
এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়া ছয়টি বেসরকারি ইসলামী ব্যাংক থেকে চাকরিচ্যুতির প্রতিবাদে চট্টগ্রামের পটিয়ায় ২৬টি ব্যাংকে তালা ঝুলিয়ে বিক্ষোভ করেছেন ব্যাংকাররা। করেছেন চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক অবরোধও। এতে চরম দুর্ভোগের শিকার হন সাধারণ মানুষ।
রোববার (১০ আগস্ট) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত প্রায় সাত ঘণ্টা ধরে বিক্ষোভ করেন চাকরিচ্যুত ব্যাংকাররা। এ সময় সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে বন্ধ ছিল লেনদেন। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট।
তবে দুপুর দুইটার পর স্থানীয় প্রশাসনের সাথে বৈঠকে চাকুরিতে পুনর্বহালের আশ্বাসে আন্দোলনকারীরা অবরোধ তুলে নিলে সচল হয় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক। লেনদেন শুরু হয় ব্যাংকগুলোতেও। স্বস্তি ফিরে পায় সাধারণ মানুষ।
বিক্ষোভকারীরা জানান, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা অন্তঃত ৬টি ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদ ভেঙে দেয়। ব্যাংকগুলো হলো- ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক।
নতুন পরিষদের হাতে দায়িত্ব হস্তান্তরের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়। এরপর এসব ব্যাংক থেকে এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকার সময় নিয়োগ পাওয়া প্রায় সাত হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বিনা নোটিশে, বিনা কারণে চাকরিচ্যুত করা হয়।
চাকরিচ্যুতদের অভিযোগ, ব্যাংকগুলোতে কর্মরতদের মধ্যে যাদের বাড়ি এস আলমের বাড়ি অর্থাৎ পটিয়া উপজেলায় তাদের এবং চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের বেছে বেছে বিনা নোটিশে অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এতে প্রায় সাত হাজার ব্যাংক কর্মী বেকার হয়ে পড়েছেন। এদের মধ্যে অনেকের বয়স শেষ হয়ে যাওয়ায় তারা কোথাও চাকরিও পাচ্ছেন না। ফলে হাজার-হাজার পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছে। তাই চাকরি ফিরে পেতে তারা এই কর্মসূচি দিয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রবিবার সকাল ৭টা থেকে চাকরিচ্যুত শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জড়ো হতে থাকেন। সকাল ৮টার দিকে তারা পটিয়া সদরে থাকা ২৬টি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের শাখার মূল ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেন।
পরে সকাল সাড়ে ৮টায় তারা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন এবং পটিয়া থানার মোড়ে অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ করেন। হঠাৎ ব্যাংক বন্ধ ও সড়ক অবরোধে চরম ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ।
আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করে উপজেলা ইসলামী ফ্রন্টের সভাপতি সৈয়দ এয়ার মুহাম্মদ পেয়ারু, দক্ষিণ জেলা গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক ডা. এমদাদুল হাসানসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতারা বক্তব্য দেন।
আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা মফিজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমাদের অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। চাকরিতে পুনর্বহাল করা না হলে ভবিষ্যতে দক্ষিণ চট্টগ্রামে আরও কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের চাকরিচ্যুত ক্যাশ অফিসার তারেকুর রহমান বলেন, হঠাৎ করেই কোনো কারণ ছাড়া আমাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। আমি অসহায় হয়ে পড়েছি। চাকরি ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাব।
প্রশাসনের আশ্বাসে অবরোধ প্রত্যাহার
দুপুর ১টার দিকে পটিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারহানুর রহমান, চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) আসাদুজ্জামান ও পটিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন।
বৈঠকে প্রশাসনের কর্মকর্তারা তাদের দাবি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাস দিলে দুপুর ২টায় আন্দোলনকারীরা অবরোধ তুলে নেন এবং ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম শুরু হয়। এর মধ্যে কোন ব্যাংকে লেনদেন হলেও বেশিরভাগ ব্যাংকে অর্থ লেনদেন হয়নি।
সোনালী ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে আসা পটিয়ার কোলাগাও এলাকার বাসিন্দা জমির উদ্দিন বলেন, ব্যাংকে এসে দেখি গেটে তালা ঝুলছে। এতে আমার জরুরি লেনদেন আটকে গেছে। দুইটার পর ব্যাংকের দরজা খুললেও অর্থ লেনদেন হয়নি তেমন।
পূবালী ব্যাংকের পটিয়া শাখা ব্যবস্থাপক বিপ্লব চক্রবর্তী বলেন, সপ্তাহের প্রথম দিনে গ্রাহকের চাপ বেশি থাকে। অবরোধের কারণে সকাল থেকে কার্যক্রম বন্ধ থাকায় গ্রাহকরা ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। দুপুর ২টা পর কিছু লেনদেন হয়েছে।
জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপক নাজিম জানান, দুপুর পৌনে ২টার দিকে লেনদেন চালু হওয়ার পর কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়।
পটিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারহানুর রহমান বলেন, কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের চাকরিচ্যুত কর্মীরা সকাল থেকে আন্দোলন করছিলেন। আমরা পুলিশ সদস্যদের নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। গ্রাহকের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে উনাদের ব্যাংকগুলোর প্রবেশপথ থেকে সরে যাবার অনুরোধ করি। দুপুর ১টা থেকে উনারা সরে যেতে শুরু করেন। প্রথমে সোনালী ব্যাংক, এরপর পর্যায়ক্রমে সব ব্যাংকের সামনে থেকে উনারা সরে যান।
চট্টগ্রামের পটিয়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরিফুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকের সামনে চাকরিচ্যুত লোকজন বিক্ষোভ করেছেন। আমরা তাদের বুঝিয়ে সরিয়ে দিয়েছি। মহাসড়কেও কিছুক্ষণ অবস্থান নিয়েছিল। তবে সেখান থেকে তারা আবার নিজেরাই সরে যান। পরে ব্যাংকিং কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়ে যায়।