রবিবার- ১৯ অক্টোবর, ২০২৫

চট্টগ্রামে ১৯৪ পোশাক কারখানা ভয়াবহ অগ্নিঝুঁকিতে

চট্টগ্রামে ১৯৪ পোশাক কারখানা ভয়াবহ অগ্নিঝুঁকিতে

# ফায়ার সেফটি সনদ নেই একটিরও
# অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা আছে কিন্তু আরও জোরদার জরুরি এমন কারখানার সংখ্যাও কয়েক হাজার

ট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (সিইপিজেড) অ্যাডামস ক্যাপস অ্যান্ড টেক্সটাইল কারখানার ভবনের মতো আরও ১৯৪টি পোশাক কারখানা রয়েছে ভয়াবহ অগ্নিঝুঁকিতে। যেগুলোর কোনরকম ফায়ার সেফটি সনদ নেই। আবার প্রায় ২ হাজার কারখানার অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা খুবই দুর্বল।

রবিবার (১৯ অক্টোবর) এ তথ্য জানান চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, চট্টগ্রামে অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা নেই এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৯৪টি। সবই পোশাক কারখানা। এ ছাড়া আরও দুই হাজার পোশাক কারখানায় অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা খুবই দুর্বল। যেগুলোতে অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা আরও জোরদার করা জরুরি।

তিনি বলেন, গত বৃহ¯পতিবার সিইপিজেডে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় অগ্নিনিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়টি সামনে আসে। এ ঘটনায় চট্টগ্রামের সবকটি পোশাক কারখানায় অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য-বাধকতার প্রস্তাবনার বিষয়টি চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের সাথে একমত পোষণ করেছেন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর উপমহাপরিদর্শক মোহাম্মদ মাহবুবুল হাসান। তিনি বলেন, ইপিজেডসহ পোশাক কারখানার সব ভবন কমপ্লায়েন্স ভবনে রূপান্তর করা খুবই জরুরি। সব কারখানার শ্রমিকদের ফায়ার ড্রিল ট্রেনিং করানো জরুরি। সামনে শীত আসছে। এ সময় অনেক অগ্নিকান্ড ঘটে থাকে। সবাইকে সতর্ক থাকা জরুরি।

দুই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তার মতে, পোশাক কারখানার ভবনগুলো কমপ্লায়েন্স ভবনে রূপান্তর না করায় অগ্নিঝুঁকি তৈরি হয়েছে। অধিকাংশ ভবনের ফায়ার সেফটি সনদও নেই। ফলে চট্টগ্রামের অধিকাংশ শিল্পকলকারখানা অগ্নিকান্ডের ঝুঁকিতে রয়েছে।

আরও পড়ুন :  মাশুল বাড়ায় বন্ধ প্রাইভেট ট্রেইলার, পণ্য পরিবহনে অচলাবস্থা

সূত্র মতে, চট্টগ্রামে একের পর এক শিল্পকারখানায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে। সিইপিজেডের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ ও নিয়ন্ত্রিত এলাকায় অবস্থিত শিল্পকারখানাতেও ঘটছে অগ্নিকান্ড। অথচ এসব স্থানে যথাযথ ফায়ার সেফটি থাকার কথা ছিল। ফায়ার সেফটি না থাকার বিষয়টি একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে দেখছেন চট্টগ্রামের ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা।

ফায়ার সার্ভিসের মতে, চট্টগ্রামের অনেক কারখানায় পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র না থাকা বা সেগুলো অচল থাকার অভিযোগ রয়েছে। এতে শ্রমিকদের নিরাপত্তা মারাত্নকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। অগ্নিকান্ডের সময়, প্রতিরোধ, শনাক্তকরণ, নিয়ন্ত্রণ এবং জরুরি বহির্গমনের ব্যবস্থা না থাকায় জীবনহানির শঙ্কা রয়েছে।

চট্টগ্রামের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর জানায়, চট্টগ্রামের অনেক কারখানায় অগ্নিনির্বাপণ বা পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা নেই। জরুরি বহির্গমনের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে। অনেক কারখানায় শ্রমিকদের অগ্নিকান্ডের সময় করণীয় স¤পর্কে সঠিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না, যা দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।

অগ্নিকান্ডের মতো ঘটনা রোধ করতে এবং শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কারখানার নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়মিত পরিদর্শন ও তদারকি করা প্রয়োজন কর্তৃপক্ষের। কিন্তু সেটি দেখা যায় না। সরকার ও শিল্পমালিকদের যৌথভাবে কাজ করতে হবে। যাতে পোশাক কারখানাগুলোতে ফায়ার সেফটি নিশ্চিত করা যায়। এর মধ্যে রয়েছে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম সরবরাহ করা, নিয়মিত সেগুলো পরীক্ষা করা, অগ্নিকান্ডের সময় দ্রুত সাড়া দেওয়ার জন্য জরুরি পরিকল্পনা তৈরি করা এবং কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া।

আরও পড়ুন :  চট্টগ্রামে জাবেদ-ওয়াসিকাসহ ১৩৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চট্টগ্রামে তৈরি পোশাকসহ প্রায় ১০ হাজার শিল্পকলকারখানা রয়েছে। এর মধ্যে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের নিবন্ধিত উৎপাদনকারখানা ৬ হাজার ৫৯৭টি। চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড উপজেলায় রয়েছে দুই শতাধিক কারখানা, যার মধ্যে ভারী শিল্পের কারখানা প্রায় ১৫০টি।

এ ছাড়া চট্টগ্রামে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (বেপজা) নিয়ন্ত্রিত চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল বা সিইপিজেড, কেইপিজেড ও কোরিয়ান ইপিজেড, কালুরঘাট ভারী শিল্প এলাকা, বিসিক নিয়ন্ত্রণাধীন শিল্পাঞ্চলে আরও ২ হাজার কারখানা রয়েছে। অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা নেই এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা রয়েছে ১৯৪টি। যার সবই পোশাক কারখানা। এ ছাড়া অধিকাংশ পোশাক কারখানায় অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা দুর্বল। অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা আছে কিন্তু আরও জোরদার করা জরুরি এ ধরনের সংখ্যাও কয়েক হাজার।

এদিকে গত ১৬ অক্টোবর বেলা ২টার দিকে চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (সিইপিজেড) অ্যাডামস ক্যাপস অ্যান্ড টেক্সটাইল কারখানার ভবনে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়। ১৭ ঘণ্টা পর শুক্রবার সকালে নিয়ন্ত্রণে আসে এ আগুন। নিভে ২৫ ঘন্টা পর। এ ঘটনায় দুটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। একটি ফায়ার সার্ভিসের, অপরটি সিইপিজেড কর্তৃপক্ষের। যদিও অগ্নিকান্ডের ঘটনায় কেউ হতাহত হননি।

আগুনের ভয়াবহতা, ফায়ার সার্ভিসের কাজের সীমিত সুযোগ এবং ভবনের ভেতরে থাকা কেমিক্যালের কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। ফায়ার সার্ভিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দেখেন এ ভবন কমপ্লায়েন্স ভবনে রূপান্তর করা হয়নি। এর আগে গত ১১ জুলাই চট্টগ্রামের পতেঙ্গার কর্ণফুলী ইপিজেডের অ্যারো ফেভারিট কারখানায় (তুলার কারখানা) আগুন লাগে। তারও আগে গত বছরের ৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের ইপিজেডে ৬ তলা একটি ভবনের ৪ তলায় একটি কারখানায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে।

আরও পড়ুন :  আন্তর্জাতিক পর্ন তারকা চট্টগ্রামের এক নারী, নজর নেই পুলিশের

নগরবিদ ও স্থপতি আশিক ইমরান বলেন, চট্টগ্রাম বাংলাদেশের একটি প্রধান শিল্পাঞ্চল। এখানে ছোট-বড় অসংখ্য কারখানা, গুদাম ও উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই অগ্নিনিরাপত্তার মৌলিক শর্ত পূরণ করে না। এতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি।

তিনি বলেন, অধিকাংশ কারখানায় নেই অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র, হাইড্রান্ট বা স্মোক ডিটেকশন সিস্টেম। জরুরি বহির্গমন পথ অনেক জায়গায় অবরুদ্ধ। শ্রমিক ও কর্মকর্তারা ফায়ার নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ পান না। বিপদের সময় করণীয় স¤পর্কে অনেকের ধারণা নেই। নিয়ন্ত্রণ সংস্থার তদারকিও খুবই দুর্বল। নিয়মিতভাবে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিদর্শন করা হয় না। অনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অনুমোদন (সনদ) নেওয়া হয়।

এ ছাড়া অনেক কারখানা পুরোনো ভবন, অপর্যাপ্ত ভেন্টিলেশন, অতিরিক্ত লোডে বিদ্যুৎ সংযোগ-সব মিলিয়ে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বহু গুণ বেড়ে যায়। চট্টগ্রামের মতো গুরুত্বপূর্ণ শিল্প অঞ্চলে যদি ফায়ার সেফটি অবহেলিত হয়, তাহলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের প্রাণহানি ও অর্থনৈতিক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। এখনই সময় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার।

ঈশান/মখ/মসু

আরও পড়ুন

You cannot copy content of this page