২০২৪ সালের আগস্টে ফ্যাসিবাদি আওয়ামী লীগ সরকারের পতন আন্দোলনে যখন বাংলাদেশের রাজপথ প্রকম্পিত। ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে যখন উত্তাল পুরো দেশ। সেই আন্দোলনের ডাকে সংহতি জানিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতেও বিক্ষোভে নেমেছিলেন কয়েকশত প্রবাসি বাংলাদেশি।
সেই বিক্ষোভ থেকে গ্রেপ্তার হন শতাধিক রেমিট্যান্সযোদ্ধা। তবে সরকার পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপে আটক ১৮৯ জনকে মুক্তি দিয়েছে আরব আমিরাত। কিন্তু চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার অন্তত ৫০ জন প্রবাসী জুলাই যোদ্ধা এখনও বন্দি দুবাইয়ের হাই-সিকিউরিটি আল সদর কারাগারে।
সম্প্রতি এমন তথ্য জানিয়েছেন কারাগারে আটক জুলাই যোদ্ধাদের স্বজনরা। বিষয়টি সম্প্রতি চট্টগ্রাম সফরে আসা জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা হাসনাত আবদুল্লাহর কাছেও জানিয়েছেন বলে জানান প্রবাসীর স্বজনরা। যাদের মুক্তির বিষয়ে সরকারকে জানানোর আশ্বাসও দেন হাসনাত আবদুল্লাহ।
বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন এনসিপির চট্টগ্রাম মহানগর নেতা মোহাম্মদ আতিক। তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদ পতন আন্দোলনের বিক্ষোভ থেকে চট্টগ্রামের যেসব রেমিট্যান্স যোদ্ধারা আরব আমিরাতে গ্রেপ্তার আছেন, আমরা তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
বাংলাদেশ দূতাবাসের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই আন্দোলনে আরব আমিরাতে আটক ২০ জনের তালিকা রয়েছে তাদের কাছে।েআবার মন্ত্রণালয়ের হিসেবে সেই সংখ্যা ২৭। অথচ বন্দি পরিবারের স্বজনরা বলছেন, শুধু আল সদর জেলেই বন্দি আছেন ২৫ জন। অনেকে রয়েছেন অন্য জেলেও। সবমিলিয়ে এখনও ৫০ জনেরও বেশি হবে।
প্রবাসীদের বরাত দিয়ে স্বজনরা বলেন, বন্দিদের মধ্যে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া, লোহাগাড়া, সাতকানিয়া ও ফটিকছড়ির অনেক প্রবাসী রয়েছেন। কয়েকজনের পরিচয়ও নিশ্চিত হওয়া গেছে। এর মধ্যে রয়েছেন— বোয়ালখালী পশ্চিম কধুরখীলের শহিদুল আমিন (পাসপোর্ট: EG0091443), লোহাগাড়া আমিরাবাদের মিজানুর রহমান (পাসপোর্ট: A08329983), রাঙ্গুনিয়া সরফভাটার সাইফুল ইসলাম ও রহমত উল্লাহ (পাসপোর্ট: যথাক্রমে A14125383, A14266803), ফটিকছড়ি হারুয়ালছড়ির জাহিদুল ইসলাম (পাসপোর্ট: A00527006), সাতকানিয়ার নুর হাসান, চট্টগ্রাম মহানগরের সোহেলসহ আরও অনেকে।
এছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগের কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুরসহ আশপাশের জেলা থেকেও বন্দি আছেন অনেকে। এমন ২৫ জনের নামের তালিকা দিয়েছে ‘জুলাই আন্দোলনে জেলবন্দি রেমিট্যান্স যোদ্ধা পরিবার’ সংগঠনটি। এদের মধ্যে রয়েছেন কুমিল্লা বুড়িচংয়ের মোহাম্মদ হাসান, লক্ষ্মীপুর রামগঞ্জের শাহাদাত হোসেন (১) ও শাহাদাত হোসেন (২), কুমিল্লা নাসিরনগরের মন্টু মিয়া, মুদাফপুরগঞ্জের আমান উল্লাহ, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণপাড়ার মাকসুদ আলম সরকার, নোয়াখালী, সেনবাগের জাকের হোসেন রনি, কুমিল্লা নাঙ্গলকোটের শাহাদাত হোসেন, ফেনী দাগনভুইয়ার শাহাদাত হোসেনসহ আরও অনেকে।
আরব আমিরাতে বন্দি ফটিকছড়ির জাহিদুল ইসলামের ভাই রায়হান বলেন, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আন্দোলন করেছিল ভাইটা, এখন তার খবর পর্যন্ত নেয় না সরকার।’
বোয়ালখালীর শহিদুল আমিনের স্ত্রী রোজিনা আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামী ওই সময় দেশে ফিরতে গিয়ে বিমানবন্দরে আটক হন। তখনই জানি, তার নামে মামলা আছে ‘জুলাই আন্দোলনের।’
স্বজনেরা বলছেন, ২০২৪ সালের ২৮ আগস্ট সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ফোন করেন। ওই সময় প্রধান উপদেষ্টা তাকে অনুরোধ করেন ১৮৯ বাংলাদেশিকে ক্ষমা দিতে। এরপর ১১৪ জনকে মুক্তি দিয়ে ফেরত পাঠানো হয়। কিন্তু পরবর্তীতে যাদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা হয়, তাদের বিষয়ে আর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আটকদের জন্য তেমন কোনো কূটনৈতিক তৎপরতাও দেখা যাচ্ছে না।
সূত্রমতে, আন্দোলনকারীদের নাম ও পাসপোর্ট নম্বর ইমিগ্রেশন ডেটাবেইসে সংরক্ষিত রয়েছে। ফলে যারা দেশে ফেরার চেষ্টা করছেন, তাদের বিমানবন্দরেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে আমিরাতে নিযুক্ত শ্রম কাউন্সিলর লুৎফুন নাহার নাজীম বলেন, ‘আমরা বন্দিদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য আবেদন করেছি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের কাছে এ বিষয়ে কেউ অভিযোগ করেনি। তবু বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।’
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের একান্ত সচিব সারওয়ার আলম বলেন, ‘আরব আমিরাতের কর্তৃপক্ষ তার দেশের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছে। আলাদাভাবে কিছু করার সুযোগ নেই। আমরা কেবল চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
মানবাধিকার বিষয়ক আইনজীবী জিয়া হাবিব আহসান বলেন, সরকার যদি দ্রুত এসব তথ্য মুছিয়ে না নেয়, তাহলে এই প্রবাসীদের ভবিষ্যৎ চরম অনিশ্চয়তায় পড়ে যাবে।’
You cannot copy content of this page