
চট্টগ্রামে গত এক সপ্তাহ ধরে প্রচন্ড গরম অনুভুত হচ্ছে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। যা চট্টগ্রামবাসীর জন্য মরার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিদ্যুৎ লোডশেডিংয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে নেমে এসেছে স্থবিরতা। কলকারখানার উৎপাদনে নেমেছে ধস। আর মানুষের তো প্রাণ যাই যাই অবস্থা।
নগরবাসীর মতে, চট্টগ্রামে রাত-দিন ২৪ ঘণ্টায় রেশনিং পদ্ধতিতে অন্তত ১৬ ঘণ্টা বিদ্যুতের লোডশেডিং করা হচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় সব এলাকায় বিদ্যুৎ আসলে থাকে আধা ঘণ্টা, আর গেলে দুই ঘণ্টায়ও আসে না। এর মধ্যে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা এবং রাত ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত যেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয় সেসব এলাকায় বিশ্রাম ও ঘুম হারাম হয়ে গেছে।
কারণ এই সময়ে শুরু হয় প্রচন্ড গরম। তখন তাপমাত্রা ৩১ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠানামা করে বলে চট্টগ্রাম আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্যে জানানো হয়। আর এ সময় শুরু হয় শ্রমজীবী মানুষের হাঁসফাঁস। এ সময় চট্টগ্রাম শহরের অন্তত দুই তৃতীয়াংশ এলাকায় বিদ্যুৎ থাকে না। যা একেবারে গরমের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো।
বিষয়টি স্বীকার করেছেন চট্টগ্রামের একাধিক বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনে কর্মরত কর্মকর্তারাও। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, চট্টগ্রামে ১৪৫০ মেগাওয়াটের কাছাকাছি বিদ্যুতের প্রয়োজন হলেও জাতীয় গ্রিড থেকে সরবরাহ মিলছে অর্ধেকেরও কম। সে কারণে রাত-দিন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অন্তত ১৬ ঘণ্টা বিদ্যুতের লোডশেডিং করা হচ্ছে।
তবে বিষয়টি মানতে নারাজ চট্টগ্রাম আঞ্চলিক বিদ্যুৎ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মাইন উদ্দিন। তিনি বলেন, চাহিদার তুলনায় চট্টগ্রামে ২৮০ মেগাওয়াট কম বিদ্যুৎ সরবরাহ পাচ্ছি আমরা। সে অনুযায়ী বিদ্যুতের লোডশেডিং করা হচ্ছে। তবে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনে ত্রুটি থাকায় সরবরাহে সমস্যা হতে পারে। এতে কোন কোন এলাকায় বিদ্যুতের লোডশেডিং একটু বেশি হতে পারে। তবে এই লোডশেডিং অসহনীয় মাত্রায় নয়।
প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম একটি বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত এলাকা। চট্টগ্রামে সব মিলিয়ে দুই হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। যা জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ হয়। জাতীয় গ্রিড থেকে চট্টগ্রাম ১১৫০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ সরবরাহ পাচ্ছে। তবে চট্টগ্রামে ১৪৫০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে।
এদিকে বিদ্যুৎ লোডশেডিংয়ের কারণে নগরীর শ্রমজীবি মানুষের যেমন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা চলছে, তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে এসেছে। এমনকি কলকারখানার উৎপাদনেও ধস নেমেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও কলকারখানার মালিকরা।
এরমধ্যে বিজেএমইয়ের প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে চট্টগ্রামে পোশাক কারখানার উৎপাদন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। ডলার সংকটের কারণে একদিকে রফতানি কমে গেছে। অর্ডার কমেছে। তম্মধ্যে লোডশেডিং যেন মরার ওপর খাড়ার ঘা এর মতো হয়ে দাড়িয়েছে।
নগরীর বেকারি পণ্য ফুলকলির জিএম আবদুস সবুর বলেন, বিদ্যুৎ লোডশেডিংয়ের কারণে প্রতিষ্ঠানের কারখানার মেশিন অচল হয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ আসলে মেশিন চালু করতে না করতে আবার বিদ্যুৎ চলে গিয়ে বন্ধ হয়ে পড়ছে। এতে কারখানার উৎপাদনে ধস নেমেছে।
নগরীর ফিনলে স্কয়ারের বিবো মুঠোফোন শো-রুমের বিক্রেতা আজাদুর রহমান বলেন, সকাল ৯টার সময় দোকান খুললেও বিদ্যুৎ না থাকার কারণে বেশিরভাগ সময় অন্ধকারে বসে থাকতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ একবার গেলে দুই ঘন্টায়ও আসে না। দোকানের আইপএিসও এতক্ষণ সময় কাভার দেয় না। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য লাঠে উঠেছে।
চট্টগ্রাম শপিং কমপ্লেক্সের কাপড়ের দোকানদার নজরুল ইসলাম বলেন, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সারাদিনে দুই ঘন্টা বিদ্যুৎ থাকে না। অন্ধকারে ডুবে থাকে মার্কেট। বিকেল হওয়ার আগেই মার্কেট বন্ধ করে ব্যবসায়ীদের চলে যেতে হয়। গত এক সপ্তাহ ধরে এ অবস্থার কারণে বেচা-কেনা নেই দোকানে।
চট্টগ্রাম মহানগরীর চান্দগাঁও আবাসিক এ বøকের গৃহীনি ফারজানা আক্তার বলেন, রাত-দিন ২৪ ঘন্টার মধ্যে বিদ্যুৎ আসলে থাকে আধা ঘন্টা। গেলে দুই ঘন্টায়ও আসে না। এ অবস্থায় ঘরের মধ্যে ছেলে-মেয়ে নিয়ে বসে বসে ঘামতে হয়। এতে সর্দিকাশিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছি। ফ্রিজে রাখা খাবার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি একেবারে অসহনীয়।
তিনি বলেন, একদিকে গরমের প্রভাব। অন্যদিকে বিদ্যুতের লোডশেডিং। গত এক মাস আগে শুনেছি কয়লার অভাবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে পড়ায় লোডশেডিং হয়েছে। এখন গণমাধ্যমে দেখছি, বিদেশ থেকে একের পর এক জাহাজভর্তি কয়লা আসছে। এরপরও এত লোডশেডিং কেন বুঝি না। ২০০৭ সালের আগেও এমন লোডশেডিংয়ের কারণে মানুষ বিএনপি-জামায়াতকে ভোট দেয়নি। এই সরকারের অবস্থাও দেখছি একইরকম।
গত এক সপ্তাহ ধরে চট্টগ্রামে গরম বাড়ার তথ্য জানিয়েছেন চট্টগ্রাম আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ বিশ্বজিৎ চৌধুরী। তিনি বলেন, গত এক কয়েকদিন আগেও চট্টগ্রামের তাপমাত্রা ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে ছিল। বর্তমানে তা বেড়ে ৩১ ডিগ্রির উপরে উঠেছে। যা সকাল ১১টা থেকে ৩৪ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় চট্টগ্রামে অসহনীয় মাত্রার গরম অনুভুত হচ্ছে। এই অবস্থায় চট্টগ্রামে বিদ্যুতের লোডশেডিংও বেড়েছে বলে জানান তিনি।