চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানার উত্তর চান্দগাঁও বড়বাড়ী নাথপাড়া এলাকায় ঘোষিত অর্পিত সম্পত্তি বিক্রি করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে ভুমিদস্যু চক্র। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভিপি শাখার অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে জাল কাগজ সৃজনের মাধ্যমে এই অর্পিত সম্পত্তি বিক্রীর মহৌৎসবে মেতে উঠেছে ভুমিদস্যুরা।

এই ভুমিদস্যু চক্রের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেইসসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকলেও তার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শণ করে আসছেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভিপি শাখার কর্মকর্তারা। এমনিক চান্দগাঁও সার্কেল ভুমি অফিসের কর্মকর্তার প্রতিবেদনে অর্পিত সম্পত্তি বিক্রীর সত্যতা উল্লেখ থাকলেও তা নজরে আনছে না।

স্থানীয় লোকজনের তথ্যমতে, উত্তর চান্দগাঁও বড়বাড়ী নাথপাড়া এলাকার তপন কুমার নাথ (৬৪) ও স্বপন নাথসহ (৬২) স্থানীয় দৃষ্কৃতিকারীদের সংঘবদ্ধ একটি সিন্ডিকেট পাকিস্তান আমলে ঘোষিত মূল্যবান অর্পিত সম্পত্তি বিক্রী করে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কর্মকান্ডে লিপ্ত রয়েছে। ইতিমধ্যে তারা জাল কবলা ও খতিয়ানে শিমুল কান্তি নাথ (৫০) নামে এক ব্যক্তির কাছে ০১৭১ শতাংশ জমি ৩৩ লাখ ৬২ হাজার টাকায় বিক্রয় করেছেন।

একইভাবে কৃষ্ণ নামে এক ব্যক্তির কাছেও ০১৬০.১ শতাংশ নাল জমি দশ লাখ টাকায় বিক্রয় করেছেন। যার উপর শিমুল কান্তি নাথ চার তলা ভবন ও কৃষ্ণ একাধিক পাকাগৃহ-দোকান পাট নির্মাণ করে জোরপূর্বক ভোগ দখল করে আসছেন। একইভাবে তপন কুমার নাথ ও স্বপন কুমার নাথ ০.০১৫০ একর জমি দখল করে সেমিপাকা দোকান ও ভাড়া ঘর নির্মাণ করে ভোগ দখল করে আসছেন।

এ নিয়ে গত বছর ২৫ মে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভিপি শাখায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন ঘোষিত অর্পিত সম্পত্তির মালিকপক্ষের ওয়ারিশ নয়ন দেবনাথ। অভিযোগটির মামলা নং ৮৩/৮০-৮১, ৮৩/৮১০৮২। অভিযোগে বলা হয়, চান্দগাঁও অফিসের আওতাধীন চান্দগাঁও মৌজার আর, এস খতিয়ান নং ৩৪৯৭ আর. এস দাগ নং ২৪৪৮ বি.এস দাগ নং ১২৬৮, জমির পরিমান ০.০১৭১ একর বাড়ী ভিটা ও ৭০৮ বর্গফুট পাকা গৃহ শ্রেণীর ভূমি জনৈক তপন কুমার নাথ কর্তৃক জালিয়াতিক্রমে অবৈধভাবে দলিল সৃজন করে হস্তান্তর করেছেন। মামলাটি তদন্ত করে চান্দগাঁও সার্কেলের সহকারি ভুমি কমিশনারকে প্রতিবেদন প্রেরণের আদেশ দেওয়া হয়।

কিন্তু দীর্ঘ ৬ মাস অতিবাহিত হওয়ার পর বিষয়টি চান্দগাঁও ভুমি অফিসের ভুমি সহকারি কর্মকর্তা মো. ইমাম উদ্দিন তদন্ত করে গত বছর ১৫ নভেম্বর চান্দগাঁও সার্কেলের সহকারি ভুমি কমিশনারের কাছে প্রেরণ করেন। সহকারি ভুমি কমিশনার ফেরদৌস আরা প্রতিবেদনটি ভিপি শাখায় প্রেরণ করেন। এই প্রতিবেদনে জাল জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া কবলা ও খতিয়ান সৃজন করে এই অর্পিত সম্পত্তি বিক্রির সত্যতা পাওয়ার তথ্য উল্লেখ রয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্ণিত বি.এস ৩০০৪ নং খতিয়ানে ১২৬৮ দাগের ০.১৪ একর জমি শ্রেণী বাড়ী হিসেবে নিকুঞ্জ দেবনাথ গং।। (আট আনা) ও সুবল চন্দ্র নাথ। (চার আনা), পিং-ব্রজ নাথ, জ্ঞানদবালা দেবী। (চার আনা), জং- শশী মোহন নাথ হাল সাং ভারত পক্ষে বাংলাদেশ সরকার।। (আট আনা) হিস্যাংশ মতে শুদ্ধরূপে জরিপ লিপি চুড়ান্ত প্রচারিত আছে।

কিন্তু বি.এস মালিক সুবল নাথ ও জ্ঞানদা বালা দেবী বিগত ০৬ সেপ্টেম্বর ১৯৬৫ ইং হতে ১৬ ফ্রেব্রুয়ারী ১৯৬৯ ইং তারিখের মধ্যে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান তথা স্বদেশ ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের নাগরিত্ব গ্রহণ করেন। ফলে নালিশী দাগের।। (আট আনা) অংশ ০.০৭ একর ও অন্যান্য দাগাদির স¤পত্তিসহ সরকার কর্তৃক অনাবাসিক স¤পত্তি হিসেবে ভিপি শুমারী তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়।

ভারতবাসী সুবল চন্দ্র নাথ এর স¤পত্তি ভিপি ক তালিকার গেজেটে সাবেক পি. এস ৬১৭ নং খতিয়ান ভুক্ত পি. এস ১৬৬৭ দাগের সামিল বি. এস ১২৬৮ দাগের আন্দর ০.০৭ একর ও অন্যান্য দাগাদির জমিসহ মোট ১.৫৫৫০ একর জমি গেজেট তালিকার পৃষ্ঠা নং- ৯২৪৮ ও ৯২৪৯ এবং ক্রমিক নং-২৮৯ এ অন্তর্ভুক্ত হয়। উক্ত ভিপি স¤পত্তিতে সরকারের যাবতীয় স্বত্ব স্বার্থ দখল ও নিয়ন্ত্রণ বিদ্যমান থাকাবস্থায় ভারতবাসী সুবল চন্দ্রের ওয়ারিশগন স¤পূর্ণ বেআইনিভাবে এবং জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে সরকারি ক তালিকা ভুক্ত ভিপি স¤পত্তি রেজিস্ট্রি দলিল নং-৬১৭৪/২০২২ তাং-১৮/১০/২০২২ মূলে ০.০১৭১ একর জমি জনৈক শিমুল কান্তি নাথ, পিতা- হিমাংসু বিমল নাথ বরাবরে বিক্রয় করেন।

তর্কিত ভিপি স¤পত্তি ওয়ারিশ সূত্রে বিক্রয় করার আইনগত অধিকার কবলা দাতা তপন কুমার নাথ ও স্বপন কুমার নাথ পিতা- সুবল চন্দ্র নাথ এর নাই। তর্কিত স¤পত্তি ডিপি মামলা নং-৮৩/৮০-৮১ মূলে সরকারের ইজারাকৃত স¤পত্তি হওয়ায় আলোচ্য বি. এস ১২৬৮ দাগের আন্দর ০.০১৭১ একর জমি নিয়ে সৃজিত বিক্রিত দলিল নং-৬১৭৪, তাং-১৮/১০/২২ জাল ফেরবী এবং কু-উদ্দেশ্যে সরকারি স্বার্থ গ্রাস কারার সামিল মর্মে প্রতীয়মান হয়।

তদন্তকালে একই ভিপি মামলা ভুক্ত বি. এস ১২৮৩ দাগের আন্দর ০.০১৬০ একর ভিপি স¤পত্তি অভিযুক্ত ব্যক্তিগণ কর্তৃক জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে অন্য একটি রেজিস্টি দলিল নং-৬৮১৯, তাং-১৩/১১/২০২২ মূলে হস্তান্তরের প্রমাণ পাওয়া যার (অনুলিপি সংযুক্ত)। এ অফিসের রেজিস্টার ২ (তলববাকি) পরীক্ষান্তে দেখা যায়, অভিযুক্ত ব্যক্তিগন বর্ণিত ভিপি স¤পত্তির ভূমি উন্নয়ন কর কিংবা লিজ ফি পরিশোধ করেননি।

সরেজমিন তদন্তক্রমে দেখা যায়, তর্কিত বি. এস ১২৬৮ দাগের ০.১৪ শতক জমিতে শিমুল দেবনাথ, পিতা-হিমাংসু নাথ, ০.০২ একর (ভিপি স¤পত্তি) জমির উপর ৪ (চার) তলা ভবন, প্রদীপ নাথ, পিতা- মৃত প্রসন্ন নাথ ০.০২ একর (মালিকানা স¤পত্তি) জমির উপর সেমিপাকা ঘর, তপন কুমার নাথ, স্বপন কুমার নাথ, পিতা- সুবল নাথ ০.০১৫০ একর (ভিপি স¤পত্তি) জমির উপর সেমিপাকা দোকান ও ভাড়া ঘর, রতন দেব নাথ গং, পিতা-মৃত শশাংক নাথ ০.০১৫০ একর (মালিকানা স¤পত্তি) জমির উপর বেড়ার ঘর, দুলাল কুমার নাথ, পিতা- নন্দ কুমার নাথ ০.০১৫০ একর (মালিকানা স¤পত্তি) জমির উপর দোতলা পাকা ঘর, মন্টু গং, পিতা- প্রফুল¬ নাথ, ০.০১ একর (ভিপি স¤পত্তি) জমির উপর বেড়ার ঘর, দূর্গা মন্দির ০.০২৫০ একর (ভিপি স¤পত্তি) জমির উপর, বিপ্লব নাথ ও রাসেল নাথ, পিতা- হরি শংকর নাথ ০.০১ একর (মালিকানা স¤পত্তি) জমির উপর সেমিপাকা ঘর ও খালি জমি, সুনীল গং, পিতা- মৃত রেবতী মোহন নাথ ০.০১ একর (মালিকানা স¤পত্তি) খালি জায়গা দখলে আছেন।

এমতাবস্থায় দাখিলীয় দলিলপত্র, ভিপি ক তপশিলের গেজেট তালিকা, রেজিস্ট্রি দলিল নং-৬১৭৪, তাং-১৮/১০/২২ ও ৬৮১৯, তাং-১৩/১১/২০২২, পি. এস ও বি. এস খতিয়ান ও বাস্তব দখল সার্বিক পর্যালোচনায় দাখিলীয় অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। সরকারী ভিপি স¤পত্তি অবৈধ দখলকার ও জাল জালিয়াতির মাধ্যমে নানা রকম ফেরবী দলিল সৃজন করার দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিগণের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

এদিকে প্রতিবেদন প্রেরণের পর তিন মাস অতিবাহিত হলেও জাল জালিয়াতির মাধ্যমে সরকারি ভিপি সম্পত্তি বিক্রয়কারী ভুমিদস্যু চক্রের হোতা তপণ কুমার নাথ, স্বপন নাথ, শিমুল কান্তি নাথ ও কৃষ্ণের বিরুদ্ধে অদ্যাবধি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে ভুক্তভোগী পক্ষ গত ৩১ ডিসেম্বর সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের জুডিশিয়াল বেঞ্চ বিচারপতি মিসেস নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিনাত হক এর আদালতে এ বিষয়ে একটি রীট আবেদন করেন।

জুডিশিয়াল বেঞ্চের বিচারপতি এ বিষয়ে অর্পিত সম্পত্তি বিক্রয় ও ভোগ দখলের দায়ে বিবাদির বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল মামলা দায়েরসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ভিপি শাখাকে আদেশ দেন। আদেশের কপি গত ২১ জানুয়ারি রিসিভ করেন ভিপি শাখা। সেই থেকে গত দুই মাস অতিবাহিত হলেও উচ্চ আদালতের আদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কোনরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভিপি শাখার অফিস সহকারি আনোয়ার হোসেন ও মো. হেনার সহযোগীতায় অর্পিত সম্পত্তি শাখার একাধিক কর্মকর্তা তপন কুমার নাথ ও স্বপন কুমার নাথের নেতৃত্বে পরিচালিত ভুমিদস্যু সিন্ডিকেটে জড়িত।

এ বিষয়ে জানতে গত ১৯ মার্চ সোমবার দুপুরে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের অর্পিত সম্পত্তি শাখার অফিস সহকারি আনোয়ার হোসেনের সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি আমি জানি। এ সংক্রান্ত ফাইলটিও আমার কাছে আছে। কাজটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তবে এ বিষয়ে সাংবাদিকের সাথে কথা বলার এখতিয়ার আমার নেই। এ সময় তিনি সহকারি কমিশনারের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন।

কিন্তু ওইদিন ১৯ মার্চ সোমবার ও ২০ মার্চ মঙ্গলবার দুপুরে অফিসে গিয়েও সহকারি কমিশনার রাজীব হোসেনের সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি। দুইদিনই তিনি অফিসের কাজে অফিসের বাইরে ছিলেন বলেন জানান অফিস সহকারী আনোয়ার হোসেন। পরে ফোনে কথা বলার জন্য মুঠোফোনে কল দিলেও তিনি কোনরকম সাড়া দেননি।

জমি ক্রয়ের ব্যাপারে জানতে শিমুল কান্তি নাথের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। তবে জমি ক্রয়ে রেজিষ্ট্রীকৃত দলিলে স্বাক্ষী থাকা তাপস কুমার নাথ বলেন, যাদের জমি তারা বিক্রী করেছে। অর্পিত সম্পত্তি হলে তো বিক্রয় করতে পারত না। তবে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য আমি শিমুল কান্তি নাথকে বলব। কিন্তু এরপরে শিমুল কান্তি নাথ এবং তাপস কুমার নাথ কেউ কোনো কথা বলেননি।

এ বিষয়ে জানতে ভুমি বিক্রয় দাতা তপন কুমার নাথকে ফোন করা হলে তিনি মোবাইলে এ বিষয়ে কথা বলা সম্ভব নয় জানিয়ে দেখা করতে বলেন। একই কথা বলেছেন স্বপন নাথও। কিন্তু পরে তাদের কেউ সাড়া দেননি।

ঈশান/সুম/খম