চট্টগ্রামে চলতি মৌসুমে তেমন একটা বৃষ্টি হয়নি। এমনকি ঘূর্ণিঝড় রিমেলেও বৃষ্টিপাত হয়েছিল সামান্যই। এরই মধ্যে হঠাৎ গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে অঝোর ধারায় শুরু হয় বজ্রবৃষ্টি। তবে বুধবার (১৯ জুন) সকাল থেকে বৃষ্টি ফের উধাও। যদিও দিনভর আকাশ ছিল মেঘলা।
তম্মধ্যেই চট্টগ্রাসহ দেশের তিন জেলায় তিনদিনের ভারী বর্ষণের পূর্বাভাস দেয় আবহাওয়া অধিদফতর। সেই সাথে পাহাড় ধসের সতর্কতাও জারি করে। এরপর আলোচনায় আসে চট্টগ্রাম মহানগরীর ২৬ পাহাড়ের মরণফাঁদে বসবাসরত ৬ হাজার ৫৫৮ পরিবারের জীবন রক্ষার বিষয়টি। যা নিয়ে চিন্তিত চট্টগ্রামের সচেতন মহল।
তাদের মতে, চট্টগ্রাম মহানগরে সরকারি-বেসরকারি মালিকানাধীন ঝুঁকিপূর্ণ মোট ২৬টি পাহাড় আছে। এসব পাহাড়ে বাস করে ৬ হাজার ৫৫৮টি পরিবার। ২৬ পাহাড়ের মধ্যে ১৬টি সরকারি সংস্থার ও ১০টি ব্যক্তিমালিকানাধীন। পাহাড়গুলো এসব পরিবারের জন্য মরণফাঁদ। কারণ বৃষ্টি হলেই চট্টগ্রামে শুরু হয় পাহাড় ধসের ঘটনা। ঘটে প্রাণহানী।যদিও এসব পরিবারকে রক্ষার লক্ষ্যে গঠিত চট্টগ্রাম পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির কোন সাড়া শব্দ নেই এখনো পর্যন্ত। ঝুঁকিপূর্ণ বসতিদের নিয়ে চিন্তার ছাপ শুধু পরিবেশবাদী মানবিক মানুষগুলোর।
অভিযোগ রয়েছে, সরকারি-বেসরকারি মালিকানাধীন পাহাড়গুলোতে অবৈধভাবে দেওয়া হয় বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ। ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে রীতিমতো বিদ্যুতের খুঁটি স্থাপন করেই দেওয়া হয় বিদ্যুৎ। পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রতিটি সভায় সেবা সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরা বিভিন্ন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু কার্যত তা বাস্তবায়ন করা হয় না। ফলে দিনের পর দিন ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে পাকাপোক্ত হয়ে বাস করেন অবৈধ বাসিন্দারা।
শুধু তাই নয়, ২০০৭ সালের জুন মাসে গঠিত পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি গত ১৭ বছরে ২৭টি সভা করেছে। সর্বশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয় গত বছরের ৮ আগস্ট। প্রতিটি সভায় ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় থেকে অবৈধ বসবাসকারীদের উচ্ছেদ, গ্যাস-বিদ্যুৎ ও ওয়াসার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এসব সিদ্ধান্ত আলোর মুখ দেখেনি। তাছাড়া সেবা সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে বিষয়টা নিয়ে অবহেলা করার অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
সূত্র মতে, চট্টগ্রামে বৃষ্টি কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলেই তৈরি হয় পাহাড় ধসের শঙ্কা। শুরু হয় ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বসবাসকারীদের অন্যত্র সরানোর কাজ। পরিচালিত হয় উচ্ছেদ অভিযান। কিন্তু দুর্যোগ শেষ হলেই সবকিছু আবারও স্বাভাবিক হয়ে যায়। ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলোতেই ফের শুরু হয় বসবাস।
এদিকে আবহাওয়া বার্তায় বলা হয়েছে, চট্টগ্রামে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামবে। সক্রিয় মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বুধবার (১৯ জুন) থেকে আগামী ৭২ ঘণ্টায় ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে। সেইসাথে পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও পাহাড় ধস বা ভূমি ধসের শঙ্কার কথাও জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর।
এরই মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় (দুপুর ১২টা পর্যন্ত) চট্টগ্রামে ৩১ দশমিক ৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। মেঘলা আকাশ, আবহাওয়া অধিদফতরের বার্তা জানান দিচ্ছে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনার কথা। কক্সবাজারের উখিয়ায় পাহাড়ধসে ১০ জনের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে বুধবার সকালে।
আবহাওয়াবিদ মো. শাহীনুল ইসলামের ভাষ্য, সক্রিয় মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে চট্টগ্রাম বিভাগে বুধবার (১৯ জুন) থেকে পরবর্তী ৭২ ঘণ্টায় ভারী (৪৪-৪৮ মিলিমিটার) থেকে অতি ভারী (৮৯ মিলিমিটারের উপরে) বর্ষণ হতে পারে। ভারী বর্ষণের কারণে চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও ভ‚মি ধসের সম্ভাবনা রয়েছে।
অথচ এখনও পর্যন্ত পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির কোনো সাড়াশব্দ নেই। চলতি বছরে পাহাড় ব্যবস্থাপনার কোনো সভাও হয়নি। জেলা প্রশাসন, চসিক, সিডিএ, ওয়াসা ছাড়াও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার মনোনীত কমিটির সদস্যরা এখনো ঘুমে।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস কর্মকর্তা মো. জহিরুল ইসলাম প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমরা প্রশাসনকেও আবহাওয়া পূর্বাভাসের মেইল পাঠাই। তাদেরকে ভারী বৃষ্টি ও পাহাড় ধসের সম্ভাবনার কথা জানানো হয়েছে।
একই প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ভারী বৃষ্টিপাত কিংবা পাহাড় ধসের বিষয়টি জানা ছিল না। এখনই জানলাম। দেখি এ নিয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়। ব্যবস্থা নিলে জানানো হবে।
তবে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব মো. আবদুল মালেক বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় থেকে অবৈধভাবে এবং ঝুঁকি নিয়ে বসবাসকারীদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরানোর কাজ শুরু হয়েছে সম্প্রতি। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় শুকনো খাবারের ব্যবস্থাও করা হয়। তাছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বসবাসকারীদের উচ্ছেদ কার্যক্রমও চলমান।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মো. ফখরুজ্জামান বলেন, ভারী বর্ষণজনিত কারণে পাহাড় ধসের সতর্কবার্তার পর চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকার পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সে হিসেবে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের লোকজন ঝুঁকিপূর্ণ বসুতিদের সরিয়ে নিতে কাজ শুরু করেছেন।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন পাহাড়ের পাদদেশে এখনো কয়েক হাজার পরিবার ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাস করে আসছেন। যাদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এক হাজারের অধিক আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে। সেখানে পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা করেছি। আশ্রয় নেওয়া জনগণ যাতে দুর্ভোগে না পড়েন এর জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তাছাড়া লালখান বাজার এলাকার বাটালি হিলে, বায়েজিদ থানার মাঝিরঘোনা, কুসুমবাগ এলাকা, ফিরোজশাহ কলোনি, আমিন কলোনিসহ বিভিন্ন পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে থাকা পরিবারকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। পাশাপাশি এই ব্যাপারে সহযোগিতা করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রত্যেককে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মানুষের জানমাল রক্ষায় আমরা সব সময় জিরো টলারেন্সে রয়েছি। আমরা চাই না কারও বিন্দু মাত্র ক্ষতি হোক।
উল্লেখ্য, ২০০৭ সালে এক দিনেই পাহাড় ধসে নারী, শিশুসহ মারা যান ১২৭ জন। ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট লালখান বাজার মতিঝর্ণা এলাকায় পাহাড় ধসে মৃুত্যু হয় চার পরিবারের ১২ জনের। ২০১১ সালের ১ জুলাই টাইগার পাস এলাকার বাটালি হিলের ঢালে পাহাড় ও প্রতিরক্ষা দেয়াল ধসে মারা যান ১৭ জন। ২০১২ সালের ২৬-২৭ জুনে মারা যান ২৪ জন। ২০১৩ সালে মতিঝর্ণায় দেয়াল ধসে মারা যান দুজন। ২০১৫ সালের ১৮ জুলাই বায়েজিদ এলাকার আমিন কলোনিতে মারা যান তিনজন, একই বছর ২১ সেপ্টেম্বর বায়েজিদ থানার মাঝিরঘোনা এলাকায় মা-মেয়ের মৃত্যু হয়। ২০১৭ সালের ১২ ও ১৩ জুন রাঙামাটিসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের পাঁচ জেলায় পাহাড়ধসে প্রাণ হারান ১৫৮ জন। ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর নগরীর আকবরশাহ থানাধীন ফিরোজশাহ কলোনিতে মারা যান চারজন। ২০১৯ সালে কুসুমবাগ এলাকায় মৃত্যু হয় এক শিশুর। ২০২২ সালের ১৮ জুন মৃত্যু হয় চারজনের।
You cannot copy content of this page