ক্ষুব্ধ সাধারণ ক্রেতারা। চকবাজার কাঁচাবাজারে আলু কিনতে আসা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ উদ্দিন বলেন, চট্টগ্রামের বাজারে আলুর দাম এবার হাফ সেঞ্চুরি করেছে। ফলে গরিবের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে আলু। এভাবে দাম বাড়তে থাকলে আলু খাওয়ার সক্ষমতা থাকবে না। ধনীদের বিলাসী খাবারে পরিণত হবে আলু।

নগরীর বহদ্দারহাটে আলু কেনার সময় পোশাক শ্রমিক রাইসা আকতার লিছা বলেন, ব্যাচেলর বাসায় আমরা ৮ জন ভাড়ায় থাকি। সবাই পোশাক শ্রমিক। স্বল্প বেতনের চাকরি করি। বর্তমানে বাসা ভাড়া, গাড়িভাড়াসহ সব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের চলতে খুব কষ্ট হচ্ছে। এর মধ্যে আবার আলুর দাম বাড়ায় কষ্টের মাত্রা দ্বিগুণ বেড়েছে। কারণ আমরা আলু-ডাল খেয়ে বেচে আছি। এখন কী খাব খুঁজে পাচ্ছি না।

বহদ্দারহাট এলাকার খুচরা আলু বিক্রেতা নুরুল আলম বলেন, আলুর দাম বৃদ্ধির সঙ্গে খুচরা ব্যবসায়ীদের সম্পৃক্ততা নেই। বুধবার রিয়াজউদ্দিন বাজার থেকে পাইকারি মূল্যে আলু কিনেছি কেজি ৪৫ টাকায়। ওখান থেকে দোকানে আনার গাড়ি ভাড়া, লেবার খরচসহ অন্যান্য খরচ যোগ করে আমরা কেজি ৪৮ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি করছি। সরকার দাম বেঁধে দিলে কি হবে। সংকট তৈরি করে পাইকারি ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াচ্ছে। আলুর দাম প্রায় প্রতিদিন ১ থেকে ২ টাকা বাড়ছে।

নগরীর চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ ও রিয়াজউদ্দিন বাজার ঘুরে দেখা যায়, আড়তগুলোতে আলুর সরবরাহ তুলনামূলক কম। এসব আড়তে সাদা আলু বা বাদামি রুসেট আলুর কেজি ৩৯ থেকে ৪২ টাকা। লাল আলু বা রেড বিøস আলুর কেজি ৩৭ থেকে ৩৯ টাকা। এখানে বেশিরভাগ আলু আসে মুন্সিগঞ্জ থেকে। এছাড়া জয়পুরহাট, দিনাজপুর, রংপুরসহ দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকার কোল্ডস্টোরজে থেকেও আলু আসে। দেশে আলুর উৎপাদন এবার কম হওয়ায় ওইসব এলাকা থেকে এবার পর্যাপ্ত পরিমাণ আলু আসছে না বলে জানান পাইকারি ব্যবসায়ীরা। এ কারণে আলুর দাম বেড়েছে বলেন জানান তারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নগরের আলুর আড়তদার প্রতিষ্ঠান মেসার্স সাকিব ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মো. সাকিবুর রহমান বলেন, মুন্সিগঞ্জ থেকে আলু সরবরাহ করি। আগামী ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত আলুর সংরক্ষণ ও সরবরাহের যে টার্গেট রয়েছে তাতে ঘাটতি আছে। আগে ৪-৫ পার্টি মিলে প্রায় ২০০ বস্তা আলু সরবরাহ করতো এখন সেটি নেমে এসেছে ৯০ থেকে ১০০ বস্তার মধ্যে। অর্থাৎ আগের তুলনায় আড়তে আলুর সরবরাহ প্রায় অর্ধেক।

তিনি বলেন, ১৩ সেপ্টেম্বর বুধবার মুন্সিগঞ্জ স্টোর থেকে প্রতি কেজি আলু কিনেছি ৩৭ টাকা দরে। পাইকারি মূল্যে সাড়ে ৩৮ টাকা থেকে ৩৯ টাকা বিক্রি করছি। এখন সরকার দাম বেঁধে দিয়েছে ২৬-২৭ টাকার মধ্যে। সে দামে আলু কিনতে পারলে আমরাও কম দামে বিক্রয় করব।

খাতুনগঞ্জের আলুর আড়তদার আজিমুল হক বাদশা বলেন, গত বছর ব্যবসায়ীরা আলুতে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। এবার তা পুষিয়ে নিতে হয়ত আলুর সংকট দেখিয়ে দাম বাড়িয়ে বিক্রয় করছে। আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বরে নতুন আলু বাজারে এলে হয়তো দাম কমতে পারে।

কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি জেসমিন সুলতানা পারু বলেন, সপ্তাহের ব্যবধানে চট্টগ্রামের খুচরা বাজারে আলুর দাম বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ! কোলস্টোরেজে পর্যাপ্ত আলু থাকার পরও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আলুর দাম। এক্ষেত্রে সংকট তৈরি করে পাইকারি ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াচ্ছে। সরকারের জোরদার মনিটরিং করলে আলুর দাম অর্ধেকে নেমে আসবে। এতে চাপ কম হত স্বল্প আয়ের মানুষের।

এদিকে আলুর উৎপাদন কম ও সরবরাহ কমে যাওয়ার কারণে আলুর দাম বাড়ার কথা ব্যবসায়ীরা বললেও সরকারি তথ্য বলছে ভিন্ন কথা। কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে আলু উৎপাদিত হয়েছিল ১ কোটি ১০ লাখ ৫৮ হাজার টন। ২০২১ সালে দেশে আলুর চাহিদা ছিল ৯৫ হাজার ৬৩ টন। ফলে চাহিদার বিপরীতে আরও প্রায় ১৬ লাখ টন আলু উদ্বৃত্ত ছিল। এরপর ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে আলু উৎপাদিত হয়েছে ১ কোটি ১১ লাখ ৯১ হাজার টন। আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ১ লাখ ৩৩ হাজার টন বেশি। বর্তমানে দেশে আলুর চাহিদা রয়েছে ৭৫ থেকে ৮০ লাখ টন। ফলে চাহিদার তুলনায় বেশি পরিমাণে আলু উৎপাদিত হয়েছে।

যোগাযোগ করা হলে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ড. নাসরিন সুলতানা বলেন, আলুর উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ১১ লাখ টন। হিমাগারে আলু সংরক্ষিত আছে ২৪ লাখ ৯২ হাজার মেট্রিক টন। সেই হিসাবে সংকট থাকার কথা না। এছাড়া আলুর মূল্য বৃদ্ধিরও কোনো কারণ নেই। কেন দাম দিন দিন বাড়ছে তা খতিয়ে দেখা দরকার। আমরা প্রতিটি জেলায় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সভা করছি। বাজার মনিটরিংয়ের চেষ্টা চলছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় ৪৫০টি আলুর ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। যেখানে ৩০ টন পর্যন্ত আলু রাখা যাবে। এসব আলুর ঘর নির্মাণে প্রতিটির জন্য খরচ পড়ছে ২ থেকে আড়াই লাখ টাকা। এসব ঘরে ১০ থেকে ১২ বছর আলু সংরক্ষণ করে ব্যবহার করা যাবে।

বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেন, সরকারের যেসব কর্মকর্তা মাঠ পর্যায়ে রিপোর্ট করছেন তারা সরকারকে সঠিক রিপোর্ট দিচ্ছেন না। তাদের কাজে গাফেলতি আছে। যে কারণে দেশের মানুষের কাছে অস্বচ্ছ ও বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হচ্ছে। আমি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে। সরকার যদি প্রতিটি কোল্ডস্টোরেজে জোরদার মনিটরিং করেন তাহলে অবশ্যই আলুর দাম কমে আসবে বলে আমি মনে করি।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, কোল্ডস্টোরেজের মালিকরাই বলছেন আলুর পর্যাপ্ত মজুদ আছে। এতে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে। বর্তমানে কৃত্রিমভাবে আলুর সংকট তৈরি করা হচ্ছে। এখানে প্রতি কেজিতে প্রায় ১০ টাকার একটা গ্যাপ কাজ করছে। এই গ্যাপ যেন না থাকে সে লক্ষ্যে আমরা পদক্ষেপ নিচ্ছি। প্রশাসকদের নেতৃত্বে যে সমন্বিত মনিটরিং হবে সেখানে যারা দাম বাড়িয়ে দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন

No more posts to show

You cannot copy content of this page