
# পেলেন সত্যতা, রেকর্ডপত্র জব্দ
# রাগে গজ গজ দুদক টিমের সদস্যরা
চট্টগ্রামে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের শতকোটি টাকার মালামাল ও স্ক্র্যাপের গোপন ভান্ডার খোঁজে পেল দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) টিম। পেলেন সংঘবদ্ধ পাচারকারীর মাধ্যমে স্ক্র্যাপ পাচারের সত্যতাও। জব্দ করলেন রেকর্ডপত্রও।
মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর) দুদকের আভিযানিক টিম রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক, ক্যারেজ ও ওয়াগন কারখানায় দিনভর অভিযান চালায়। অভিযানে নেতৃত্ব দেন দুদকের সহকারি পরিচালক সাইয়েদ মোহাম্মদ ইমরান হোসেন। অভিযানে রেলওয়ে সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দপ্তরের (সরঞ্জাম শাখা), ক্যারেজ ও ওয়াগন কারখানা থেকে স্ক্র্যাপ পাচারের সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র জব্দ করা হয় বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, গত ২৬ সেপ্টেম্বর ‘দৈনিক ঈশানে’ প্রকাশিত ‘চট্টগ্রামে রেলের শতকোটি টাকার স্ক্র্যাপের গোপন ভান্ডার’ শীর্ষক প্রতিবেদন দুদকের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দৃষ্টি গোচর হয়। যার ভিত্তিতে এই অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে সংঘবদ্ধ পাচারকারীর মাধ্যমে স্ক্র্যাপ পাচারের সত্যতা পেয়েছে দুদক টিম। জব্দকৃত রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানান দুদকের এই কর্মকর্তা।
দুদকের তথ্যমতে, দুদুক টিম মঙ্গলবার সকাল ১১টার দিকে রেলওয়ে সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে পৌছে। তখন সেখানে কোন কর্মকর্তাকে পাওয়া যায়নি। তবে সাইফুল ইসলাম নামে একজন ছিলেন দপ্তরে। পরে সহকারি সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক রাহিদ হোসেনের সাথে কথা হয়।
অভিযানে গিয়ে রেলওয়ের পাহাড়তলি ক্যারেজ ও ওয়াগন কারখানায় বিকেসি গাড়িসহ গোপনে মজুদ করা স্ক্র্যাপ শনাক্ত করা হয়েছে। এ বিষয়ে ক্যারেজ ও ওয়াগন কারখানার এক কর্মকর্তা জিল্লুর রহমানের সাথে কথা হয়। এরপর জেলা সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দপ্তরের (সরঞ্জাম শাখা) পরিদর্শক সাজ্জাদুল ইসলামের সাথে কথা বলে এ সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র জব্দ করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলওয়ে সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, দুদক আসার খবরে সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক, ক্যারেজ ও ওয়াগনের অধিকাংশ কর্মকর্তা অফিস ছেড়ে পালিয়ে যান। প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক বেলাল হোসেন তখন ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। আর প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দপ্তরের (ইন্সপেকশন) সহকারী পরিদর্শক রফিক উল্লাহ ছুটিতে ছিলেন। রফিক উল্লাহর সাথে কথা বললে সাজ্জাদুল ইসলামের দূর্নীতির তথ্য বেরিয়ে আসত বলে দাবি করেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে পরিদর্শক সাজ্জাদুল ইসলামের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। তবে অতিরিক্ত সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক রাহিদ হোসেন বলেন, দুদক টিমের সাথে আমার কথা হয়েছে। পরিদর্শক সাজ্জাদুল ইসলামের সাথেও দুদক টিমের কথা হয়েছে। তবে কি কথা হয়েছে তা জানি না। একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে দেখলাম সাজ্জাদুল ইসলামের অভিযোগের প্রমাণ পায়নি দুদক।
অথচ সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দপ্তর সূত্র জানায়, ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে চট্টগ্রাম জেলা সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দপ্তরের (সরঞ্জাম শাখা) পরিদর্শক সাজ্জাদুল ইসলাম দায়িত্ব গ্রহণের পর ডিজিটাল কারচুপির মাধ্যমে যেভাবে স্ক্র্যাপ ও ডিপোর মালামাল লুটপাট হয়েছে তা রেলের ইতিহাসে কখনো হয়নি। এই লুটপাট এখনো অব্যাহত আছে।
সূত্র মতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংঘবদ্ধ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে গত এক দশকে সবচেয়ে বড় স্ক্র্যাপের টেন্ডারের অনুমতি ভাগিয়ে আনেন সাজ্জাদুল ইসলাম। এই টেন্ডারে ৮ আইটেমের ১৪০৯ দশমিক ০১৫ মেট্রিক টন স্ক্র্যাপ (দরপত্র প্যাকেজ নং সেল/২২/২০২৩) টেন্ডার মুলে বিক্রয় করা হয়।
যার সাথে প্রায় ৬০ টন মূল্যবান স্ক্র্যাপ ট্রাক বোঝাই করে নিয়ে যাই সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার। যা ডিপো থেকে বের হওয়ার পর সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। সেনাবাহিনী তখন ট্রাকভর্তি স্ক্র্যাপ রেলওয়ে পুলিশের কাছে অর্পণ করেন। এ ঘটনায় সাজ্জাদুল ইসলাম স্কেল হেল্ডাপের দন্ড পান। আর শাস্তিমুলক বদলি পান আমির উদ্দিন, গোলাম রাব্বানী ও নজরুল ইসলাম।
আর ওই চেয়ারে বসে সাজ্জাদুল ইসলাাম পাহাড়তলি রেলওয়ের ক্যারেজ কারখানা ও ডিজেল সপ কারখানায় স্ক্রাপের গোপন ভান্ডার গড়ে তোলেন। যেখান থেকে ক্রমেই ময়লার গাড়িতে করে পাচার করা হচ্ছে এসব স্ক্র্যাপ। গত ১৬ জুলাই এই কারখানা থেকে ময়লার গাড়ির আড়ালে মূল্যবান যন্ত্রাংশ ও স্ক্র্যাপ পাচারের ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে ওই গাড়িচালককে আটক করে খুলশী থানার পুলিশ। পরে ওই গাড়ি চালক মো. রাসেলকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কারখানার তৎকালীন কর্মব্যবস্থাপক রাজীব কুমার দেবনাথ মালামাল চুরির এবং চালক বরখাস্তের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, রাসেল রেলওয়ের নিয়মিত গাড়িচালক। প্রতিদিন সে কারখানা থেকে ময়লা অপসারণ করে। এ সুযোগে সে স্ক্র্যাপ ও সরঞ্জাম চুরি করে বলে স্বীকার করে। ফলে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
তবে এসব স্ক্র্যাপের গোপন ভান্ডার সম্পর্কে আমার জানা নেই। কারণ আমি গত ২-৩ মাস আগে এখানে জয়েন্ট করেছি। এসব বিষয়ে জেলা সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দপ্তর, সরঞ্জাম শাখার পরিদর্শক জানার কথা। তিনিই মূলত এই স্ক্র্যাপের দায়িত্বে রয়েছেন।
এ বিষয়ে সিএমপির খুলশী থানার ওসি মো. আফতাব হোসেন জানান, মালামালগুলো রেলের স্ক্র্যাপ বলেই কর্মকর্তারা শনাক্ত করেছেন। তবে এ ঘটনায় মামলা না করে উল্টো সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে মালগুলো রাবিশ উল্লেখ করে পুলিশকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। যা সত্যিই বিস্ময়কর।
স্ক্র্যাপ পাচারের ঘটনা শুধু এখানে নয়, গত বছর ৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে রেলের সিজিপিওয়াই ইয়ার্ড থেকে তিন ট্রাক স্ক্র্যাপ চুরি করে পাচার করা হয়। ট্রাকগুলো ঢাকায় যাওয়ার পথে মিরসরাই থানা পুলিশ আটক করে। এর আগে ১৪ আগস্ট রেলের ওয়ার্কশপ থেকে সরঞ্জাম ও স্ক্র্যাপ চুরির ঘটনা ঘটে। যার মুল্য কোটি টাকারও বেশি।
এভাবে প্রায়ই প্রতিমাসে রেলওয়ের নিউ ডিপো, সেল ডিপো, ক্যারেজ, ওয়ার্কশপ, সরঞ্জাম ক্রয় স্টোরসহ বিভিন্ন স্টেশনে রাখা কোটি কোটি টাকার স্ক্র্যাপ চুরির ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে কয়েকটি ঘটনা পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর প্রকাশ পায়। নতুবা স্ক্র্যাপ পাচার গোপনেই থেকে যায়।
চাঞ্চল্যকর এমন আরেকটি ঘটনা ঘটে খোদ পাহাড়তলি রেলওয়ের সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দপ্তরে। যেখানে গড়ে তোলা গোপন ভান্ডার থেকে উদ্ধার করা হয়েছে প্রায় চার কোটি টাকার মালামাল। দীর্ঘদিন ধরে লুকিয়ে রাখা এসব মালামাল গোপন রেখে পরিদর্শক সাজ্জাদুল ইসলাম ও অনুসারি সংঘবদ্ধ অসাধু কর্মচারীরা।
কিন্তু এক চালানের লাইট সরবরাহ তদারকির সময় ধরা পড়ে নিখুঁত কারসাজি। যা ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশে দরপত্র আহ্বান করে বেচে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিল তারা। কিন্তু বিষয়টি ফাঁস হওয়ার পর অভিযানে নামে সাজ্জাদুল ইসলাম। তিনিই এসব মালামাল উদ্ধারের কথা বলে লালিত সাংবাদিকদের দিয়ে তা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যা সাজানো নাটক বলে দাবি করেন কর্মকর্তা-কর্মচারিরা।
উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কারখানায় প্রতিবছর সাড়ে ৯০০ যাত্রীবাহী ও প্রায় ৭ হাজার মালবাহী বগির রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত কাজ হয়। ফলে এখানে বিপুল পরিমাণ যন্ত্রাংশ ও স্ক্র্যাপ জমা থাকে, যা চক্রের মূল লক্ষ্য হয়ে উঠেছে।