চট্টগ্রামে ডিমের দাম বাড়ছেই। সরকারের নির্ধারিত দামের চেয়ে প্রতিপিস ডিম পাইকারিতে ২ টাকা ২২ পয়সা ও খুচরায় ৪ টাকা বেশি দামে বিক্রয় হচ্ছে এখন। আর ডিমের এই দাম নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে ঢাকা তেজগাঁও থেকে। এতে আঙ্গুল ফুলছে ব্যবসায়ীদের। আর নাভিশ্বাস উঠছে ভোক্তাদের।
ভোক্তাদের অভিযোগ, বিক্রেতারা নানারকম গোঁজামিল করে ডিমের দাম বাড়িয়ে মুনাফা লুটছে। বিক্রেতারা দুষছে পাইকারি ব্যবসায়ীদের। পাইকাররা দুষছে মধ্যস্বত্বভোগী ও পোলট্রি ফার্ম মালিকদের।
শুক্রবার (০৪ অক্টোবর) চট্টগ্রাম মহানগরীর বহদ্দারহাট, চকবাজার ও কাজীর দেউড়ি বাজারের কয়েকটি দোকানে গিয়ে ডিম কেনাবেচার রসিদে ধরা পড়ে চোখ কপালে তোলার মতো নানা গোঁজামিল। যেটা দেখাতে রাজী নন ডিম ব্যবসায়ীদের কেউ।
শেষ পর্যন্ত নাম প্রকাশ না করার শর্তে বহদ্দারহাটের এক ডিম ব্যবসায়ী বলেন, যে রসিদে ডিম কিনেছি, সেটা কোন পাকা রসিদ নয়। সাদা কাগজে হিসেব করে রসিদ দেয়া হয়েছে। যেখানে প্রতিপিস ডিমের দাম পড়েছে ১২ টাকা ৮০ পয়সা। ডজন প্রায় ১৫৪ টাকা। যা তিনি ভোক্তা পর্যায়ে খুচরা বিক্রয় করছেন প্রতিপিস ১৪ টাকা ৫৮ পয়সা দরে। অর্থাৎ পাইকারির তুলনায় প্রতি পিস ডিম ১ টাকা ৭৮ পয়সা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
ওই ডিম ব্যবসায়ী বলেন, তিনি নগরীর পাহাড়তলী পাইকারি বাজার থেকে ডিম ক্রয় করেন। সেখানে শুক্রবার সকাল থেকে এই দামে ডিম কেনা-বেচা হচ্ছে। পাহাড়তলী বাজারে গিয়ে দেখাও মিলে তার সত্যতা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পাহাড়তলী বাজারের ডিম ব্যবসায়ী আবদুল মালেক বলেন, আমরা খামার থেকে প্রতিপিস ডিম কিনে আনি ১২ টাকা ২০ পয়সায়। কিন্তু তার হিসাব দেখানো হয় সরকার নির্ধারিত দামে ১০ টাকা ৫৮ পয়সা হিসেবে।
আবদুল মালেক বলেন, ডিমের দাম ও রসিদ নিয়ে কারসাজি করলেও কোনরকম কথা বলা যাচ্ছে না। বলছে এভাবে নিলে নাও না নিলে যাও। এভাবে রসিদ জালিয়াতির কৌশল অবলম্বন করছে চট্টগ্রামের বিভিন্ন পোলট্রি ফার্ম। এর মধ্যে কাজী ফার্ম, ডায়মন্ড এগ, সিপি, নারিশ, প্যারাগন, আমান, রানা ফিড অন্যতম বলে জানান তিনি।
চট্টগ্রামের ডিমের পাইকারি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বিভিন্ন পোলট্রি ফার্ম আড়তদারের সঙ্গে যোগসাজশে রসিদে সরকার নির্ধারিত দর দেখালেও বাস্তবে প্রতিটি ডিম বিক্রি করছে ১২ টাকা ২০ পয়সা হিসেবে। এই কারসাজির কারণে ম্যাজিস্ট্রেট বা ভোক্তা অধিকারের কর্মকর্তাদের অভিযানে রসিদও দেখাতে চান না ব্যবসায়ীরা।
পাইকারি ডিম ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের বাজারে বেশিরভাগ ডিমের সরবরাহ হয় টাঙ্গাইল থেকে। সরবরাহ টাঙ্গাইল থেকে হলেও বাজারের নিয়ন্ত্রণ করে ঢাকার তেজগাঁও সমিতি। তারা সারা দেশের ব্যবসায়ীদের কত টাকা দরে ডিম বিক্রি করবেন, সেটি জানিয়ে দেন। সেই মতে বাজার নিয়ন্ত্রিত হয়।
তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আমানউল্লাহ বিষয়টিকে ভিত্তিহীন দাবি করে বলেন, আমরা কিছুই নিয়ন্ত্রণ করি না। ব্যবসায়ীরা আমাদের নামে শুধু শুধু বদনাম করে বেড়াচ্ছে।
চট্টগ্রাম ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ স¤পাদক আব্দুল শুক্কুর বলেন, বর্তমানে ডিমের যে পরিমাণ চাহিদা আছে, সে পরিমাণ সরবরাহ নাই। তাই দাম বাড়তি। সরবরাহ বাড়লে আবারও দাম কমে যাবে।
ডিম ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে শুধু দাম নির্ধারণ করলেই চলবে না। অবশ্যই বিভিন্ন পোলট্রি ফার্ম, আড়তদার, মধ্যস্বত্বভোগীকে আইনের আওতায় আনতে হবে। তাহলেই ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে। অন্যথায় সবকিছু কাগজে-কলমে থেকে যাবে। ভোক্তারা কখনো সুফল পাবেন না।
এ বিষয়ে কাজী ফার্মসের চট্টগ্রামের জোন ম্যানেজার মহিবুল ইসলাম হিরন বলেন, আমরা আড়তদারের কাছে ডিম বিক্রি করার সময় ইআরপি চালান দিয়ে দিই। সেখানে ¯পষ্ট লেখা আছে আমরা আড়তদারের কাছে প্রতিটি ডিম ১০ টাকা ৫৮ পয়সায় বিক্রি করছি। কোনো আড়তদার বলতে পারবেন না বেশি দামে ডিম বিক্রি করছি। এখন আমাদের কাছ থেকে ডিম কিনে আড়তদাররা কত দামে বিক্রি করছেন, সেটা তো আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। এটা সরকারকেই দেখতে হবে। এই আড়তদাররাই ডিমের দাম বাড়াচ্ছেন বা কমাচ্ছেন।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অনেকে রসিদে সরকার নির্ধারিত দর দেখিয়ে বাড়তি দরে ডিম বিক্রি করছেন- এমন বিষয় আমরা জানতে পেরেছি। তবে আমরা এমন কাজ করছি না, সেটা ¯পষ্টভাবেই বলতে পারি। আবার প্রান্তিক খামারিরাও বাড়তি দরে ডিম বিক্রি করেন- এমনটা আমরা শুনি। এসব কারণে প্রভাব পড়ে বাজারে।
করপোরেট প্রতিষ্ঠান রানা ফিডের জেনারেল ম্যানেজার মোহাম্মদ নজরুল বলেন, আমরা মোট চাহিদার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ডিম উৎপাদন করি। বেশির ভাগ ডিম আসে খামারিদের কাছ থেকে। সেখানেই ডিমের দাম বেশি। সরকার ওখানে ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এ কারণে ডিমের দাম বেশি। আমাদের কো¤পানি কিন্তু সরকার নির্ধারিত দরেই ডিম বিক্রি করছে। তবে ডিলারদের কাছ থেকে শুনেছি, কিছু কো¤পানি রসিদে সরকারি দর দেখালেও ভেতরে বাড়তি দরে ডিম বিক্রি করছে। আর এটা যদি হয়ে থাকে, তবে সরকারের উচিত ব্যবস্থা নেওয়া।
ইমরান হোসেন নামের এক ডিম ক্রেতা বলেন, বাজারে প্রতিটি পণ্যই নিয়ে চলছে সিন্ডিকেট। ব্যবসায়ীরা একেক সময় একেক পণ্য নিয়ে খেলছেন। এর সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে ডিম। প্রশাসনের উচিত ডিমের বাজারে নিয়মিত মনিটরিং করা।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, চট্টগ্রামের পাইকারি ব্যবসায়ীদের আসল অপরাধীদের চিহ্নিত করে দিতে হবে। তারা অভিযানের ভয়ে রসিদ লুকিয়ে রাখলে তো সমস্যার সমাধান হবে না। পাশাপাশি যত পোলট্রি ফার্ম, আড়তদার, মধ্যস্বত্বভোগী আছে, তাদের তালিকা তৈরি করতে হবে। তারা কত দিয়ে ডিম বেচাকেনা করছে, সেটা যাচাই করতে হবে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক ফয়েজ উল্যাহ বলেন, আমরা সম্প্রতি পাহাড়তলী বাজারে অভিযান চালিয়ে পাইকারদের কাছে কোনো ক্রয় রসিদ পাইনি। আড়তদাররা বলেছেন প্রান্তিক খামারিরা রসিদ দিতে চায় না। এখন আমরা সেখানেও সবকিছু খতিয়ে দেখব। সেভাবেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
You cannot copy content of this page