নব্বই দশকের পরেও যে ফ্ল্যাটটি প্রতি স্কয়ারফিট তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছিল, সে ফ্ল্যাট এখন বিক্রি হচ্ছে ৭ হাজার থেকে সাড়ে ৭ হাজার টাকায়। কোন কোন ক্ষেত্রে তা ৮ হাজার টাকাও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সে হিসেবে ১২০০ স্কয়ারফিটের ফ্ল্যাট এখন কিনতে খরচ পড়ছে ৮৪ থেকে ৯৬ লাখ টাকা।
যা চট্টগ্রামের মানুষের নাগালের বাইরে। যার মধ্যে মধ্যবিত্তরাই বেশি। কারণ মূল্যস্ফীতির কারণে খরচ বেড়ে যাওয়ায় একদিকে মানুষের সঞ্চয় কমছে। অন্যদিকে নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির কারণে ফ্ল্যাটের দাম বেড়ে যাওয়ায় মধ্যবিত্তরা এখন ফ্ল্যাট কেনার সাহসই করতে পারছেন না।
যদিও ভিন্ন কথা বলছেন চট্টগ্রামের মধ্যবিত্তরা। তাদের ভাষ্য, শুধু নির্মাণ সামগ্রী নয়, চট্টগ্রামে জমির মূল্যও অনেক। যা শুধু বাড়ছেই। এর জন্য দায়ী আবাসন খাতের প্রতিষ্ঠান বা ডেভলেপাররা। যারা সরকারি মৌজা রেটের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে জমি কিনে আবাসন ভবন বা বাড়ি নির্মাণ করছে। চড়া দামে বিক্রি করছে ফ্ল্যাট হিসেবে।
চট্টগ্রাম মহানগরের ফরিদা পাড়া এলাকার বাসিন্দা সাইফুদ্দিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার পাশে হওয়ায় ফরিদের পাড়া এলাকায় জমির দাম প্রতি শতক এখন ৫০ লাখ টাকার উপরে। মানে এক গন্ডা জমি এখন কোটি টাকার উপরে। আর চান্দগাঁও আবাসিক এলাকায় প্রতিগন্ডা জমি ২ থেকে ৩ কোটি টাকা। অথচ মৌজা রেট ৩০ লাখ টাকার নিচে। ফরিদের পাড়া এলাকার জমির মৌজা রেট ১৫ লাখ টাকার নিচে। ফলে জমির মালিকরা বসে থাকেন ডেভেলেপারের কাছে জমি বিক্রির আশায়। এই ডেভলেপারের দৌরাত্ন্যে নির্মাণ সামগ্রীর দামও বেড়েছে। ফলে উচ্চবিত্তরা পর্যন্ত জমি কিনে একা বাড়ি নির্মাণ করার সাহস করছে না। আর মধ্যবিত্তদের একরকম নাগালের বাইরে চলে গেছে বাড়ি করা।
তিনি বলেন, জমির মূল্য ও নির্মাণ খরচ বাড়ানো ডেভলেপারদের একটি অপকৌশল। এ কারণে চট্টগ্রামের উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্তরা ডেভলেপারদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এ সুযোগে ডেভলেপাররা নব্বই দশকের পরেও যে ফ্ল্যাট প্রতি স্কয়ারফিট তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায় বিক্রি করেছিল, সে ফ্ল্যাট এখন ৭ হাজার থেকে সাড়ে ৭ হাজার টাকায় বিক্রি করছে। কোন কোন ক্ষেত্রে তা ৮ হাজার টাকাও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সে হিসেবে ১২০০ স্কয়ারফিটের ফ্ল্যাট এখন কিনতে খরচ পড়ছে ৮৪ থেকে ৯৬ লাখ টাকা। দুই-তিন বছর আগেও ১২০০ স্কয়ারফিটের একটি ফ্ল্যাট ৬০ থেকে ৬৫ লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
নিজের একটি ফ্ল্যাট হবে কয়েক বছর ধরে এমন স্বপ্ন দেখে আসছেন সরকারি চাকরীজীবী তারেক মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘আগে ইচ্ছে ছিল অবসরে যাওয়ার পর এককালীন পাওয়া অর্থ দিয়ে শহরে একটি ফ্ল্যাট কিনব। কিন্তু ফ্ল্যাটের দাম এখন এত বেশি বেড়েছে, শহরে নিজের একটি ফ্ল্যাট হবে সেই স্বপ্নই দেখতে পারছি না। কারণ একটি ফ্ল্যাট কিনতে গেলে এখন কমপক্ষে ৮০ লাখ থেকে কোটি টাকা গুনতে হবে।’
তবে আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, নির্মাণসামগ্রীর দাম বৃদ্ধির কারণে ভবন নির্মাণে খরচ বেড়ে গেছে। আগে প্রতি স্কয়ারফিট নির্মাণে খরচ হতো এক হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা, এখন খরচ হয় ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকা। জায়গার মালিককে সমান সংখ্যক ফ্ল্যাট দিতে হয় বিধায় এ খরচ গিয়ে দাঁড়ায় ৬ হাজার থেকে সাড়ে ৬ হাজার টাকায়। ভবন নির্মাণে খরচ বেড়ে যাওয়ায় এখন দাম বাড়ছে ফ্ল্যাটের।
আবাসন ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, বছর বছর বাড়ছে নির্মাণসামগ্রীর দাম। তিন বছর আগে যেখানে প্রতি বস্তা সিমেন্ট ৩৯০ থেকে ৪২৫ টাকায় কেনা যেত, সেখানে এখন প্রতি বস্তা সিমেন্ট কিনতে খরচ হয় ৫০০ থেকে ৫৮০ টাকা। তিন বছর আগে একটি ইটের দাম ছিল ৮ থেকে ১০ টাকা, সেই ইট কিনতে এখন খরচ হয় ১২ থেকে ১৫ টাকা। একইভাবে বাড়ছে বালু, পাথর, টাইলস, ইলেকট্রিক পণ্যসহ সব ধরনের উপকরণের দাম। তাতে বছর বছর বাড়ছে ফ্ল্যাটের দাম।
ইস্ট ডেল্টা হোল্ডিংস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল গাফফার মিয়াজী বলেন, ‘গ্রাহকরা খুঁজেন কম দামের ফ্ল্যাট। খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে আমাদের পক্ষে সেটি সম্ভব হয় না। একদিকে ফ্ল্যাটের দাম বৃদ্ধি, অন্যদিকে দ্রব্যমূলের দামের কারণে গ্রাহকের খরচ বেড়ে যাওয়ায় ফ্ল্যাট বিক্রিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সাশ্রয়ী মূল্যে আবাসন দিতে হলে সরকারকে একটি মাস্টারপ্ল্যান বা মহাপরিকল্পনা করতে হবে। আমাদের জমির পরিমাণ তো আর বাড়বে না। সেজন্য খুব পরিকল্পনা করে জমি ব্যবহার করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ‘সুদের হার বৃদ্ধির কারণে লোকসানে পড়ে চট্টগ্রামে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দেউলিয়ার পথে। একটি প্রতিষ্ঠান ৮ শতাংশ সুদে ঋণ নেওয়ার পর এটা বেড়ে হচ্ছে ১৫ শতাংশ। হুট করে সুদ বেড়ে গেলে তখন প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসানে পড়ে। অতিরিক্ত সুদের কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নও কমে যাচ্ছে। তাই সরকারের কাছে আমাদের আবেদন আবাসন খাতের জন্য তারা যেন কম সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের ব্যবস্থা করেন।’
You cannot copy content of this page