
# চালান বিলাসবহুল গাড়ি
# লন্ডনে প্রথম স্ত্রীর পরিবার
# ছিলেন ফ্যাসিস্টের দোসর
# শাটডাউন কর্মসূচির মুলেও তিনি
মিথ্যা ঘোষণায় মদ, সিগারেট, ফেব্রিক্সসহ নানা রকম অবৈধপণ্য আমদানি থেকে লাখ লাখ টাকা ঘুষ বাণিজ্য করে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার মো. মারুফুর রহমান। দীর্ঘদিন ধরে ঘুষ বাণিজ্যের কারণে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসকে বলা হয় মারুফের ঘুষের হাট।
সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দাখিল হওয়া অভিযোগে মিলেছে এসব তথ্য। অভিযোগে বলা হয়েছে, যুগ্ম কমিশনার মারুফুর রহমান চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসকে দুর্নীতির আতুরঘরে পরিণত করেছেন। ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে গড়েছেন অবৈধ স¤পদের পাহাড়। চালান বিলাসবহুল গাড়ি। প্রথম স্ত্রীর পরিবার থাকেন লন্ডনে।
দুদক ছাড়াও এমন অভিযোগ প্রধান উপদেষ্টার মূখ্য সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডেও গেছে। কিন্তু অজানা কারণে নিশ্চুপ সংস্থাগুলো। অথচ এনবিআর বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা দুটি বিভাগ করার অধ্যাদেশ বাতিলের জন্য গত মে-জুন মাসে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মবিরতি ও শাটডাউন কর্মসূচি পালনের মুলে ছিলেন এই মারুফ।
যার কারণে শিল্প, বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য, বন্দর, আমদানি-রফতানি, উৎপাদন, সেবা খাত লজিস্টিক ও সাপ্লাই চেইন কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়। হাতছাড়া হয় সরকারের অন্তত ৬০০ কোটি টাকা রাজস্ব। এনবিআর ঐক্য পরিষদের ব্যানারে ডাকা এই কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির কারণে এনবিআর ও কাস্টমসের অনেক কর্মকর্তা শাস্তিমূলক বরখাস্ত হলেও অধরা রয়েছে যুগ্ম কমিশনার মারুফুর রহমান।
সূত্র জানায়, গত ২৮ ও ২৯ জুন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি ঘোষণা করেন যুগ্ম কমিশনার মো. মারুফুর রহমান। গত ২৬ জুন দুপুর ২টা ২৯মিনিটে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে মার্চ টু এনবিআর এর জন্য কর্মকর্তাদের প্রস্তুত থাকতে বলেন মারুফ।
আর ২৮জুন সকাল ৯টা ২৬মিনিটে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কর্মকর্তাদের এনবিআর ঐক্য পরিষদের ডাকে কমপ্লিট শার্টডাউন কর্মসূচির ঘোষণা দেয় মারুফ। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের অভ্যন্তরীণ গ্রুপে সেদিন যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন মারুফ তার তথ্যাদি সংরক্ষিত রয়েছে। অথচ এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এখনও কোন ব্যবস্থা নেয়নি অভ্যন্তরীণ স¤পদ বিভাগ।
ফলে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে চতুর কাস্টমস কর্মকর্তা মারুফ। অথচ ২৮ ও ২৯জুন চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস বন্ধ রেখে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করায় তখনকার চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মো. জাকির হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় অভ্যন্তরীণ স¤পদ বিভাগ (আইআরডি)।
শুধু তাই নয়, একই অপরাধ দেখিয়ে আন্দোলনের সময় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে দায়িত্ব পালন করা ডেপুটি কমিশনার মোহাম্মদ সাইদুল ইসলামকেও চাকরি হতে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় গত ১৮ আগস্ট। যে অভিযোগে এ পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ স¤পদ বিভাগ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে সে অভিযোগের মুলে থাকা সত্ত্বেও অজানা এক অদৃশ্য ক্ষমতাবলে মারুফের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি অভ্যন্তরীণ স¤পদ বিভাগ। যার ফলে এনবিআর কর্মকর্তারা বিষয়টিকে ভিন্ন চোখে দেখছেন।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অভ্যন্তরীণ স¤পদ বিভাগের একই নীতিতে থাকা প্রয়োজন। যাদের বরখাস্ত করা হচ্ছে নিশ্চয় তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে করা হচ্ছে, কিন্তু তথ্য প্রমাণ সবকিছু থাকার পরও যাদের আন্দোলনে স¤পৃক্ততা ছিলো তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে, উল্টো ভালো জায়গাতে পদায়ণ করা কিংবা বীরদর্পে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়াটা অন্যায়। যার ফলে মাঠ প্রশাসনে ভিন্ন বার্তা যাচ্ছে।
কর্মকর্তাদের মতে, ঐক্য পরিষদের ব্যানারে চলা আন্দোলন সফল করতে মারুফ কাস্টম হাউসে দায়িত্বরত কর্মচারীদের দাপ্তরিক কাজে বাঁধা প্রদান করেছেন, একই সাথে কর্মসূচি সফল করার জন্য কর্মকর্তাদের নির্দেশও দিয়েছেন। শাটডাউন ঘোষণা দিয়ে আমদানি রফতানি কার্যক্রম বাঁধাগ্রস্থ করেছেন। যেখানে ২ দিন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস বন্ধ থাকায় প্রায় ৬০০ কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে সরকার।
মারুফুর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে দাখিল হওয়া অভিযোগে বলা হয়েছে, তিনি ঘুষ, দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ স¤পদ অর্জন করেছেন। মারুফুর রহমান চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসকে দুর্নীতির আতুরঘরে পরিণত করেছেন। মারুফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়নে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সহকারি কমিশনার রেজোয়ান আলমগীরসহ গঠিত সিন্ডিকেট মদ, সিগারেটের বিভিন্ন চালান থেকে প্রতিমাসে ২-৪ কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য করেন।
কাস্টম হাউসের রাজস্ব কর্মকর্তা নাজমুল হাসান এবং সহকারি রাজস্ব কর্মকর্তা মো নজরুল, রেজাউল এবং ফালতু রাজু প্রতি সপ্তাহে ১ কোটি টাকা ঘুষ সংগ্রহ করে মারুফকে দেন। তাছাড়া গ্রিন চ্যানেল থেকে ফালতু রাজু অবৈধ ফেব্রিক্স আমদানির প্রতি চালান থেকে ২ লাখ টাকা সংগ্রহ করে মারুফকে দেন। তাছাড়া অফ-ডক এ কর্মরত রাজস্ব কর্মকর্তা মো কামাল হোসেনের মাধ্যমে প্রত্যেকটি রফতানি চালান থেকে ১ লাখ টাকা ঘুষ নেন এই কাস্টম কর্মকর্তা মারুফ।
যুগ্ম কমিশনার মারুফ এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের শ্যালক হিসেবে পরিচয় দিতেন সবার কাছে এবং ভয়ভীতি দেখাতেন। এছাড়া বর্তমানে এনবিআরের ২জন মেম্বার এর নাম ভাঙ্গিয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে দুর্নীতির মাফিয়া হয়ে উঠেন। এছাড়া এই কর্মকর্তা বলে বেড়ান, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের বর্তমান কমিশনার মো শফিউদ্দিন একজন অদক্ষ ও অপদার্থ কমিশনার, যিনি কাস্টসের কোন আইন কানুন বোঝেন না। তিনি সকলের কাছে বলে বেড়ান, তার উপরে এনবিআরের ২জন সদস্যর ছায়া আছে তার কিছুই হবে না। এমনকি তিনি বর্তমান এনবিআর চেয়ারম্যানের নিকট আত্নীয় বলে সব জায়গাতে নিজেকে জাহির করেন।
সূত্র আরও জানায়, কাস্টম কর্মকর্তা মারুফের ব্যক্তিগত ২টি প্রিমিও গাড়ি যার মডেল নাম্বার ২০১৮-২০২২। এছাড়া নতুন করে তিনি একটি হ্যারিয়ার গাড়ি ক্রয় করেছেন। এই হ্যারিয়ার গাড়িতে করে উঠতি বয়সি নানা মডেলদের সাথে তার সখ্যতা রয়েছে। মারুফুর রহমানের নারীঘটিত কারণে তার প্রথম স্ত্রী তাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যান। পরবর্তীতে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। তার বর্তমান স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে লন্ডনে বসবাস করছেন। এমনকি স্ত্রীকে লন্ডনে বাড়ি কিনে দিয়েছেন এবং সন্তানরা লন্ডনে পড়ালেখা করছেন। একজন ৫ম গ্রেডের কর্মকর্তা কিভাবে সন্তানদের লন্ডনে পড়ালেখা করান এবং স্ত্রীকে বাড়ি কিনে দেন সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার মো. মারুফুর রহমানের অফিসিয়াল মোবাইল ফোনে মেসেজ এবং ফোন দেওয়া হলেও তিনি কোন সাড়া দেননি। এমনকি ৭ সেপ্টেম্বর রবিবার দুপুরে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে সশরীরে সাক্ষাতের জন্য গেলে ভিজিটিং কার্ড নিয়ে তিনি অফিসের সহকারি দিয়ে পাঠিয়ে দেন ডেপুটি কমিশনার (প্রিভেন্টিভ) এম এইচ কবিরের কাছে।
সেখানে গিয়ে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ডেপুটি কমিশনার (প্রিভেন্টিভ) এম এইচ কবির বলেন, আপনি যেসব বিষয়ে জানতে চাইছেন তা একান্তই যুগ্ম কমিশনার স্যারের ব্যাপার। এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এ সময় দুঃখ প্রকাশ করে ডেপুটি কমিশনার বলেন স্যার না বুঝে আপনাদেরকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন।
এসব বিষয়ে প্রশ্ন রাখা হয় চট্টগ্রাম কাস্টম কমিশনার মো. আবদুর রহমান খানের কাছেও। তিনি বলেন, সরকার বিষয়টি তদন্ত করছে। অনিয়ম ও অপরাধের সাথে যাদের স¤পৃক্ততা মিলবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে সরকার।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, তথ্য প্রমাণ থাকার পরও যদি দুর্নীতিবাজরা অধরা থেকে যায়, তাহলে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। বিষয়টি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং দুদকের গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত।