তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা ও তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তাবায়নের দাবিতে বিক্ষোভ করেছে লাখো মানুষ। 'জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই’- স্লোগানে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে রংপুরের মানুষ। দেশের ১২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা নদীর ১১টি পয়েন্টে এক যোগে সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) টানা ৪৮ ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচি পালন শুরু হয়।
বিকেল ৩টা লালমনিরহাট সদর উপজেলার তিস্তা রেলসেতু ও তিস্তা সড়ক সেতুর মধ্যস্থানে আয়োজিত অবস্থান কর্মসূচির জনতার সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ফখরুল বলেন, বাংলাদেশের মানুষের সাথে বন্ধুত্ব করতে চাইলে তিস্তার পানি দিতে হবে। সীমান্তে গুলি করে হত্যা বন্ধ করতে হবে। সেই সাথে আমাদের সাথে বড় দাদার আচরণ বন্ধ করতে হবে। আমাদের পাওনা বুঝিয়ে দেন। আমরা নিজ পায়ে দাঁড়াতে চাই। আমাদের বন্ধুত্ব হবে সম্মানের সাথে। তাহলে বাংলাদেশের মানুষের সাথে বন্ধুত্ব হবে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ভারত একদিকে পানি দেয় না, অন্যদিকে আমাদের যে শত্রু তাকে দিল্লিতে রাজার হালে বসায় রাখছে। আর ওখান থেকে তিনি হুকুম জারি করে। এসময় তিনি উপস্থিত সবার উদ্দেশে বলেন, আওয়ামী লীগ পালাইছে, নাকি এখনো আছে। আজকের এই সংগ্রাম আমাদের বাঁচা মরার লড়াই।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমরা সবসময় তিস্তার পানির কথা বলেছি। পাকিস্তানের আমলে পাকিস্তান বলেছে। আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় এলো, সবাই ভাবল, ভারতের বন্ধু যখন ক্ষমতায় এসেছে, পানি এবার পাওয়া যাবে। কিন্ত উল্টা, বাংলাদেশটাকে বেচে দিয়েছে, তিস্তার এক ফোঁটা পানি আনতে পারে নাই। শুধু তিস্তা নয়, ৫৪টা নদী আছে, সব নদীর উজানে ভারত বাঁধ দিয়েছে। ভারত তিস্তা নদীতে বাঁধ দিয়ে আমাদের পানি নিয়ে যায়, বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। আর আমাদের দেশের মানুষ এখানে ফসল ফলাতে পারে না, জেলেরা মাছ ধরতে পারে না। প্রত্যেকটা মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে তারা।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, অনেকেই বলছেন, আমরা ভোট ভোট করছি। ভোট ভোট করার কারণ হচ্ছে নেতা নির্বাচন। কেননা নির্বাচিত নেতার মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন করা। তাছাড়া নির্বাচন হলে দেশে শান্তি ফিরে আসবে। আর অশান্তি হবে না। স্থিতিশীলতা আসবে। তাই তাড়াতাড়ি নির্বাচন দিয়ে জনগণের সরকারের কাছে ক্ষমতা দেন।
তিস্তা রক্ষা আন্দোলনের প্রধান ও বিএনপির রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাবেক উপমন্ত্রী আসাদুল হাবিব দুলু বলেন, ‘আমাদের এ আন্দোলন কোনো দল বা মতের নয়। এটি গোটা রংপুর অঞ্চলের মানুষের গণদাবি। যার মাধ্যমে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়সহ তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে।’
তিনি জানান, তিস্তা রেলসেতু ও তিস্তা সড়ক সেতুর মধ্যস্থানে আয়োজিত অবস্থান কর্মসূচিতে সকাল থেকে নারী পুরুষ দলে দলে এসে অবস্থান নেন। দুপুর হতেই প্যান্ডেলের ভেতরে মানুষ বিছানা পেতে অবস্থান নেন। কর্মসূচি উপলক্ষ্যে তিস্তা পাড়ে বিশাল বিশাল প্যান্ডেল ও শতাধিক তাবু টানানো হয়েছে।
কর্মসূচি সফল করতে নিলফামারী, রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার ১২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ নদী পাড়ের গুরুত্বপূর্ণ ১১টি স্থানে মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। এসব মঞ্চে তিস্তা পাড়ের মানুষের সুখ দুঃখের ওপর প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী, ভাওয়াইয়া গানের আসর, দিনভর থাকবে ঘুড়ি উৎসবসহ নানান গ্রামীণ খেলাধুলা। স্থানীয়দের নিজেদের চাল ডাল সহায়তায় পরিবেশিত হয় খিচুরিসহ শুকনো খাবার-দাবার। এভাবে টানা ৪৮ ঘণ্টা নদীর তীরেই অবস্থান করবেন লাখো মানুষ।
তিস্তাপাড়ের কৃষক উদ্দিন বলেন, তিস্তার ভাঙনে ১২-১৪ বার বসত ভিটা সরিয়ে নিয়েছি। শুষ্ক মৌসুমে বালু জমিতে কঠোর পরিশ্রম করে যা চাষাবাদ করে পাই সেটুকু দিয়ে চলে পুরো বছর। শুষ্ক মৌসুমে বাড়ি তৈরি করি। বর্ষার বন্যায় তা ভেসে বা ভেঙে যায় নদীতে। যা আয় করি তা সবই তিস্তায় বিলীন হচ্ছে। তাই চাই স্থায়ী বাঁধ।
তিস্তাপাড়ের জেলে অবিনাশ চন্দ্র জানান, বর্ষার তিন মাস মাছ ধরতে পারলেও বাকি সময় পরিবারের খাবার যোগানো কষ্ট হয়ে পড়ে। পানি না থাকায় অনেক জেলে তাদের পেশার পরিবর্তন করেছেন। আগের মতো নেই তিস্তা নদীতে মাঝি মাল্লাদের ডাক হাক। তার দাবি দ্রুত তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে।
তিস্তাপাড়ের আদিতমারী সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক (অব.) আবু তাহের বলেন, বন্যায় ভাঙনরোধে যে অর্থ প্রতিবছর তিস্তায় ভেসে যায়, তা আর যাবে না স্থায়ী বাঁধ হলে। একই সাথে চাষাবাদের আওতায় আসবে হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি। সব মিলে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে পিছিয়ে পড়া তিস্তাপাড়ের মানুষই হবে প্রথম সাঁরির জাতীয় অর্থনৈতিক যোদ্ধা।
জানা গেছে, ভারতের সিকিমে জন্ম নেয়া তিস্তা নদী ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। যা নীলফামারী জেলার কালীগঞ্জ সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী বন্দর হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিশেছে। নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৩১৫ কিলোমিটার হলেও বাংলাদেশ অংশে রয়েছে প্রায় ১২৫ কিলোমিটার।
You cannot copy content of this page