
গ্রামবাসীর হামলার প্রায় ৭ দিন পর আগামিকাল ৭ সেপ্টেম্বর রবিবার খুলছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। যথারীতি স্বাভাবিক নিয়মে চলবে ক্লাস-পরীক্ষাসহ সকল একাডেমিক কার্যক্রম। গত বৃহ¯পতিবার চবির ভারপ্রাপ্ত অধ্যাপক সাইফুল ইসলামের সই করা এক জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়।
এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির বিষয়টি চলে আসে সামনে। কারণ সংঘর্ষের পর বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন জোবরা ও ফতেপুর গ্রামে ভাড়া বাসায় থাকা প্রায় চার হাজার শিক্ষার্থী এখনও ফিরতে পারেনি।
তাদের কেউ ক্যাম্পাসে, কেউ চট্টগ্রাম শহরে আত্নীয়ের বাসায়, কেউ হোটেল-মোটেলে ফেরারি জীবন যাপন করছেন। এমনকি কেউ কেউ গ্রামের বাড়ীতে চলে গেছেন। তাহলে শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষাসহ চবির স্বাভাবিক কার্যক্রমে কীভাবে অংশ নিবে এমন প্রশ্ন চলে আসে সবার মাঝে।
এ নিয়ে শনিবার (৬ সেপ্টেম্বর) বিকেলে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, চবির শিক্ষার্থীদের সাথে স্থানীয় গ্রামবাসীর সংঘর্ষের পর সাত দিন কেটে গেছে। তবুও জোবরা ও ফতেপুর গ্রামের ভাড়া বাসায় ফেরার সাহস পাননি প্রায় চার হাজার শিক্ষার্থী। এ নিয়ে প্রশাসনের সকল স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা যেন সেশন জটে না পড়ে সেজন্য ক্লাস পরীক্ষা চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
আরেক প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, বহু শিক্ষার্থী জোবরা ও ফতেপুর গ্রামে মাসিক এক থেকে দুই হাজার টাকায় কটেজ ও ভাড়া ফ্ল্যাটে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন সংকট পূরণে এই এলাকাগুলো ছিল তাদের ভরসা। কিন্তু সহিংসতার পর পরিস্থিতি পাল্টে গেছে।
তিনি বলেন, গত শনিবার দিনগত রাতে সংঘর্ষের সময় অনেক শিক্ষার্থী প্রাণ বাঁচাতে এক কাপড়ে বাসা থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। অনেকে আতঙ্কে ভাড়া বাসা ছেড়ে ক্যাম্পাসে বা চট্টগ্রাম শহরে আত্নীয়-স্বজনদের বাসায় উঠেছে। কেউ কেউ হোটেল-মোটেলে উঠেছে। তারা এখন ফেরারি জীবন যাপন করছেন। কেউ কেউ গ্রামের বাড়িতেও চলে গেছেন। তবে সবার সাথে যোগাযোগ করে আমরা ৭ সেপ্টেম্বর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ক্লাস-পরীক্ষাসহ একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
শিক্ষার্থীদের মতামত:
সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যারয়ে মোট শিক্ষার্থী প্রায় ২৮ হাজার। এর মধ্যে আবাসিক হলগুলোয় আসন রয়েছে মাত্র সাত হাজারের মতো। বাকি ২১ হাজার শিক্ষার্থীকে হাটহাজারীর জোবরা-ফতেপুরসহ আশপাশের গ্রাম কিংবা চট্টগ্রাম শহরে (২২ কিলোমিটার দূরে) ভাড়া বাসায় থাকতে হয়।
এক্ষেত্রে জোবরা ও ফতেপুর গ্রামেই থাকেন অন্তত চার হাজার শিক্ষার্থী। গত শনিবার দিনগত রাতে সংঘর্ষের পর থেকে তারা এখন বন্ধুদের হলে গাদাগাদি করে আশ্রয় নিয়েছেন, কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে অস্থায়ীভাবে থাকছেন। পরীক্ষার সময় পড়াশোনার পরিবেশ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে।
লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী আশিক মাহমুদ বলেন, গত শনিবার দিনগত রাতে সংঘর্ষের সময় বাসার ভেতর আটকা ছিলাম। পরে সেনাবাহিনী ও বন্ধুদের সহায়তায় কোনোমতে ক্যা¤পাসে ফিরে আসি। এখনও পর্যন্ত নিজের ভাড়া বাসায় ভয়ে যেতে পারছি না। কারণ আমরা এখনও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।
একই রাতে কোনোমতে প্রাণ হাতে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে আসেন রিয়াজুল ফারাজ। তিনি বলেন, এক কাপড়ে বের হয়েছি। বই, খাতা, পোশাক সব পড়ে আছে জোবরা গ্রামের বাসায়। পরীক্ষা চলছে, কিন্তু পড়াশোনা বা থাকার কোনো ঠিক নেই। কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।
ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী শরীফুল রায়হান বলেন, জোবরা গ্রামের আসিফ ভিলার বিপরীতে একটি বাসায় আমরা চারজন থাকতাম। শনিবার থেকে রবিবার দুপুর ৩টা পর্যন্ত ভেতরে আটকা ছিলাম। পরে ক্যা¤পাসে এসে একদিন থাকি, তারপর গ্রামের বাড়ি চলে যাই। এখন ক্যা¤পাসে ফিরতে ভয় হয়। কারণ ওই এলাকা তো আমাদের জন্য এখন নিরাপদ না। কখন আবার এলাকাবাসী আক্রমণ করে সে ভয়ে আছি।
যা বললেন চবির উপাচার্য :
চবির উপাচার্য, অধ্যাপক ড. ইয়াহইয়া আখতার এ প্রসঙ্গে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চাইলেও এখন শতভাগ আবাসনের ব্যবস্থা করতে পারবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ৬০ বছরের প্রশাসন যেটা করতে পারেনি আমি একদিনে সেই কাজ কীভাবে করবো? আমার হাতে আলাদিনের ১২টা চেরাগ এনে দিলেও সম্ভব হবে না। তবে শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধান করতে আমরা সবসময় প্রস্তুত।
উপাচার্য বলেন, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা জোবরা ও ফতেহপুর গ্রামের মেম্বার চেয়াম্যানসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে বৈঠক করেছি। সেখানে আমাদের ছাত্র প্রতিনিধিরাও ছিলো। আমি তাদেরকে বলে দিয়েছি আমাদের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার যেন কোনো সমস্যা না হয় এবং শিক্ষার্থীরা যেন নির্ভয়ে গ্রামে থাকতে পারে সেভাবে আমাদের আলাপ হয়েছে।
তবুও কোনো শিক্ষার্থী যদি ভয়ে থাকে বা কোনো সমস্যা থাকে বা কোনো রকম হামলার সম্মুখীন হয় তাহলে তারা প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করবে। প্রশাসন যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। আশা করি আমরা একটা সুন্দর ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারবো।
সমঝোতা চায় গ্রামবাসীও
সংঘর্ষের ঘটনায় মামলা দায়ের ও পুলিশি অভিযানে গ্রেফতারের পর সমঝোতা চায় স্থানীয় গ্রামবাসীও। জোবরা সমাজ সংস্কার ও উন্নয়ন পরিষদ (জোসউপ) নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে গ্রামবাসী সমঝোতার বিষয়টি জানিয়েছে।
সংগঠনের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ও গ্রাম একত্রে শান্তি ও সংহতির আহ্বান জানিয়ে এক বিবৃতিতে জানানো হয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জোবরা গ্রামের সম্প্রদায় সাম্প্রতিক অশান্তি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে। রাতের সংঘর্ষে ছাত্র-ছাত্রী ও গ্রামবাসী আহত হয়েছেন, স¤পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে দুঃখ প্রকাশ করা হয়।
বিবৃতিতে তারা বলেন, আমাদের প্রস্তাব হলো বিশ্ববিদ্যালয় ও গ্রামের যৌথ সমন্বয় প্ল্যাটফর্ম অভিযোগ ও সমস্যা দ্রুত সমাধান করবে। আমরা বিশ্বাস করি এই উদ্যোগের মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রী ও গ্রামবাসী নিরাপদ, সম্মানজনক এবং বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে একত্রে বসবাস করতে পারবে।
এ দিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়ের করা মামলার পর থেকে পুরুষরা রাতে গ্রামে অবস্থান করেন না বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। জোবরা গ্রামের একাধিক বাসিন্দা বলেন, আমাদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের আগে কখনো বৈরী স¤পর্ক ছিল না। কিন্তু ওই ঘটনার পর পরিস্থিতি স¤পূর্ণ বদলে গেছে। প্রশাসন গ্রামের এক হাজার মানুষকে আসামি করেছে। আমরা কী অপরাধ করেছি বলেন? গ্রামবাসীও এখন ভয়ে দিন কাটাচ্ছে। মামলার পর থেকে গ্রামে পুরুষরা রাতে বাড়িতে থাকেন না। গ্রেফতারের আতঙ্কে তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এই পরিস্থিতি নিরসনে সমঝোতা চায় গ্রামবাসী। আর কোনো সংঘাত চায় না। প্রশাসনসহ কর্তা ব্যক্তিরা বসে সুষ্ঠু একটা সমাধান করুক এমনটা প্রত্যাশা গ্রামবাসীর।
ফিরে দেখা :
গত ৩০ আগস্ট শনিবার দিনগত রাতে জোবরা গ্রামের এক ভাড়া বাসায় ছাত্রীকে মারধরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়, তা ভয়াবহ রূপ নেয়। টানা দুই দিন চলা এই সহিংসতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য, প্রক্টরসহ প্রায় ১৫০০ শিক্ষার্থী আহত হন। তম্মধ্যে গুরুতর আহত ২৫০ শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন। এর মধ্যে ২ শিক্ষার্থী এখনও আইসিইউতে রয়েছেন।
সংঘর্ষের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়ের করা মামলায় ৯৫ জনকে নামীয় ও ১০০০ গ্রামবাসীকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। এরপর গত ৩ ও ৪ সেপ্টেম্বর র্যাব ও পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৯ জনকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতার আসামিরা হলেন, ইমরান হোসেন, হাসান, রাসেল, মো. আলমগীর, নজরুল ইসলাম, মো. জাহেদ, মো. আরমান, দিদারুল আলম ও মো. হান্নান।