
রেলের ওয়াশিং প্ল্যান্ট ক্রয় দুর্নীতিতে ফেঁসে যাচ্ছেন রেলভবনে মহাব্যবস্থাপক (প্রকল্প) হিসেবে কর্মরত ফকির মো. মহিউদ্দিন? দুর্নীতি দমন কমিশন এই ওয়াশিং প্ল্যান্ট ক্রয় দুর্নীতি তদন্তে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এই দূর্নীতিতে তিনি ছাড়াও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন উপসচিব মাহাবুবুল হক, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি রোলিং স্টক) সৈয়দ ফারুক আহমেদসহ আরো কয়েকজন ফাঁসতে পারেন।
এমন তথ্য জানায় দূর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। দুদকের তথ্যমতে, বাংলাদেশ রেলওয়ে ট্রেন ধোয়ার জন্য প্রায় ৪০ কোটি টাকায় দুটি স্বয়ংক্রিয় ধৌতকরণ ব্যবস্থা বা ওয়াশিং প্ল্যান্ট কিনেছিল। এনএইচ কর্পোরেশন নামে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ওয়াশিং প্ল্যান্ট দুটির যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছিল। এর একটি স্থাপন করা হয় ঢাকার কমলাপুরে, অন্যটি রাজশাহীতে। কিন্তু ২০ মাসের মাথায় প্ল্যান্ট দুটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে ঠিকাদার নিয়োগের মাধ্যমে ম্যানুয়ালি ট্রেন ওয়াশ কার্যক্রম চলছে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, দুটি প্ল্যান্ট দিয়ে ২ হাজার ৯২৯ বার ট্রেন ধোয়া সম্ভব হয়েছিল। হিসাব করে দেখা যায়, প্ল্যান্ট দুটি স্থাপনে যে ব্যয় হয়েছে, তাতে প্রতিটি ট্রেন ধোয়ার পেছনে সরকারের খরচ হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। প্রচলিত ব্যবস্থায় হাতে ট্রেন ধুতে খরচ হয় ১ হাজার টাকার মতো। অথচ এই যন্ত্রের কার্যকারিতা দেখতে ২০১৯ সালে এই তিনজন কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন।
চট্টগ্রামের সাবেক সংসদ সদস্য ফজলে করিম চৌধুরী দুই মেয়াদে রেলপথ মন্ত্রণালয় স¤পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন। তার নেক নজরে এই ওয়াশিং প্ল্যান্ট ক্রয়ের সুযোগ পান ফকির মো. মহিউদ্দিন। আর ওয়াশিং প্ল্যান্ট সরবরাহে যুক্ত প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশ প্রতিনিধির পক্ষে কাজও করেছেন ফজলে করিম চৌধুরী। গত বছর ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ফজলে করিম চৌধুরী গ্রেফতার হয়ে এখন কারাগারে রয়েছেন।
অথচ ফকির মো. আলমগীর এসব দুর্নীতি আড়াল করতে রেলওয়েতে বৈষম্যবিরোধী ফোরাম প্রতিষ্ঠা করে রাতারাতি এর মুখ্য সমন্বয়ক হয়ে সদর্পে বুক ফুলিয়ে হাটছেন। এ সুবাধে অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি চতুর্থ গ্রেড থেকে তৃতীয় গ্রেডে পদোন্নতি লাভ করেন। বর্তমানে তিনি রেলের মহাব্যবস্থাপক (প্রকল্প) পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
একইসাথে তিনি রেলওয়ের ২০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন ও ১৫০টি মিটারগেজ কোচ কেনার প্রকল্পেরও পরিচালক। এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা। রেলওয়ে সেক্টরের এসব দুর্নীতির খাত ধরে তদন্তে নেমেছে বর্তমান দুর্নীতি দমন কমিশন। ইতিমধ্যে তারা দুইটি মামলা করেছে। ওয়াশিং প্ল্যান্ট ক্রয় দুর্নীতি নিয়ে তৃতীয় মামলার প্রস্তুতি হিসেবে মাঠে নেমেছে দুদক।
রেলওয়ে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বিগত সরকারের সময় ফকির মো. মহিউদ্দিন অনুসারি হিসেবে নানা সুবিধা ভোগ করলেও এখন নিজেকে বৈষম্যের শিকার দাবি করে বিভিন্ন মহলে লবিং করছেন। সরকার পরিবর্তনের পর সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি পদোন্নতি বাগিয়ে নেন। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে এই পদোন্নতির পরই তার অনিয়ম ও দুর্নীতির মাত্রা বেড়ে যায়।
রেলের বিভিন্ন প্রকল্পে ভ্যারিয়েশন পদ্ধতি ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকার অনিয়ম করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে ফকির মো. মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে। তিনি ঠিকাদার পরিবর্তন করে নিজেই কেনাকাটার ব্যবসা পরিচালনা করেছেন বলেও দাবি করেছেন রেলের একাধিক কর্মকর্তা।
এছাড়া অপ্রয়োজনীয় ওয়াশিং প্ল্যান্ট স্থাপন, অনুমোদনহীন এয়ার ব্রেক কেনার নামে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা আত্নসাৎ এবং ঠিকাদারকে বিল প্রদান ছাড়াই মালপত্র সরবরাহ দেখিয়ে টাকা তোলার মতো অভিযোগও এসেছে তার বিরুদ্ধে। এইসব অভিযোগের ভিত্তিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতোমধ্যেই অনুসন্ধান শুরু করেছে।
রেল ভবনের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই ফকির মো. মহিউদ্দীন কিছু ছাত্র সমন্বয়ককে ভুল বুঝিয়ে রেল ভবনে শোডাউন করেন। তবে এর আগে তিনি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (আইইবি) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে সক্রিয়ভাবে প্রচারে অংশ নিয়েছিলেন।
সে সময়ের প্রচারাভিযানের ছবি এখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ২০০১ সালের মে মাসে বাংলাদেশ রেলওয়ের সহকারী যন্ত্র-প্রকৌশলী পদে যোগ দেন ফকির মো. মহিউদ্দিন। ২৫ বছরের চাকরিজীবনের মধ্যে প্রায় ১২ বছর তিনি ছিলেন মেকানিক্যাল বিভাগের সবচেয়ে লাভজনক পদগুলোতে।
পদগুলোর অন্যতম হচ্ছে সৈয়দপুরের সহকারী কর্মব্যবস্থাপক (নির্মাণ), বিভাগীয় যন্ত্র প্রকৌশলী (লোকো), কর্মব্যবস্থাপক (নির্মাণ) পাহাড়তলী, বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক (কারখানা) পাহাড়তলী, প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী (উন্নয়ন), প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী (পূর্ব) চট্টগ্রাম, যুগ্ম মহাপরিচালক (উন্নয়ন) রেলভবন।
এসব পদে থেকেই তিনি কেনাকাটা, দরপত্র, বাজেট নির্বাহ, বদলি ও পদায়নের প্রস্তাব দেওয়ার ক্ষমতা প্রয়োগ করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। রেলের একাধিক কর্মকর্তা মনে করছেন, এই ফোরাম মূলত ফকির মো. মহিউদ্দিনের অতীত অনিয়ম ঢাকতে তৈরি করা হয়েছে।
এই বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে মহাব্যবস্থাপক (প্রকল্প) ফকির মো. মহিউদ্দিন বলেন, আমি এ বিষয়ে কোন মন্তব্য দিতে চাই না। কারণ এসব বিষয় নিয়ে দুদক থেকে কোনরকম চিঠি দিয়ে রেলভবনে বা আমার কাছে তথ্য চায়নি। কোনরকম প্রাথমিক তদন্তও দুদক করেনি। তাহলে দুদকের মামলা করবে কীভাবে? বরং মামলার বিষয়ে যারা বলছে আমি চাইলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওয়াশিং প্ল্যান্ট অচল নয়, পুরোপুরি সচল। সাম্প্রতিক সময়েও সেটি চালু করে দেখানো হয়েছে। এটি আমেরিকার তৈরী অত্যাধুনিক একটি ওয়াশিং যন্ত্র। মেশিনটি বন্ধ হওয়ার বিষয়টি নিছক গুজব। তবে উপকরণের সংকটে মেশিনটি চালানো সম্ভব হচ্ছে না, এটাই আসল কথা। ফলে প্রচলিত পদ্ধতিতে ট্রেন ওয়াশ চলছে।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গত ১৫ বছর অনেকের মতো আমিও মুখ খুলতে পারিনি। কারণ আমি ডান ঘরানার লোক ছিলাম। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সরকার পতনের পর আমিও রেলের বৈষম্য নিয়ে কথা বলেছি। কোন ধরণের ফোরাম বা সংগঠন আমি করিনি। বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেন তিনি।
আক্ষেপ করে তিনি বলেন, সামনে আমার এডিজি পদে পদোন্নতি হওয়ার সময়। ফলে গত ১৫ বছর ধরে সুবিধাভোগীরা আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে, বিতর্কিত করছে। যাতে আমার পদোন্নতি আটকে দেওয়া যায়। আমার দোষ, তারা যে রেলভবনে ২৫ বছর ধরে চাকরি করছেন সেটা কেন বললাম। আর আমাকে বিতর্কিত করে যদি রেলভবন থেকে সরানো যায়। পদোন্নতি আটকানো যায় তাহলে রেলভবনে চাকরি করা তাদের জন্য সহজ হয়ে যায়।
 
				 
															





 
								





































