
নিষিদ্ধ ঘোষিত সিগারেটের নকল ব্যান্ডরোল বা সিগারেটের প্যাকেটে লাগানো ট্যাক্স স্ট্যা¤প আমদানি, নকল সিগারেট বাজারজাতকরণ, ইয়াবা পাচার ও জুয়া খেলায় ফুলে ফেঁপে ওঠেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) সাবেক প্যানেল মেয়র আবদুস সবুর লিটনের অর্থের ভান্ডার।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে এসব চোরকারবারিতে জড়িত হয়ে কুড়িয়ে নিয়েছেন কাড়ি কাড়ি টাকা। রামপুরা বউবাজারে কিনেছেন জমি। করেছেন বিলাসবহুল বাড়ি। গড়ে তোলেছেন একের পর এক সিগারেট কারখানা। বনে যান কাউন্সিলর, প্যানেল মেয়র। হতে চেয়েছিলেন এমপিও।
আর তার পেছনে রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করেছেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ও সাবেক চসিক মেয়র মরহুম মহিউদ্দিন চৌধুরীর গুণধর পূত্র মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। গড়ে তুলেছেন অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘বাংলাধারা’। যেটি এখনো চলমান। দীর্ঘ ১৬ বছর এই নিউজ পোর্টালের প্রকাশক হিসেবে আবদুস সবুর লিটনের নাম প্রচার পেলেও গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর গায়েব হয়ে যাই সেই নাম।
দেশের বিভিন্ন সংস্থার গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে আসে এমন তথ্য। কিন্তু নওফেলের প্রভাবের কারণে চোরাকারবারি আবদুস সবুর লিটনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি প্রশাসন। বরং বীরদর্পে চালিয়েছেন এসব অপকর্ম।
তবে গোয়েন্দা সংস্থার গোপন তথ্যের ভিত্তিতে গত বৃহ¯পতিবার (১৭ অক্টোবর) বিকেলে প্রথমবারের মতো নগরীর হালিশহর থানাধীন একটি গোডাউনে অভিযান চালিয়ে ৩ কোটি ৩৭ লাখ ৫০ হাজার পিস সিগারেট স্ট্যা¤প, ১৪৮টি সাদা বড় রোল, ৪২৫টি সাদা ছোট রোল, ১২৬টি কালো বড় রোল ও ১ হাজার ৩৭টি কালো ছোট রোল জব্দ করা হয়।
এরপর শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) দুপুর ২টা থেকে নগরীর হালিশহর থানার বউবাজার আমতল এবং ধুপাপাড়া এলাকায় থাকা আরও দুটি গোডাউনে পৃথক অভিযান চালানো হয়। এই অভিযানেও বিপুল পরিমাণে বিদেশি সিগারেটের প্যাকেট, নকল ব্যান্ড রোল ও অবৈধ বিভিন্ন জিনিসপত্র জব্দ করা হয়েছে। সেগুলো পর্যালোচনার কাজ চলছে। পরে বিস্তারিত জানাবো।
চট্টগ্রাম কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট এবং কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের যৌথ একটি টিম এ অভিযান পরিচালনা করে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে বৃহ¯পতিবার অভিযানের প্রেক্ষিতে শুক্রবারও তার দুটি পৃথক গোডাউনে অভিযান পরিচালনা করা হয়। গুদাম থেকে জব্দ করা এসব জিনিস চট্টগ্রাম কাস্টমস, ভ্যাট ও কমিশনারেটের গুদামে জমা করা হয়েছে।
এর আগে গত ১২ অক্টোবর গভীর রাতে নগরীর গ্রিনভিউ আবাসিক এলাকার সামনে থেকে তামাকবোঝাই একটি কাভার্ডভ্যান আটক করেন স্থানীয়রা। এরপর কাস্টমসের সংশ্লিষ্ট বিভাগ তদন্ত করে তামাকভর্তি গাড়িটি আবদুস সবুর লিটনের বলে নিশ্চিত হয়। গাড়িটিতে ২০৪ বস্তা তামাক ছিল, যার ওজন ৪ হাজার ৯৯৪ কেজি। এসব তামাক নগরীর চান্দগাঁও এলাকা থেকে কক্সবাজারের চকরিয়ায় যাওয়ার কথা ছিল বলে জানান পাহাড়তলী থানার ওসি বাবুল আজাদ। তিনি জানান, কাভার্ড ভ্যানভর্তি তামাক লিটনের বিজয় ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকোর।
চট্টগ্রাম কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ তফছির উদ্দিন ভূঁঞা বলেন, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের যোগসাজশে বিদেশ থেকে অবৈধ ব্যান্ডরোল আমদানির কারণে আলোচিত আওয়ামী লীগ নেতা কাউন্সিলর আবদুস সবুর লিটন। বিজয় ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো ও তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকোসহ কয়েকটি সিগারেট কারখানার মালিক তিনি।
এসব কারখানায় প্রস্তুত করা সিগারেটে নকল ব্যান্ডরোল লাগানো হতো। ভ্যাট গোয়েন্দাদের একটি টিম তদন্ত করে এসবের সত্যতা পেয়েছিলেন কয়েক বছর আগেই। তবে নওফেলের প্রভাবের কারণে শেষমেষ লিটন ওরফে বিড়ি লিটনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি এনবিআর।
জানা গেছে, কিশোরগঞ্জের ভৈরবে তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো এবং কক্সবাজারের চকরিয়ায় বিজয় ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো নামে দুটি প্রতিষ্ঠানই সাবেক প্যানেল মেয়র লিটন ও তার ছোট ভাই খোকনের। এই দুটি কো¤পানি ওরিস ও ইজি লাইটসের মতো বিদেশি ব্র্যান্ডের সিগারেটের নকলসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেট তৈরি করছে। দেশের অবৈধ সিগারেট বাজারের একটা বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে এই দুটি প্রতিষ্ঠান।
এছাড়া নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীর নামে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান খুলে তারা নকল ব্যান্ডরোল আমদানি করেন। পরবর্তী সময়ে সেগুলো নিজেদের সিগারেট কারখানায় ব্যবহার করা হয়। অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংক হিসাব খোলা, এলসি খুলে কাগজ ও আর্ট পেপার আমদানির নামে নকল ব্যান্ডরোল আমদানি করে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন লিটন।
২০২২ সালে গোয়েন্দা সংস্থার একটি প্রতিবেদনে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাধর মন্ত্রীর আশীর্বাদ থাকায় তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সূত্র মতে, চসিকের প্যানেল মেয়র হওয়ার জন্য অধিকাংশ কাউন্সিলরকে লাখ টাকা দামের আইফোন উপহার দেওয়াসহ নানা অভিযোগ ও বিতর্ক রয়েছে লিটনের বিরুদ্ধে। আর এই অবৈধ আয়ের উল্লেখযোগ্য খাত ছিল নিষিদ্ধ ব্যান্ডরোল আমদানি ও নকল সিগারেট বাজারজাত করা।
সূত্র জানায়, সাবেক কাউন্সিলর লিটন চসিকের ২৫ নম্বর রামপুরা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়কের দায়িত্বে আছেন। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে চসিকের সাবেক এ কাউন্সিলর পলাতক রয়েছেন।
এ সম্পর্কিত আরও খবর পড়ুন :