
# অকার্যকর ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেম
# দান-সদকার সাড়ে ৫ কোটি টাকা নয়ছয়
# ঠিকাদার-হাসপাতাল পরিচালক একজোট
চট্টগ্রাম মা-শিশু ও জেনারেল হাসপাতালকে অগ্নিঝুঁকিমুক্ত করতে সাড়ে ৫ কোটি টাকার প্রকল্প নেয় হাসপাতাল পরিচালনা কর্তৃপক্ষ। প্রায় ৯০ শতাংশ কাজ সম্পন্নও হয়েছে। কিন্তু অকার্যকর রয়ে গেছে ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেম।
প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কথা ছিল ফায়ার রেজিস্ট্যান্ট বা ফায়ার সারভাইভাল কেবল লাগানোর। কিন্তু লাগানো হয়েছে ফ্লেম রিটার্ডেন্ট কেবল। ফলে হাসপাতালটি রয়ে গেছে অগ্নিঝুঁকিতে। এই অবস্থায় ঠিকাদার তুলে নিয়ে গেছে ২ কোটি ৫ লাখ টাকার বিলও।
যা ঠিকাদার ও হাসপাতাল পরিচালনা কর্তৃপক্ষ সিন্ডিকেট দান-সদকায় পরিচালিত হাসপাতালের এই অর্থ নয়-ছয় করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, ফায়ার রেজিস্ট্যান্ট কেবল আগুনের মধ্যেও নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ বজায় রাখে। এতে জরুরি সিস্টেম যেমন অ্যালার্ম, ইমার্জেন্সি লাইট, লিফট ইত্যাদি চালু রাখা যায়। এই কেবল ৭৫০ থেকে ৯৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ৩ ঘণ্টা পর্যন্ত সহ্য করতে পারে।
এই কেবল হাসপাতাল, টানেল, ফায়ার অ্যালার্মসহ জরুরি সেবায় ব্যবহার হয়। যার দাম প্রতি মিটার ৭০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত হয়। অন্যদিকে ফ্লেম রিটার্ডেন্ট কেবল আগুনের ২৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা পর্যন্ত সহ্য করতে পারে। মানুষ বাসাবাড়িতে এই কেবল ব্যবহার করে; যার দাম প্রতি মিটার ২০ থেকে ৩০ টাকা।
তাছাড়া হাসপাতালের নির্বাহী প্রকৌশলী নাসির উদ্দিনের অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্পের কাজ ৯০ শতাংশ শেষ হলেও এখন পর্যন্ত অ্যালার্ম সিস্টেম সম্পূর্ণ অকার্যকর। এ কারণে অগ্নিদুর্ঘটনা মোকাবিলার কোনো সুযোগ বা সক্ষমতা নেই। ফায়ার ডিটেকশন ও অ্যালার্ম সিস্টেমে যে মানের এবং ব্র্যান্ডের কেবল ব্যবহার করা হয়েছে তা সঠিক ফায়ার কেবল নয়। এসব কেবল অগ্নিদুর্ঘটনা মোকাবিলা করতে অক্ষম।
দরপত্রে অ্যালার্ম সিস্টেমের জন্য ৫ হাজার মিটার কেবল উল্লেখ থাকলেও বিল দেওয়া হয়েছে ৯৮ হাজার ৪০০ মিটারের। ফায়ার ডিটেকশন ও অ্যালার্ম সিস্টেম, পিএ সিস্টেমের বিল প্রদান করা হয়েছে ২ কোটি ৫ লাখ ৫১ হাজার ৬২৮ টাকা। কিন্তু একটি ইউনিটও চালু হয়নি।
বিলের মধ্যে যেসব অসংগতি পাওয়া গেছে তা হলো, পিএ সিস্টেমের কেবল বাবদ দুই লটে ৭ লাখ ২৪ হাজার ৫০০ টাকা বিল করা হয়। ফায়ার ডিটেকশন ও অ্যালার্ম সিস্টেম, পিএ সিস্টেমের মধ্যে সিসিটিভি ক্যামেরা কেবল বাবদ বিল দেওয়া হয়েছে ৩ লাখ ৬২ হাজার ২৫০ টাকা। বাস্তবে এই কেবল পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া ফায়ার ডিটেকশন ও অ্যালার্ম সিস্টেমে সিসিটিভি কেবলের প্রয়োজনও নেই।
ফায়ার ডিটেকশন ও অ্যালার্ম সিস্টেম, পিএ সিস্টেম সিডিউলে ইউপিভিসি পাইপ উল্লেখ থাকলেও নিম্নমানের পিভিসি পাইপ দিয়ে ত্রুটিপূর্ণ কাজ করা হয়েছে। শিডিউলে এনএফপিএ স্ট্যান্ডার্ড অনুসারে কাজের চুক্তি থাকলেও তা বাস্তবে অনুসরণ করা হয়নি। এই প্রতারণায় প্রকল্পের অর্ধেকেরও বেশি টাকা তছরূপ করা হয়েছে। যা হাসপাতাল পরিচালনা কর্তৃপক্ষ ও ঠিকাদার সিন্ডিকেটের যোগসাজশে হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মা-শিশু ও জেনারেল হাসপাতাল পরিচালনা কমিটির সহসভাপতি আবদুল মান্নান রানা বলেন, ‘আমরা অনিয়ম ধরতে কমিটি গঠন করেছি। এই হাসপাতাল মানুষের দান-সদকায় চলে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরেই জেলার এটি দ্বিতীয় বৃহত্তম হাসপাতাল। সুতরাং এই হাসপাতালের টাকা কেউ মেরে খাবে তা হতে দেব না।’
তিনি বলেন, এ কাজের অনিয়মের বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে চট্টগ্রাম মা-শিশু ও জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. নুরুল হক সিমেনটেক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে চিঠি দিয়েছেন। বিষয়টি দ্রুত নিষ্পত্তির আহ্বান জানানো হয়েছে।
হাসপাতালটির প্রধান প্রকৌশলী অরুপ চৌধুরী বলেন, ‘২০১৮ সালে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। এরপর ২০২০ সালের দিকে করোনা মহামারি, ফান্ডেরও ক্রাইসিস ছিল। আবার প্রকল্পে যে কাজের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়, পরে দেখা গেল কাজ বেড়ে গেছে। এসব কারণে প্রকল্পটি দীর্ঘায়িত হয়ে যায়।
এখানে কেবলের মানের বিষয়ে যে বিতর্ক উঠেছে, তা চিহ্নিত করতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রতিবেদন আসার পর বলতে পারব, কোথাও কোনো ত্রুটি আছে কি না।’
হাসপাতালের নির্বাহী কমিটির সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ মোরশেদ হোসেন জানান, তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর বিস্তারিত বলতে পারবেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে যারা রয়েছেন, তারাই গলদের গোড়া। ঠিকাদারের সাথে যোগসাজশে তারা এই অনিয়ম করেছে। কারসাজি করে দান-সদকার টাকা তছরূপ করেছে।
যার ইঙ্গিত পাওয়া গেলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিমেন্টেক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুনুর রশীদ ভুঁইয়ার কথায়ও। তিনি বলেন, ‘তারা যেভাবে বলেছেন আমরা সেভাবে কাজ করেছি। প্রতিটি জিনিস লাগানোর আগে আমরা তাদের স্যাম্পল দেখিয়েছি। তারপর লাগিয়েছি। তাদের কথামতো আমরা কাজ করেছি। কিন্তু সেভাবে তারা আমাদের বিল দেয়নি। প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকার কাজের বিল দিয়েছে ২ কোটি ৫ লাখ টাকা। অথচ ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
৫ হাজার মিটার কেবলের বিপরীতে কেন ৯৮ হাজার মিটার তার সরবরাহ করেছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কাজ নিয়ে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না। সেখানে যা যা প্রয়োজন, তাদের অনুমতি নিয়ে লাগিয়েছি।’ কাজের মেয়াদ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তারা যেহেতু বিল দিতে পারছে না, তাই কাজ শেষ হচ্ছে না। ইউপিভিসি পাইপ বাঁকানো যায় না। তাই পিভিসি পাইপ লাগানো হয়েছে।’ বিল পাওয়ার জন্য তারা আইনের পথে হাঁটার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানান।
ঈশান/খম/মসু