স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারাদেশের মতো চট্টগ্রামেও চাঙা হয়ে ওঠে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা। সেই সঙ্গে নেতাকর্মীদের অনেকেই জড়িয়ে পড়েন নানা অপকর্মে।
চাঁদাবাজি, দখল, বালু তোলা, পাহাড় কাটা, হামলা, ভয়ভীতি প্রদর্শন, এমনকি হত্যাকান্ডে জড়িয়ে পড়েছেন কেউ কেউ। এ পরিস্থিতিতে বেপরোয়া নেতাকর্মীদের ওপর কঠোর হয়ে ওঠে বিএনপির কেন্দ্রীয় হাইকমান্ড। দল থেকে বহিষ্কার করা হয় এদের অনেককে।
এর মধ্যে গত ৫ মাসে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের ৩৯ নেতাকর্মীকে বহিষ্কারের মতো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। এরপরও বেশকিছু এলাকায় থেমে নেই অপরাধ কর্মকান্ড।
বিশেষ করে আওয়ামী লীগের লোকজন বালুমহাল, ইটভাটা, নৌঘাট, ফুটপাত, মাছ বাজারসহ যেসব খাতে চাঁদাবাজি করত সেসব স্থানের দখল নিয়েছে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের কতিপয় নেতাকর্মীরা। যাদের নামের তালিকা তৈরী হয়ে গেছে। তালিকায় চট্টগ্রামের এমন আরও অর্ধশত নেতা রয়েছে বলে জানান চট্টগ্রাম নগর বিএনপির সাধারণ স¤পাদক নাজিমুর রহমান।
তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পর দেশজুড়ে একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ছিল। সেই সময় বুঝে না বুঝে অনেকে স্রোতে গা ভাসিয়েছে। চাঁদাবাজি-দখলবাজির কিছু ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কঠোর নির্দেশনা ছিল-কোনো অবস্থাতেই দলীয় নেতাকর্মীরা কোনো ধরনের অপকর্মে জড়াতে পারবে না। জড়ালেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা ছিল। এ কারণে আমরা যখনই যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়েছি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। দলীয় পদ-পদবি থেকে সরিয়ে দেয়া দিয়েছি।
তিনি জানান, কেন্দ্র থেকেও অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। মূলত এ কারণে দলীয় নেতাকর্মীদের অনেকেই সতর্ক হয়েছেন। বর্তমানে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি বা অপকর্মের অভিযোগ নেই। বিচ্ছিন্ন কিছু অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে কর্ণফুলী ও সাঙ্গু নদির যেখান থেকে আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রী ও নেতারা বালু তোলায় জড়িত ছিল, সেখানে এখন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাদের জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। তাদের তালিকা তৈরী হয়েছে। এদের বিরুদ্ধেও দল থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার চিন্তা-ভাবনা চলছে।
নাজিমুর রহমান জানান, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ এবং দলের নীতি, আদর্শ ও সংহতি পরিপন্থি অনৈতিক কার্যকলাপের দায়ে গত ৭ জানুয়ারি চকবাজার থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব শহীদুল ইসলাম শহীদকে সর্বশেষ বহিষ্কার করা হন। গত ৬ জানুয়ারি সিএমপির কোতোয়ালি থানার সাবেক ওসি মোহাম্মদ নেজাম উদ্দীনকে মারধর ও নাজেহাল করার ঘটনায় দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
এর আগে প্রতিবেশী একজনের জায়গা দখলের অভিযোগে ২৮ নভেম্বর চট্টগ্রাম মহানগর পাহাড়তলী থানার সাধারণ স¤পাদক জসিম উদ্দিন জিয়াকে বহিষ্কার করা হয়। এর আগে ২২ নভেম্বর আওয়ামী লীগ নেতা ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিম এবং তার নেতাকর্মীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে আকবর শাহ থানার সভাপতি আবদুস সাত্তার সেলিমসহ ৪ জনকে অব্যাহতি দেয় বিএনপির কেন্দ্রীয় কমান্ড।
এর আগে গত ২৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম মহানগরীর খুলশী থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক শাহ আলমকে বহিষ্কার করা হয়। এরপরে মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক এসকে খোদা তোতনকে বহিষ্কার, ইসকনের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরকারী ফিরোজ খানকে দল থেকে অব্যাহতি, চবি ছাত্রদলের সাবেক নেতা খোরশেদ আলমকে বহিষ্কার, পরে রাউজানের গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলেসহ তিনজনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এর আগে গত ২১ অক্টোবর আনোয়ারায় কোরিয়ান ইপিজেডে খাবার সরবরাহের কাজ পেতে আমেরিকান অ্যান্ড এফির্ড (বাংলাদেশ) লিমিটেড নামে একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে প্রাণনাশ ও ফ্যাক্টরি বন্ধের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠে উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ২৫ অক্টোবর ইলিয়াস কাঞ্চনকে দলের প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
এর আগে গত ১৯ অক্টোবর কর্ণফুলী থানার জুলধা-চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের সীমানায় অবস্থিত মিনি পার্কের ভেতরে থাকা তিনটি সরকারি পুকুর থেকে মাছ চুরির ঘটনা ঘটে। এই মাছ চুরিতে বিএনপি নেতা জসিম উদ্দিন জুয়েলের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। ২০ অক্টোবর কর্ণফুলী উপজেলার চরলক্ষ্যা ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক স¤পাদক মো. জসিম উদ্দিন জুয়েলকে বহিষ্কার করা হয়।
এর আগে গত ১৯ অক্টোবর চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাবেক সদস্য মামুন আলী ওরফে কিং আলী এবং পাঁচলাইশ থানা বিএনপির গবেষণা-বিষয়ক স¤পাদক হাফিজ উদ্দিন ঝন্টুকে বহিষ্কার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ১৭ অক্টোবর পাহাড়তলীর মোহাম্মদ ট্রেডিং নামে এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ফিল্মি স্টাইলে চাঁদাবাজি করে। এই ঘটনায় মামলাও হয় তাদের বিরুদ্ধে।
এর আগে গত ১৩ অক্টোবর রাতে চট্টগ্রাম মহানগরীর বায়েজিদ বোস্তামী এলাকায় চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারের জেরে নিজ দলের কর্মী মোহাম্মদ সবুজ খুনে বিএনপির তিন অঙ্গসংগঠনের তিন নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তারা হলেন-নগরের পাঁচলাইশ থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. সবুজ, তার ভাই নগর ছাত্রদলের সাবেক সহ-সাধারণ স¤পাদক সাইফুল ইসলাম এবং কৃষক দল নগর শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক শাহ আলম।
এর আগে গত ২৬ সেপ্টেম্বর দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ এবং দলের নীতি, আদর্শ ও সংহতি পরিপন্থি অনৈতিক কার্যকলাপের জন্য চট্টগ্রাম উত্তর জেলার রাঙ্গুনিয়া পৌর যুবদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক মো. গাজী জসিম উদ্দিন, রাঙ্গুনিয়া পৌর স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক মো. কামাল হোসেন, ৭ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ স¤পাদক ইছু সওদাগর, রাঙ্গুনিয়া পৌর যুবদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক গাজী ফরহাদ, বিএনপির সমর্থক মো. পারভেজ, সায়েদ, মো. ফয়েজ এবং মহিউদ্দিনকে বিএনপির প্রাথমিক সদস্যসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। ওইদিন কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ-দফতর স¤পাদক মো. মুনির হোসেন স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
এর আগে গত ২০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম মহানগরের চান্দগাঁওতে টার্ফ (কৃত্রিম ঘাস) দখল নিয়ে যুবদলের দু‘পক্ষের সংঘর্ষে জুবায়ের নামে এক কর্মী খুন হন। এ ঘটনায় ২১ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম মহানগর যুবদলের এক নম্বর যুগ্ম সাধারণ স¤পাদক মোশাররফ হোসাইন ও কৃষি বিষয়ক স¤পাদক নুরুল আমিনকে প্রাথমিক সদস্য পদসহ দলীয় সব পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
এর আগে গত ৬ সেপ্টেম্বর বাসের গতিরোধ করে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৬৫ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ছিনতাইয়ের অভিযোগে চট্টগ্রামের পটিয়া পৌর যুবদলের যুগ্ম-আহ্বায়ক মামুনর রশিদ মামুনকে প্রাথমিক সদস্য পদসহ দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
এর আগে গত ২ সেপ্টেম্বর দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকান্ডে জড়িত থাকার সু¯পষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে বহিষ্কার করা হয় জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দল চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সিনিয়র যুগ্ম স¤পাদক আলী মুর্তজা খানকে। একইভাবে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অবিযোগে ৫ সেপ্টেম্বর উত্তর জেলা যুবদলের সহ-দপ্তর স¤পাদক নাজিম উদ্দীনকে বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় যুবদল।
একই দিন ২ সেপ্টেম্বর বিতর্কিত শিল্প গ্রুপ এস আলমের বিলাসবহুল ১৪টি গাড়ি কারখানা থেকে সরিয়ে নিতে সহযোগিতার অভিযোগে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান, প্রথম যুগ্ম আহ্বায়ক মো. এনামুল হক এনাম ও আহ্বায়ক কমিটির সদস্য এসএম মামুন মিয়ার প্রাথমিক সদস্যসহ সব পর্যায়ের পদ স্থগিত করা হয়। পরে অবশ্য এই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেয় কেন্দ্রীয় বিএনপি।
এর আগে গত ৮ আগস্ট প্রথম বহিষ্কার হয় মহানগর যুবদলের দুই সহসভাপতি নাছির উদ্দীন চৌধুরী নাসিম ও জাহিদ হাসান বাবু। সংগঠনবিরোধী চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগে কেন্দ্রীয় যুবদল তাদের বহিষ্কার করে। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর চট্টগ্রামে এটিই ছিল প্রথম বহিষ্কার।
বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হক এনাম বলেন, এস আলমের গাড়ি সরিয়ে নেওয়ার যে অভিযোগ আমাদের বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল তা মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক ছিল। দলের ভেতরেরই একটি প্রতিপক্ষ এই ষড়যন্ত্র করে। পরে বিএনপি এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি করে। সেই কমিটি সবকিছু তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পায়নি। এ কারণে ৩ মাসের মধ্যে দল থেকে আমাদের অব্যাহতির আদেশ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।ি
You cannot copy content of this page