
# সংঘর্ষের ঘটনায় মামলা
# আসামি ১০০০, গ্রেফতার ৮
# চবির অস্ত্রাগার লুটের ঘটনায় জিডি
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পার্শ্ববর্তি গ্রামাবাসীর সংঘর্ষের ঘটনায় মামলা দায়েরের পর ধরপাকড় শুরু করেছে পুলিশ। বুধবার (৩ সেপ্টেম্বর) সকাল পর্যন্ত সংঘর্ষে জড়িত ৮ জনকে গ্রেফতারের কথা জানিয়েছেন হাটহাজারী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবু কাওসার মাহমুদ হোসেন।
গ্রেফতাররা হলেন মো. ইমরান হোসেন প্রকাশ (৩৫), হাসান প্রকাশ হাসাঈন (২২), রাসেল প্রকাশ ওরফে কালো রাসেল (৩০), মো. আলমগীর (৩৫), মো. নজরুল ইসলাম (৩০), মো. জাহেদ (৩০), মো. আরমান (২৪) ও মো. দিদারুল আলম (৪৬)।
ওসি আবু কাওসার মাহমুদ বলেন, মঙ্গলবার রাত ১০টা থেকে বুধবার সকাল ৭ টার মধ্যে বিশেষ অভিযান চালিয়ে ৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদেরকে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদনসহ জেলা আদালতে পাঠানো হয়েছে। গ্রেফতার অভিযান চলমান রয়েছে।
সংঘর্ষের ঘটনায় মামলা, আসামি ১০০০
সংঘর্ষের ঘটনায় মঙ্গলবার (২ আগস্ট) বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা দপ্তরের প্রধান আবদুর রহিম বাদী হয়ে হাটহাজারী থানায় মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় স্থানীয় এক যুবলীগ কর্মীকে প্রধান আসামি করে ৯৫ জনকে নামীয় আসামি ও অজ্ঞাত আরও ৮০০-১০০০ জনকে আসামি করা হয়। একই সাথে চবির অস্ত্রাগার লুটের ঘটনায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করেছেন তিনি।
তবে মামলা দায়েরের পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংলগ্ন হাটাহাজারী উপজেলার জোবরা গ্রাম প্রায়ই পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। এরপরও অভিযানে ৮ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করলেও আসামিদের বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন হাটহাজারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু কাওসার মোহাম্মদ।
তিনি বলেন, সংঘর্ষের ঘটনায় মামলা যেমন হয়েছে, আবার চবির অস্ত্রগার লুটের ঘটনায় একটি জিডিও হয়েছে। যার আইনগত প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। মামলা ও জিডির তথ্য মোতাবেক অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে।
অস্ত্র ফেরত দিতে ৪৮ ঘন্টার আল্টিমেটাম
গ্রামবাসীর সঙ্গে সংঘর্ষের সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা দফতরের অস্ত্রাগারের তালা ভেঙে উত্তেজিত একদল শিক্ষার্থী ১৩০টি রাম দা নিয়ে গেছে। অস্ত্রগুলো উদ্ধারে কঠোর অবস্থান ঘোষণা করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় চবি প্রক্টরের অধ্যাপক ড. তানভীর মোহাম্মদ হায়দার আরিফের সই করা এক জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে অস্ত্রগুলো জমা দেওয়ার জন্য ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে জব্দ করা দেশীয় অস্ত্র নিরাপত্তা দফতরে সংরক্ষিত ছিল, যা গত ৩১ আগস্ট শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী জোবরা গ্রামবাসীর সংঘর্ষের সময় নিরাপত্তা দফতর থেকে চুরি হয়।
চুরি করা দেশীয় অস্ত্রগুলো যাদের কাছে আছে, তাদের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে চবির নিরাপত্তা দফতরে জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়ে প্রক্টর জানিয়েছেন, অন্যথায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। অস্ত্র লুটের ঘটনায় চবির নিরাপত্তা দফতরের প্রধান আব্দুর রহিম হাটহাজারী থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে।
এর আগে মঙ্গলবার দুপুরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইয়াহইয়া আখতার প্রক্টরিয়াল বডি, প্রশাসনের কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে বৈঠকে অস্ত্রাগার লুট নিয়ে সহকারী প্রক্টর নাজমুল হোসাইনের দেওয়া একটি বক্তব্য ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।
ওই ভিডিওতে দেখা গেছে, নাজমুল হোসাইন তার বক্তব্যের একপর্যায়ে উপাচার্যকে উদ্দেশ্য করে বলছেন-অস্ত্রাগার লুটের বিষয়টি একটু বলি। পাঁচ আগস্টের (২০২৪) পরে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমরা ১৬০ পিস রামদা কালেক্ট করেছি। এখানে আমি প্রক্টরিয়াল বডির সদস্য হিসেবে অ্যাকটিভলি কাজ করেছি।
এই অস্ত্রাগারটি লুট করার জন্য ৬টি তালা ভাঙ্গা হয়েছে। এসময় আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের মারাত্নকভাবে আহত করা হয়েছে। উনারা ছাত্রদের পায়ে পড়েছেন। প্রোভিসি-এডমিন স্যার অনুরোধ করেছেন- তোমরা প্লিজ এটা করবে না, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এটা ভালো দেখাবে না। স্যার অনেক কথা বলেছেন, কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারিনি। ১৩০ পিস রামদা আমাদের অস্ত্রাগার থেকে লুট হয়েছে। আমি সকল ছাত্র সংগঠনের সহযোগিতা চাই। সেটা আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্যই হয়তো কোনোসময় বুমেরাং হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছি।
পুরুষশূন্য জোবরা গ্রাম
গত শনিবার (৩০ আগস্ট) রাতে ও পরদিন রোববার সকাল থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় গ্রামবাসীর দফায়, দফায় সংঘর্ষ হয়। এতে অন্তত ১৫০০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। তিন শতাধিক আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। আহতদের মধ্যে প্রক্টরিয়াল বডির কয়েকজন সদস্য এবং একজন উপ-উপাচার্যও আছেন।
তবে দ্বিতীয় দফায় সংঘর্ষের একপর্যায়ে রোববার দুপুর ২টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসন। এতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। তবে এ ঘটনায় মামলা দায়েরের পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) সংলগ্ন জোবরা গ্রাম আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে পড়ে। পুরুষেরা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। গ্রামটি হয়ে পড়েছে প্রায় পুরুষশূন্য। গ্রামের রাস্তাঘাটে কেবল নারীর দেখা মিলছে। তারাও ভয়ে ভরসাহীন দিন কাটাচ্ছেন। রাতের আঁধারে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে প্রতিরোধ করার মতো কাউকে পাওয়া যাবে না এমন আতঙ্কে দিন গুনছেন সবাই।
সরেজমিনে দেখা যায়, জোবরা এলাকা প্রায় পুরুষশূন্য। স্থানীয় নারীরা জানান, রাতে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে প্রতিরোধ করার মতো কেউ নেই। ফলে তারা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এ অবস্থায় পরিস্থিতি শান্ত করতে মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) ওই এলাকা পরিদর্শন করেন হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মুমিন।
তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে গ্রামবাসী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করলেও সাম্প্রতিক একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে এলাকায় অশান্তি দেখা দিয়েছে। প্রশাসন উভয় পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, একাডেমিক ও সামাজিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। গ্রামবাসী ও শিক্ষার্থীরা যেন মিলেমিশে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারেন, সে লক্ষ্যে প্রশাসন কাজ করছে।
ইউএনওর পরিদর্শনকালে আরো উপস্থিত ছিলেন উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক নূর মোহাম্মদ, ফতেপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মো. জাকির হোসেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মুছা সিদ্দিকী, ২ নম্বর ইউপি সদস্য আব্দুল কাদের, মো. আবুল বশর বাবুল, আনন্দ বিকাশ বড়ুয়া, মো. মোজাহের ও লোকমান চৌধুরী।
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব নাছির উদ্দিন মুনির এ প্রসঙ্গে বলেন, জোবরা গ্রামবাসী তাদের জায়গা-জমি বিসর্জন দিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। তখন থেকে গ্রামবাসী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সুস¤পর্ক বজায় ছিল, যা নব্বইয়ের দশকে ছাত্র থাকাকালে দেখেছি। একটি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ সংঘর্ষে অত্যন্ত মর্মাহত হেফাজতের এই নেতা।
সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে নাছির উদ্দিন বলেন, এ ঘটনায় শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আহত হননি। গ্রামবাসীরাও আহত হয়েছেন। ঘটনার সঠিক তদন্তে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। পাশাপাশি গ্রামবাসীর ক্ষয়ক্ষতির ক্ষতিপূরণ এবং আহত শিক্ষার্থী ও গ্রামবাসীর সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা জরুরি।
উল্লেখ্য, গত শনিবার (৩০ আগস্ট) রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট এলাকায় ভাড়া বাসায় দেরিতে প্রবেশ করা নিয়ে এক ছাত্রীকে দারোয়ানের চড় দেয়ার অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাত ১২টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের মধ্যে সংঘর্ষ চলে। পরদিন রবিবার সংঘর্ষ আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। সকাল ১১টা থেকে ফের শুরু হয়ে টানা সংঘর্ষ চলে বিকাল ৫টা পর্যন্ত। এতে প্রায় ১৫০০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন বলে দাবি করছেন চবির প্রশাসন
তবে চবি মেডিকেল সেন্টারের প্রধান ডা. আবু তৈয়বের সর্বশেষ তথ্যমতে, সংঘর্ষে ৪২১ জন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৪ জনকে গুরুতর আহত অবস্থায় আইসিইউতে নেওয়া হয়েছিল। পরে অবস্থার উন্নতি হলে ২ জনকে সাধারণ বেডে স্থানান্তর করা হয়। এক জনকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে। একজনের অবস্থা গুরুতর।