
# বিপিসির কারসাজি
# বছরে ৮০০ কোটি টাকা সাশ্রয়ের জায়গায় উল্টো খরচ হচ্ছে রক্ষণাবেক্ষণে
# প্রকল্প পরিচালনায় অনভিজ্ঞতার দোহাই দিচ্ছে সংশ্লিষ্টরা
# ঠিকাদার নিয়োগে তোড়জোড়
সারাদেশে জ্বালানি সরবরাহের লক্ষ্যে কক্সবাজারের মহেশখালীর গভীর সাগরে নির্মিত পাইপলাইন সচল করা নিয়ে গড়িমসি চলছে। বিপিসির কারসাজির কারনে পাইপলাইন সচল রাখা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ নিয়ে তুমুল সমালোচনা চলছে বিপিসি ও সংস্থার নিয়ন্ত্রণাধীন পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও স্টান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানীতে কর্মরতদের মধ্যে।
তাদের ভাষ্য, প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই পাইপলাইন চালু হলে অন্তত প্রতিদিন কোটি টাকার জ্বালানি তেল চুরি বন্ধ হয়ে যেত। যা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে যমুনা অয়েল কোম্পানী। এরপর থেকে পাইপলাইনে জ্বালানি সরবরাহ সচল রাখা নিয়ে গড়িমসি শুরু করেছে বাংলাদেশ পেট্টোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)। এছাড়া এই পাইপলাইন সচল থাকলে প্রতি বছর অন্তত ৮০০ কোটি টাকা সরবরাহ খরচ সাশ্রয়ের কথা বলা আছে সমীক্ষায়।
কিন্তু পাইপলাইন কয়েকবার পরীক্ষামুলক চালুর পর জ্বালানি তেল সরবরাহ নিয়মিত সচল রাখা হয়নি। এতে ৮০০ কোটি টাকা সাশ্রয় তো দূরের কথা উল্টো রক্ষণাবেক্ষণ খরচ হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। সাথে সরবরাহের সময় জ্বালানি তেল চুরিও অব্যাহত রয়েছে।
বুধবার (১০ ডিসেম্বর) দুপুরে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) ঊর্ধ্বতন মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য ও অপারেশন্স) মণি লাল দাশ বলেন, প্রকল্পটির সবকিছু স¤পন্ন হয়েছে। পাইপলাইন পুরোপুরি প্রস্তুত। শুধুমাত্র পরিচালনার অভিজ্ঞতার অভাবে বছরে ৮০০ কোটি টাকা বাড়তি খরচের পাশাপাশি নানা বিড়ম্বনার মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এই প্রকল্প পরিচালনার জন্য সরকার জিটুজি ভিত্তিতে ঠিকাদার নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করা হবে। প্রকল্পটি পরিচালনার মতো যোগ্য প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেয়া হবে।
তিনি বলেন, সবকিছু ঠিক থাকলেও শুধুমাত্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা না থাকায় ৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটি দেশের কোনো কাজে লাগছে না। বিপিসির বছরে ৮০০ কোটি টাকা সাশ্রয়ের আশা করা হয়েছিল। প্রকল্পটি চালু না হওয়ায় তা অধরা রয়ে গেছে। উল্টো এত টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেও এখনো আগের মতো মাদার ভ্যাসেল থেকে জ্বালানি তেল লাইটারিং করা হচ্ছে। এতে চুরি ও সিস্টেম লস চলছে। প্রকল্পটিকে কাজে লাগানো গেলে মাদার ট্যাংকার থেকে এক লাখ টন জ্বালানি তেল খালাসে সময় লাগত ২৪ ঘণ্টা, যেটি এখন ১০ থেকে ১১ দিন লাগছে।
বিপিসির ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য ও অপারেশন্স) মো. মিজানুর রহমান বলেন, বিদেশি মাদার ভ্যাসেল থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল খালাসের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়। প্রকল্পটি উদ্বোধনও করা হয়েছে। পরীক্ষামূলকভাবে জ্বালানি তেল খালাস করা হয়েছে। কিন্তু গত এক বছরের বেশি সময় ধরে পাইপলাইনটি অলস পড়ে আছে। এতে ৮০০ কোটি টাকা সাশ্রয় তো দূরের কথা, উল্টো প্রকল্পটি রক্ষণাবেক্ষণ এবং বিনিয়োগকৃত অর্থের পেছনে উল্টো কোটি টাকা খরচ হচ্ছে।
বিপিসর তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে গড়ে ৭০ লাখ টনের কাছাকাছি জ্বালানি তেল ব্যবহৃত হচ্ছে। এর প্রায় পুরোটাই আমদানি নির্ভর। এর মধ্যে ১৫ লাখ টনের মতো ক্রুড অয়েল এবং বাকিটা পরিশোধিত অবস্থায় বিশ্বের নানা দেশ থেকে আমদানি করা হয়। আমদানিকৃত জ্বালানি তেল নিয়ে বিশালাকৃতির মাদার ভ্যাসেল চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছে। গড়ে ১ লাখ টন ধারণক্ষমতার এসব অয়েল ট্যাংকার কুতুবদিয়ার অদূরে অবস্থান নেয়।
সেখান থেকে এসব জ্বালানি তেল লাইটারিং করে ইস্টার্ন রিফাইনারি এবং গুপ্তাখাল প্রধান ডিপোতে নিয়ে আসা হয়। এই খাতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনকে বছরে গড়ে ৮০০ কোটির বেশি টাকা ব্যয় করতে হয়। অপরদিকে ১ লাখ টন জ্বালানি তেল লাইটারিং করতে গড়ে ১১ থেকে ১২ দিন সময় লাগে। একেকটি মাদার অয়েল ট্যাংকারকে বসিয়ে বসিয়ে ১১/১২ দিনের ভাড়া পরিশোধ করতে হয়। এতেও বিপিসিকে বড় অংকের টাকা বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করতে হয়।
এছাড়া মাদার অয়েল ট্যাংকার থেকে লাইটারেজ করার সময় জ্বালানি তেল অপচয় ও নষ্ট হয়। অভিযোগ রয়েছে, বহু তেল চুরি হয়। এভাবে বিপিসি প্রচুর সিস্টেম লসের কবলে পড়ে। এসব সংকট থেকে উত্তরণ, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং সর্বোপরি জাহাজ থেকে তেল খালাসে সময় এবং অর্থ সাশ্রয় করতে গভীর সাগরে একটি সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন নির্মাণের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।
২০১০ সালে প্রকল্পটি একনেকের অনুমোদন লাভ করলেও অর্থাভাবে ঝুলে ছিল। পরবর্তীতে প্রকল্পটিতে অর্থায়নে চীন সরকার আগ্রহ দেখায়। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে প্রকল্পটি নিয়ে আলোচনা এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের সাথে চীনের এক্সিম ব্যাংকের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ৫৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার বা সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার ঋণ সহায়তায় ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন শীর্ষক প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়।
২০১০ সালে একনেকে অনুমোদিত প্রকল্পটির কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের ৩০ আগস্ট। ততদিনে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয় চার দফায়। একই সাথে প্রকল্প ব্যয় ৫ হাজার কোটি থেকে বেড়ে ৮ হাজার ২৯৮ কোটি টাকায় ঠেকে। বিপিসির পক্ষে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল)। প্রকল্পটির নির্মাণ (ইপিসি) ঠিকাদার ছিল চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কো¤পানি লিমিটেড (সিপিপিইসি)।
এই প্রকল্পের আওতায় চায়না পেট্রোলিয়াম মহেশখালীর গভীর সমুদ্রে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং নির্মাণ করবে এবং ইস্টার্ন রিফাইনারি পর্যন্ত অফশোর এবং অনশোর মিলে মোট ২২০ কিলোমিটার ডাবল পাইপলাইন বসানো হয়। এর মধ্যে ১৪৬ কিলোমিটার অফশোর পাইপলাইন এবং ৭৪ কিলোমিটার অনশোর পাইপলাইন।
কক্সবাজারের মহেশখালী এলাকায় ৯০ একর জায়গায় ৬টি স্টোরেজ ট্যাংক ও পা¤প স্টেশনও স্থাপন করা হয়েছে। ৬টি স্টোরেজ ট্যাংকের ৩টিতে পরিশোধিত এবং অপর ৩টিতে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল মজুদ করা হবে। প্রতিটি পরিশোধিত স্টোরেজ ট্যাংকারের ধারণ ক্ষমতা ৬০ হাজার ঘনমিটার এবং অপরিশোধিত স্টোরেজ ট্যাংকারের ধারণ ক্ষমতা ৩৫ হাজার ঘনমিটার।
জাহাজ থেকে ক্রুড অয়েল ও পরিশোধিত তেল সরাসরি ভ্যাসেল মুরিং পয়েন্টে নিয়ে যাওয়া হবে। ওখান থেকে পা¤প করে পাইপলাইনের মাধ্যমে মহেশখালীর স্টোরেজ ট্যাংকে এবং পরবর্তীতে সেখান থেকে পুনরায় পা¤েপর মাধ্যমে পাইপলাইনে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পাঠানো হবে। ডাবল পাইপলাইনের একটি দিয়ে ক্রুড অয়েল এবং অপর পাইপলাইন দিয়ে রিফাইনড অয়েল সরবরাহ দেয়া হবে। এই প্রক্রিয়ায় মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় এক লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন অপরিশোধিত এবং ২৮ ঘণ্টায় ৭০ হাজার টন পরিশোধিত ডিজেল খালাস করার সক্ষমতা রয়েছে বলে বিপিসির শীর্ষ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পর গত বছর সেটি পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হয়। প্রকল্পটির পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকাদার হিসেবে চায়না পেট্রোলিয়ামকে নিয়োগ দেওয়ার কথা ছিল। এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকার পরিবর্তনের পর তা আর হয়নি। পরবর্তীতে দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়।
এ ব্যাপারে গত ৩০ এপৃল টেন্ডার আহ্বান করা হলে দুটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। একটি প্রতিষ্ঠানকে যোগ্য হিসেবে বিবেচিত করা হয়। কিন্তু তারা যে দর উল্লেখ করে তাতে বিপিসি আকাশ থেকে পড়ে। প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে অন্তত ৫১ শতাংশ বেশি দর উল্লেখ করা হয়। এই অবস্থায় বিপিসি গত ১৭ সেপ্টেম্বর টেন্ডারটি বাতিল করে বিপিসি। এরপর চুপ হয়ে পড়ে সংস্থাটি।











































