
চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানার সাবেক ওসি মো. নেজাম উদ্দিনের কলার চেপে ধরে টেনেহিঁচড়ে পরনের শার্ট ছিঁড়ে নির্যাতনের বদলা নিলেন ভু্ক্তভোগীরা। এমন একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
এ ঘটনার ভিডিও নগরীর চকবাজার থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্যসচিব শহিদুল ইসলাম শহিদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে লাইভ করা হয়। লাইভ ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ।
সোমবার (৬ ডিসেম্বর) দুপুর আড়াইটার দিকে নগরীর পাঁচলাইশ পাসপোর্ট অফিসের সামনে এ ঘটনা ঘটে। ভিডিওতে দেখা যায়, নীল শার্ট পরিহিত ছিলেন ওসি নেজাম। তাকে কলার ধরে টেনেহিঁচড়ে গলা টিপে ধরতেও দেখা যায়। সেখানে কয়েকজন যুবককে দেখা যায়।
ভিডিওতে একজনকে বলতে শোনা যায়. এই সেই ওসি নেজাম উদ্দিন যে জনতার মেয়র ডা. শাহাদাতকে, আমাদেরকে ১৫ বছর কষ্ট দিয়েছে। আজকে তাকে আমরা ধরেছি। পাঁচলাইশ থানার সামনে আমাদের দলীয় লোকজনকে জড়ো হওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।
তবে ওই ভিডিওতে ওসি নেজাম উদ্দিন বারবার অনুরোধ করতে থাকেন, সবার সামনে তাকে যেন লাঞ্ছিত না করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা আড়াইটার দিকে ব্যক্তিগত গাড়িতে ছেলের পাসপোর্ট আনতে পাসপোর্ট অফিসের সামনে আসেন ওসি নেজাম উদ্দিন। এ সময় আশপাশে থাকা বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা নেজাম উদ্দিনকে দেখতে পেয়ে ছুটে আসেন। তখন তাঁর সঙ্গে তাঁদের হাতাহাতি হয়। মারধরের কারণে তাঁর পরনে থাকা শার্ট ছিঁড়ে যায়।
ওই সময় তিনি বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের নানাভাবে নির্যাতন, নিপীড়ন ও হয়রানি করেছেন। বিনা কারণে গ্রেপ্তার করেছেন। চাঁদাবাজি করেছেন। অনুমতি থাকা সত্ত্বেও বিএনপিকে কর্মসূচি পালন করতে দেননি নেজাম উদ্দিন। এ ধরণের অভিযোগ তুলেন। এছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। তাঁকে গ্রেপ্তার করতে হবেও বলে দাবি করেন নেতাকর্মীরা।
এদিকে ঘটনাস্থল থেকে তাকে পুলিশ হেফাজতে নিলেও থানার বাইরে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। তাদের অভিযোগ ওসি নেজাম নগরের বিভিন্ন থানার দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে আওয়ামী লীগের হয়ে নানা নির্যাতন-অত্যাচার চালিয়েছেন। অনেককে মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়েছেন। এ সময় তারা থানা থেকে সাবেক ওসি নেজাম উদ্দীনকে ছেড়ে দেওয়ারও অভিযোগ তোলেন। পরে অবশ্য পুলিশের আশ্বাস পেয়ে থানা প্রাঙ্গণ ছাড়েন বিক্ষুব্ধরা।
থানা প্রাঙ্গণে চকবাজার থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব শহিদুল ইসলাম শহীদ বলেন, ওসি নেজাম বাকলিয়া থাকাকালীন আমাদেরকে যেখানে পেয়েছে সেখানে মেরেছেন। তিনি আমাকে লাঠি দিয়ে গাড়ির ভেতর ঢুকিয়ে মেরেছিলেন। প্রকাশ করলে ঘরের সবাইকে তুলে নেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। কিন্তু সোমবার ঘটনার পর পাঁচলাইশ থানা পুলিশ আমাদের সাথে কথা না বলেই তাকে ছেড়ে দিয়েছেন।
স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা শহিদুল বলেন, আমি পাসপোর্ট অফিসে একটা কাজে গিয়েছিলাম। সেখানে আমরা তাকে দেখতে পাই। তাকে জিজ্ঞেস করেছি, তিনি কোত্থেকে এসেছেন। তিনি বলেন, তিনি ঢাকা থেকে ছুটি নিয়ে এসেছেন। তিনি ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করেছেন। আমরা বলেছি, আপনি আমাদের এত বছর অত্যাচার করছেন আমরাও তো অনুরোধ করে পা পর্যন্ত ধরেছিলাম। আপনি আমাদের ছাড়েননি। তিনি আমাদের বলেন, উপরের নির্দেশ ছিল। এরপর আমি তাকে টেনে নিয়ে আসতেছিলাম। ওসি সোলায়মান ভাই বলেছেন, ছেড়ে দিতে পুলিশের কাছে। কিন্তু আমরা থানায় আসার পর দেখছি তারা ওসি নেজামকে ছেড়ে দিয়েছেন। এটার সুষ্ঠু বিচার না হলে ওসি সোলায়মানকে প্রত্যাহার করতে হবে।
গণঅধিকার পরিষদের এক নেতা বলেন, ২০২১ সালে মোদীবিরোধী আন্দোলন এবং কুমিল্লায় মন্দির ভাঙার মামলায় আমাকে গ্রেপ্তার করেছিলেন কোতোয়ালী থানার সাবেক ওসি নেজাম। অথচ ঘটনাটি ঘটেছিল কুমিল্লায়। থানায় এনে আমাকে সারারাত নির্যাতন করা হয়েছিল। তিনি আমার অন্ডকোষ চেপে ধরলে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। হুঁশ ফিরলে তিনি আমাকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে আমার আরও ১০ সহযোদ্ধাকে গ্রেপ্তার করে। এরপর থানায় নিয়ে আমার দুই হাত বেঁধে এমনভাবে পিটিয়েছেন আমার দুই হাত ফুলে গিয়েছিল। আমি একটা নাপা খেতে চেয়েছিলাম ব্যাথায়, দেননি তিনি।
নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে তিনি আরো বলেন, পরদিন ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। রিমান্ডে নিয়েও অসহ্য নির্যাতন করেছে আমাদের। একজন মারে জ্ঞান হারাই, হুঁশ ফিরলে আবার আরেকজন মারে। তিনমাস জেল খেটে বেরোনোর পর খুন করার হুমকিও দিয়েছিলেন এই ওসি নেজাম। আমরা চাই ওসি নেজামকে ফাঁসি দিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে দেখানো হোক। ফ্যাসিস্টের আমলে যে বা যারাই অপরাধ করেছে তারা ওসি নেজামের মতো শাস্তি পাবে।
এ বিষয়ে জানতে ওসি নেজাম উদ্দিনের মুঠোফোন একাধিকবার কল দিয়েও সংযোগ পাওয়া যায়নি। পাঁচলাইশ থানার পরিদর্শক তদন্ত সাজ্জাদ হোসেন জানান, স্যার পাঁচলাইশ এলাকার একটি স্কুল থেকে তার ছেলেকে আনার সময় এ ঘটনা ঘটে। স্যারকে আমরা হেফাজতে নিয়েছি।
পরিস্থিতি স¤পর্কে জানতে চাইলে সিএমপির উপ-কমিশনার (উত্তর) মুহাম্মদ ফয়সাল আহম্মেদ বলেন, বর্তমানে পরিস্থিতি পুরোপুরি শান্ত আছে। বিক্ষুব্ধরা থানা প্রাঙ্গণ ছেড়ে চলে গিয়েছেন। পুলিশ কর্মকর্তা নেজাম উদ্দীন দামপাড়া পুলিশ লাইন্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
পুলিশ কর্মকর্তা মারধরের ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা নেবেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি আমরা এখনই সিদ্ধান্ত নিচ্ছি না। আমরা আলাপ করবো এ বিষয়ে। উনি এখন চিকিৎসাধীন আছেন। সুস্থ হলে অভিযোগ দিলে তারপর দেখা যাবে।
বিক্ষুব্ধদের গ্রেপ্তার দেখানোর দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা কিভাবে দেখাবো? একটা নালিশি মামলায় (সিআর) কি গ্রেপ্তার দেখানো যায়? নেজাম যে মামলার আসামি মামলাটি আদালতে হয়েছে এবং তদন্তাধীন বিষয়।
জানতে চাইলে নগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক বেলায়েত হোসেন বুলু বলেন, সাংবাদিকদের মাধ্যমে বিষয়টি জেনেছি। দেশে সরকার আছে, আইন আছে। আমাদের কাউকে তো মানুষ ধরে থানায় দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। ঘটনাটি দলীয়ভাবে তদন্ত করা হবে। যারাই জড়িত থাকুক, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানা গেছে, পুলিশ কর্মকর্তা মোহাম্মদ নেজাম উদ্দীন বর্তমানে ঢাকায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) কর্মরত রয়েছেন। এর আগে তিনি চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সবশেষ অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পটিয়া-১২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সামশুল হক চৌধুরীর সঙ্গে গোপন বৈঠকের অভিযোগে ২০২৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর তাকে জেলার বাইরে বদলির আদেশ দেয় নির্বাচন কমিশন। এছাড়া তিনি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কোতোয়ালী, বাকলিয়া ও সদরঘাট থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।