রবিবার- ২০ এপ্রিল, ২০২৫

জামিন পেয়ে দুবাই পালিয়েছে চোরাকারবারি আবু

বেড়েছে হুন্ডি ও স্বর্ণ পাচার

হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়ে দুবাই পালিয়ে গেছে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার কুখ্যাত চোরাকারবারি আবু আহমদ ওরফে সোনা আবু। এরপর থেকে বেড়ে গেছে হুন্ডি ও স্বর্ণ পাচারের ঘটনা। গত জুন মাসে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর ও শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর দিয়ে শতকোটি টাকার স্বর্ণ পাচার হয়েছে। তম্মধ্যে অন্তত ১০ কোটি টাকার স্বর্ণের বার আটকের ঘটনা ঘটেছে।

মঙ্গলবার (১১ জুলাই) এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) চট্টগ্রাম জেলা ও মেট্রো ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসপি) শাহনেওয়াজ খালেদ। তিনি জানান, হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়ে গত মে মাসের কোন এক সময় দুবাই পালিয়ে গেছে সোনা আবু। এরপর গত ৩ জুন চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আবদুল করিম নামে এক যাত্রীর কাছ থেকে ৯৬৩ গ্রাম ওজনের সোনার বার ও গয়না জব্দ করা হয়। যার মূল্য প্রায় ৮২ লাখ টাকা।

এরপর গত ১২ জুন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ডাস্টবিন থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় সাত কেজি সোনা উদ্ধার করা হয়। যার আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা। এ ঘটনায় একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে। এভাবে প্রায় প্রতিদিনই দুই বিমান বন্দর দিয়ে স্বর্ণের বার পাচার হচ্ছে। তম্মধ্যে ১০ কোটি টাকা মূল্যের স্বর্ণের বার আটকের ঘটনা ঘটছে।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তথ্যমতে, এর আগে ২০২১-২২ সালে সোনা আবু দেশে থাকায় এবং তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের মাধ্যমে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানোয় চোরাচালান কিছুটা কমেছিল। সোনা আবু দুবাই পালিয়ে যাওয়ার পর হুন্ডি ও সোনা চোরাচালান আবার বেড়েছে। তবে হাইকোর্টের জামিন আদেশ স্থগিত রেখে আবুকে গ্রেপ্তারে এবার আদেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ।

সোমবার (১০ জুলাই) প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ এই আদেশ দেন। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারওয়ার হোসেন বাপ্পী।

আদালত সূত্র জানায়, ২৪০ কোটি ৫ লাখ ১২ হাজার ১৬০ টাকা পাচারের অভিযোগে চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানায় ২০২০ সালের ১৮ মার্চ মামলা হয় আবুর বিরুদ্ধে। এই মামলায় ২০ জনকে আসামি করে অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) উপ-পুলিশ পরিদর্শক মো. হারুন উর রশীদ। কিন্তু আইনজীবীর মাধ্যমে দু‘বছর পর আগাম জামিন চান আবু। সেই আবেদনে ২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি আবুকে তিন সপ্তাহের মধ্যে নিম্ন আদালতে আত্নসমর্পণের নির্দেশ দেন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। এছাড়া হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ আদালতের অনুমতি ছাড়া তার বিদেশযাত্রায়ও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

কিন্তু তিনি অসুস্থতা ও নানা বাহানায় বার বার সময়ের আবেদন করতে থাকেন। পরে একই বছরের ১৩ নভেম্বর চট্টগ্রাম সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ আজিজ আহমেদ ভূঁঞার আদালত তার জামিন বাতিল করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৫ ডিসেম্বর হাইকোর্টে জামিন আবেদন করলে পরদিন ৬ ডিসেম্বর আবুর বিদেশযাত্রায়ও আসে নিষেধাজ্ঞা।

চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি হাজিরার পর সোনা আবুকে শাহবাগ থানা পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। পরে চট্টগ্রামের একটি আদালতে হাজির করা হলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। এরপর তিনি হাইকোর্টে জামিন চেয়ে আবেদন করেন। গত ৬ এপ্রিল তাকে জামিন দিয়ে হাইকোর্ট রুল জারি করেন। এদিকে এই জামিন স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করেন। ১১ এপ্রিল তার জামিন স্থগিত করেন চেম্বার আদালত। একইসঙ্গে নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠান। এতে ৮ মে পর্যন্ত জামিন স্থগিত করেন।

পরে ২৯ মে আপিল বিভাগের শুনানিতে আবুর দেশ ত্যাগ করার বিষয়টি আদালতকে জানান তার আইনজীবী। সেদিন শুনানি শেষে আবুকে ১২ জুনের মধ্যে আত্নসমর্পণ করতে নির্দেশ দেন আদালত। কিন্তু সে আত্নসমর্পণ না করায় সোমবার তার জামিন স্থগিত রেখে তাকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

জানা গেছে, আবু দুবাইয়ে পালিয়েছেন। সেখান থেকেই নাড়ছেন দেশে চোরাচালান ও হুন্ডি ব্যবসার কলকাঠি। তাকে রক্ষায় এগিয়ে এসেছে ঢাকা-চট্টগ্রামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদ, সংসদ সদস্য ও ব্যবসায়ী নেতাও। তাদের কারও কারও রোষে পড়তে হয়েছে খোদ তদন্তকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের।

আদালত সূত্র আরো জানায়, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ফতেপুর গ্রামের ফয়েজ আহমেদ ওরফে বলি সওদাগরের ছেলে আবু আহমদ ওরফে আবুর ৭২১ কোটি ১৭ লাখ টাকার স¤পদের খোঁজ পায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সিআইডি ফিনান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট এনিয়ে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছে আদালতে। স্বর্ণ চোরাচালান মামলায় অভিযুক্ত আবু আহমেদের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করে সিআইডির ফিনান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট তাঁর অবৈধ অর্থের খোঁজ পায়। এই চক্রের সঙ্গে জড়িত মোট ২১ জনকে অভিযুক্ত করে প্রতিবেদন জমা দেয় সিআইডি।

সিআইডি জানায়, আবু আহমেদ চট্টগ্রামে অর্থপাচার এবং সোনা ও অন্যান্য পণ্য চোরাচালানের মাধ্যমে অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ স¤পদ অর্জন করেছে। তার স¤পদের মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি ভবন, প্লট, বিলাসবহুল বাড়ি। দুবাইতেও তার তিনটি দোকান রয়েছে। তদন্তে প্রমাণ মিলেছে ফরহাদ ট্রেডিং, রিয়াল ট্রেডিং, নাইস টেলিকম সেন্টার, রূপা টেলিকমিউনিকেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ২১টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলেন আবু আহমেদ। এসব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট লেনদেন হয়েছে বিপুল পরিমাণ টাকা।

তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসী বাংলাদেশিদের টাকা নিয়ে তিনি হুন্ডি ব্যবসা করেন। এছাড়া সোনা চোরাচালান করতে করতে তিনি পরিচিতি পান সোনা আবু নামে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে খোঁজ মিলেছে তার নামে কেনা ২৪টি জমির। সেই সঙ্গে নগরীতেই আছে বিলাসবহুল অন্তত তিনটি বাড়ি!

ঝালমুড়ি বিক্রেতা থেকে চোরাচালানের গডফাদার আবু:
এক সময় দেশে ঝলিমুড়ি বিক্রি করতেন আবু। সে কাজ ছেড়ে ১৯৯১ সালে শ্রমিক ভিসায় দুবাই যান আবু। এর কয়েক বছর পর আবার দেশে ফিরে আসেন। সেই থেকে আরব আমিরাত আর বাংলাদেশে আসা-যাওয়ার মধ্যেই আছেন তিনি। সোনা চোরাচালান ও হুন্ডির ব্যবসায় তাকে গডফাদার হিসেবে গোণা হয়ে থাকে।

২০১৩ সালের ৩ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরীর হিলভিউ আবাসিক এলাকার বাসার সামনে থেকে হঠাৎ অপহৃত হন আবু। তখনই প্রথম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে ওঠে আসে আবু নামের রহস্যময় এক বিত্তশালীর নাম। প্রায় ১০ বছর আগের সেই অপহরণের ঘটনায় আবু এক কোটি টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পান অজ্ঞাত একদল দুর্বৃত্তের হাত থেকে। পরে ঘটনার পাঁচ মাস পর ২০১৪ সালের ২২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ থানায় মামলা দায়েরের পর অপহরণের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

তবে স্বর্ণ চোরাচালানের গডফাদার হিসেবে আবুর নাম প্রথম আলোচনায় আসে ২০১৪ সালে। ওই বছর ঢাকায় চোরাচালানের স্বর্ণ উদ্ধারের পর পর তিনটি ঘটনায় দৃশ্যপটে চলে আসেন আবু। এর মধ্যে ১০৫ কেজি ওজনের ৯০৪ পিস স্বর্ণের প্রথম চালানটি ধরা পড়ে রাজধানীর শাহজালাল বিমানবন্দরে। পরে একই বিমানবন্দরে ৫২৫ পিস সোনার বারসহ ধরা পড়ে বিপুল পরিমাণ সৌদি মুদ্রার অপর একটি চালান। ৬১ কেজি স্বর্ণ অপর একটি চালান ধরা পড়ে ঢাকার নয়াপল্টন থেকে। এসব ঘটনায় ঢাকা বিমানবন্দর থানা ও পল্টন থানায় আবুর বিরুদ্ধে মামলা হয়।

এরপর ২০১৬ সালের ২৫ জানুয়ারি চট্টগ্রাম নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজারের বাহার মার্কেট থেকে স্ত্রী খুনের মামলায় আলোচিত তৎকালীন নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার বাবুল আক্তারের নেতৃত্বে উদ্ধার করা হয় তিনটি সিন্ধুকভর্তি বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ ও নগদ টাকা। এর মধ্যে একটি সিন্দুক থেকে ২৫০টি স্বর্ণের বার এবং অন্য এক সিন্ধুকে পাওয়া যায় নগদ ৬০ লাখ টাকা। এই ঘটনায় আবু ও তার ম্যানেজার এনামুল হক নাঈমকে আসামি করে কোতোয়ালী থানায় মামলা হয়।

এই মামলায় আবুকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু নাটকীয় কায়দায় তিনি মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় চট্টগ্রাম কারাগার থেকে বের হয়ে যান তিনি। সেখানে ও করেন জোচ্চুরি। ২০১৬ সালের ২৪ আগস্ট থেকে ৬ সেপ্টেম্বরের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে হাইকোর্টের দুই বিচারকের স্বাক্ষর জাল করে স্বর্ণ চোরাচালান মামলার কার্যক্রম স্থগিতের বিষয়ে একটি পিটিশন তৈরি করান আবু। ২০১৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট বিভাগের ফৌজদারি মিস শাখার মাধ্যমে সেই পিটিশনটি বিচারিক আদালতে পাঠানো হয়। ভুয়া স্থগিতাদেশ তৈরি করে তথ্যগোপনের মাধ্যমে জামিন নিয়ে ওই বছরের আগস্টে তিনি কারাগার থেকে বের হয়ে যান।

আবুর সহযোগীদের কাছেও বিপুল অর্থ:
চোরাচালান ও হুন্ডির কারবারে আবুর সহযোগী ফটিকছড়ির ফতেহপুরের ইকবাল আহমেদ ওরফে নিজামের চারটি ব্যাংক একাউন্টে গত এক যুগে জমা হয়েছে ৫২ কোটি টাকা। ফটিকছড়ির জাফতনগরের নুর মোহাম্মদের ছেলে আবু রাশেদের একাধিক ব্যাংক একাউন্টে ২০০৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত জমা হয়েছে ১ কোটি ৫৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা। হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল অর্থ বিদেশেও নিয়ে গেছেন এই রাশেদ। এই কাজে তিনি তার কর্মচারী হাবিবুর রহমান, মায়নুল হাসান রবি, মো. সোলাইমান, মুহাম্মদ পারভেজ মিয়া, মো. সাহাবুদ্দিন, সাইফুল ইসলাম, আবদুর রহিমকে ব্যবহার করেছেন। শুধু তাদের মাধ্যমেই রাশেদ বিদেশে পাচার করেছেন ২৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

আবুর আরেক সহযোগী এসএম আসিফুর রহমানের ব্যাংক একাউন্টে গত এক যুগে জমা হয়েছে প্রায় ২০ লাখ টাকা। একইভাবে চোরাচালান চক্রের সদস্য ফটিকছড়ির দক্ষিণ রোসাংগিরির ওবায়দুল আকবরের ব্যাংক একাউন্টে ৩৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা, ফতেহপুরের মোহাম্মদ রফিকের ব্যাংক একাউন্টে ২০ লাখ ৯০ হাজার টাকা, ফটিকছড়ির জাহানপুরের জিয়াউদ্দিন বাবলুর ব্যাংক একাউন্টে ৫০ লাখ টাকা, চন্দনাইশের হাশিমপুরের ইমরানুল হক মো. কফিল চৌধুরীর ব্যাংক একাউন্টে ২ কোটি ২০ লাখ ৯০ হাজার টাকা জমা হয়। এছাড়া ঢাকার ওয়ারীর বাসিন্দা এমতিয়াজ হোসেনের ব্যাংক একাউন্টে ৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা লেনদেনের প্রমাণ পেয়েছে সিআইডি।

আরও পড়ুন

No more posts to show

You cannot copy content of this page