
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের লোহাগাড়ার চুনতি অভয়ারণ্যের বনরেঞ্জ কার্যালয়ের সামনে জাঙ্গালিয়া মাজারটেক এলাকায় ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার শোক না কাটতেই এলো আরও একটি বিষাদের খবর। মৃত্যুর সাথে দু‘দিন পাঞ্জা লড়ে নিভে গেল তাসনিয়া ইসলাম প্রেমা (১৮) নামে আরও একটি তাজা প্রাণ।
শুক্রবার (৪ এপ্রিল) দুপুর ১২টার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) বিছানায় নিভে যায় তার জীবন প্রদীপ। এই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শুধু একটি সম্ভাবনাময় তরুণ প্রাণের অবসান ঘটলো না, আক্ষরিক অর্থে শূন্য হয়ে গেল গোটা একটি পরিবার।
বুধবারের সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছিল প্রেমার বাবা রফিকুল ইসলাম শামীম (৪৬), মা লুৎফুন নাহার সুমি (৩৫), বোন আনিসা (১৬) ও লিয়ানা (০৮)। প্রেমা ছিলেন সেই পরিবারের বেঁচে থাকা একমাত্র সদস্য। কিন্তু সব লড়াই ব্যর্থ করে দিয়ে তিনিও চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন জুলাই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক তানিফা ইয়াসমিনও (১৯)। তানিফা ইয়াসমিন ছিলেন তাসনিয়া ইসলাম প্রেমার ফুফাতো বোন। যারা সেদিন মাইক্রোবাসে করে কক্সবাজার যাচ্ছিলেন সমুদ্রের গর্জন দেখতে। তার আগেই ঘাতক রিলাক্স পরিবহনের বাসের গর্জনে একে একে থেমে যায় ১০টি প্রাণ। তাদের মিছিলে যোগ হল প্রেমাও। তাতে মোট মৃতের সংখ্যা দাড়াল এগারো জনে।
চমেকের আইসিইউ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. হারুনুর রশিদ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জানান, দুর্ঘটনার পর থেকেই প্রেমা অচেতন ছিলেন। তার অবস্থা ছিল আশঙ্কাজনক। জীবন বাঁচানোর শেষ চেষ্টা হিসেবে তাকে আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল। কিন্তু সময়ের সাথে তার অবস্থার অবনতি ঘটে। শুক্রবার দুপুরে আমরা তাকে মৃত ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছি।
এছাড়া এই বিষাদের খবরের মধ্যে আরেক আহত শিশু, আট বছরের আরাধ্য বিশ্বাসকে বাচাতে বুকভরা আশা নিয়ে স্বজনেরা যাত্রা করেছেন ঢাকার পথে। মা-বাবা দিলীপ বিশ্বাস (৪৩) ও সাধনা মন্ডল (৩৭) কে একই দুর্ঘটনায় হারানো ছোট্ট আরাধ্যকে উন্নত চিকিৎসার জন্য শুক্রবার দুপুর সোয়া বারোটার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালের উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
দুর্ঘটনার পর থেকে চমেক হাসপাতালের আইসিইউতে মৃত্যুর সাথে লড়ছিল শিশু আরাধ্য। ছোট্ট মেয়েটির চোখে হয়তো এখনো ভাসছে সেদিনের সেই ভয়াবহ স্মৃতি, কিন্তু তার স্বজন আর চিকিৎসকেরা মরিয়া তাকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য। চমেক হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগে এখনো যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত আরেক তরুণ, দুর্জয় কুমার মন্ডল (১৮)। তিনি আরাধ্যর মামাতো ভাই। তিনিও হারিয়েছেন নিকটাত্নীয়দের।
চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. তাসলিম উদ্দীন জানান, আরাধ্যকে ঢাকায় উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে এবং দুর্জয় এখানে চিকিৎসাধীন আছেন। এর মধ্যে আমরা তাসনিয়া ইসলাম প্রেমাকে হারিয়েছি। এর আগে দুর্ঘটনায় হারানোদের মধ্যে রয়েছেন দিলীপের শ্বশুর আশীষ মন্ডল (৫০)।মৃত রফিকুল ইসলামের মামা মুক্তার হোসেন (৬০) ও মাইক্রোবাস চালক ঢাকার দক্ষিণ খান এলাকার কালা মিয়ার ছেলে মো. ইউসুফ আলী (৫৫)।
দোহাজারী হাইওয়ে পুলিশ নিহতদের পরিচয় নিশ্চিত করে এই তালিকা প্রকাশ করেছে বুধবার (২ এপ্রিল) রাতে। পুলিশের তথ্যমতে, ঈদের ছুটিতে কক্সবাজারের সমুদ্র দেখার স্বপ্ন নিয়ে ঘর ছেড়েছিলেন ঢাকার মিরপুরের রফিকুল ইসলাম ও তার পরিবার এবং তাদের সহকর্মী ঝিনাইদহের দিলীপ বিশ্বাসের পরিবার। দুটি পরিবারের সদস্যরা মিলে একটি মাইক্রোবাসে করে যাচ্ছিলেন আনন্দ ভ্রমণে। কিন্তু পথিমধ্যে লোহাগাড়ার চুনতি জাঙ্গালিয়া মাজারটেক এলাকায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা তাদের সব স্বপ্নকে ধুলিসাৎ করে দেয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামগামী রিলাক্স পরিবহনের একটি বেপরোয়া গতির বাস মহাসড়কের বাঁকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আড়াআড়ি হয়ে যায়। ঠিক তখনই বিপরীত দিক থেকে আসা এই পরিবারগুলোর মাইক্রোবাসটির সাথে ঘটে মুখোমুখি সংঘর্ষ। মুহূর্তের মধ্যে আরেকটি দ্রুতগতির মাইক্রোবাস পেছন থেকে ধাক্কা দেয় দুর্ঘটনাকবলিত মাইক্রোবাসটিকে। আর তাতেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় কয়েকটি জীবন, ভেঙে চুরমার হয়ে যায় কতগুলো সাজানো সংসার।