
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) চট্টগ্রামের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (এসই) খ. ম জুলিফকার তারেকের দূর্নীতির ঘুষের টাকা (ব্ল্যাক মানি) পাচার হয়ে যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়ায় থাকা পরিবারের কাছে। যা অর্থপাচার আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
গত ৬ বছর ধরে অর্থপাচার করে আসলেও সংশ্লিষ্ট আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে আসেননি তিনি একবারও। ফলে অস্ট্রেলিয়ায় পরিবারের কাছে অর্থপাচার করা মামুলি ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে এই কর্মকর্তার জন্য। যদিও তিনি বিষয়টিকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে উপস্থাপন করছেন অন্যভাবে।
তার দাবি-অস্ট্রেলিয়ায় তার স্ত্রী ও সন্তানদের নাগরিকত্ব আছে। ফলে ভাতা হিসেবে তারা যা পান তা তার বেতনের চেয়েও বেশি। সুতরাং তাকে পরিবারের কাছে তেমন অর্থ পাঠাতে হয় না। তবে স্ত্রী সন্তানের জন্য ঘন ঘন অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন তিনি।
তিনি বলেন, অস্ট্রেলিয়ায় আমার মেয়ে ডাক্তারি পড়ছে। সেখানে টিউশন ফি ফৃ। উল্টো আমার মেয়ে ইয়থ এলাউন্স পায় যা বাংলাদেশের লাখ টাকার চেয়েও বেশি। তাছাড়া আমার স্ত্রী সেখানে জব করেন। ছোট-খাট জব হলেও তার বেতন আমার চেয়ে বেশি।
বেতন যেমন বেশি জীবন-যাপনও তো তেমন ব্যয় বহুল এমন প্রশ্ন করা হলে চমকে উঠে তিনি বলেন, হ্যাঁ বেশি, তারপরও আমাকে তেমন টাকা পাঠাতে হয় না। দেশের স্বজনদের দেখাশুনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি তাদেরকেও দেখেন বলে জানান। আর ঘন ঘন অস্ট্রেলিয়া সফরে খরচের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।
সূত্র জানায়, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (এসই) খ. ম. জুলফিকার তারেক গত ছয় বছর ধরে চিকিৎসা, ওয়ার্কশপ, অভিজ্ঞতা শেয়ার ও সেমিনারের নামে একাধিকবার সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাস্ট্র ও থাইল্যান্ড সফর করেছেন। সরকারি আদেশে তিনি বিদেশ গেলেও আদেশের শর্ত ভঙ্গ করে অতিরিক্ত ছুটি কাটিয়ে আসেন।
সর্বশেষ তিনদিনের ছুটি নিয়ে থাইল্যান্ডে ওয়ার্কশপে গিয়ে মেয়াদ বাড়িয়েছেন আরও ১০ দিন। কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন মোট ২৩ দিন। অভিযোগ উঠেছে, জুলফিকার তারেক বেশিরভাগ সময় চিকিৎসা কিংবা সেমিনারের নামে সরকারি আদেশে বিদেশ গেলেও তিনি থাকেন অস্ট্রেলিয়ায়। ২০১৯ সালে শিক্ষা ছুটিতে অস্ট্রেলিয়া গিয়ে সেখানে বসতি গেড়েছেন। স্ত্রী-সন্তানরা সেখানেই থাকেন। যে কারণে ঘন ঘন অস্ট্রেলিয়ায় পরিবারের কাছে যেতেই কৌশলে চিকিৎসা ও ওয়ার্কশপের ছুটি নিয়ে বিদেশ যান তিনি।
অস্ট্রেলিয়ায় তিনি কিনেছেন বিলাস বহুল বাড়ি, স্ত্রী-সন্তানের জন্য কিনেছেন গাড়ি। যা শতকোটি টাকারও বেশি দামি। পাউবোর চাকরির সূত্রে দেশে আসলেও তার মন টিকে না। বছরে তিনি দুই থেকে তিন বার অস্ট্রেলিয়া যান। চলতি বছরের আট মাসে তিনি দুই বার অস্ট্রেলিয়া গেছেন।
তথ্যের বিবরণমতে, চলতি বছরের ১৫-২৯ মে পর্যন্ত চিকিৎসার নামে অস্ট্রেলিয়ায় ছুটি কাটান এসই জুলফিকার তারেক। পরবর্তীতে গত ২১ জুলাই সরকারি আদেশে থাইল্যান্ডে কেয়ার ফর সাউথ এশিয়া প্রজেক্ট কমপ্লিশন অ্যান্ড ডিসসেমিনেশন ওয়ার্কশপ এ অংশগ্রহণের জন্য ২৯-৩১ জুলাই পর্যন্ত ছুটি পান তিনি।
আদেশের শর্তাবলীতে সফরের মেয়াদ বৃদ্ধি করতে পারবেন না উল্লেখ থাকলেও তিনি ওয়ার্কশপে থাকাকালীন সময়েই চিকিৎসার নামে আরও দশদিন ছুটির মেয়াদ বাড়িয়ে নেন। মূলত এই সময়ে তিনি অস্ট্রেলিয়ায় পরিবারের কাছে ছিলেন। ২৯ জুলাই থেকে থাইল্যান্ডে ওয়ার্কশপ শুরু হলেও ২৪ জুলাই থেকে তিনি চট্টগ্রামের কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন।
আবার ১০ আগস্ট ছুটির মেয়াদ শেষ হলেও কর্মস্থলে আসেন ১৬ আগস্ট। এক ওয়ার্কশপের নামে ছুটি কাটিয়েছেন ২৩ দিন। এভাবেই ২০১৯ সাল থেকে একাধিকবার সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাস্ট্র ও থাইল্যান্ড সফর করেছেন। ছুটির অফিস আদেশগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, বেশিরভাগ সময় চিকিৎসার নামে কাটিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায়।
পাউবো, চট্টগ্রাম আঞ্চলিক অফিসের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর ভাষ্য, এসই জুলফিকার তারেকের দেহ-মন সব অস্ট্রেলিয়ায়। ফলে তিনি চট্টগ্রামে অফিসও ঠিকমতো করেন না। সপ্তাহের এক বা দু‘দিন দৈনিক ২-৩ ঘন্টা করে অফিস করেন। বাকি সময় নানা অজুহাতে থাকেন অজ্ঞাত স্থানে। যা এসইর বিশ্বস্ত এক্সিয়েন ছাড়া অন্য কেউ জানেন না।
আর এই বিশ্বস্ত এক্সিয়েনদের হাত দিয়ে কমিশনের টাকা গুনে নিয়ে ফাইলে স্বাক্ষর করেন তিনি। আর দূর্নীতির ঘুষের টাক পাচার করেন অস্ট্রেলিয়ায় পরিবারের কাছে। সেখানে উনার বাড়ি, গাড়ি সব আছে। অর্থপাচার বা দূর্নীতিতে ধরা পড়লে তিনি যে কোন সময় দেশ ছাড়তে পারেন।
কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদাররা জানান, চট্টগ্রামে চলমান সব বড় প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) তিনি। যেখান থেকে ১০% হারে কমিশন থেকে পাওয়া কোটি কোটি টাকা অস্ট্রেলিয়ায় পাচার করেন। এর আগে চট্টগ্রাম পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী পদে থাকাকালীন সময়েও ব্যাপক দুর্নীতি করেছেন।
২০২৩ সালে চট্টগ্রামের এসই পদে যোগ দেয়ার পর থেকেই পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ দিতে মরিয়া হয়ে উঠেন তিনি। সন্দ্বীপ, আনোয়ারা, বাঁশখালী, সীতাকুন্ড ও রাঙামাটির ৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ে ৫টি চলমান প্রকল্পের কাজ তার পছন্দের ঠিকাদাররাই পেয়েছেন। এর আগে ২৩-২৪ ও ২৪-২৫ অর্থবছরে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার কাজ সমাপ্ত করেছেন পছন্দের ঠিকাদার দিয়েই।
মূলত এসব ঠিকাদারদের সাথে রয়েছে এসই জুলফিকারের যৌথ ঠিকাদারি ব্যবসা। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিতর্কিত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান বিশ্বাস বিল্ডার্স। এই প্রতিষ্ঠানের অধীনে এখন চলমান রয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে সন্দ¦ীপ বেড়িবাঁধ প্রকল্পের কাজ। এছাড়া ৮১০ কোটি টাকার আরও দুটি প্রকল্প চলমান।
অথচ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২০৫ কোটি টাকা ব্যয়ে একই প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছিল বিশ্বাস বিল্ডার্স। তখন এই প্রকল্পে ২০ কোটি টাকার কাজও হয়নি বলে অভিযোগ উঠে। এরপরও এসই জুলফিকার তারেকের কল্যানে ফের এই প্রকল্পের কাজ পায় বিশ্বাস বিল্ডার্স।
একইভাবে পটিয়ায় বর্তমানে ১ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা বরাদ্দে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নিষ্কাশন ও সেচ প্রকল্প এবং শ্রীমাই খালে মাল্টিপারপাস হাইড্রোলিক ইলেভেটর ড্রামে ১৩৩ কোটি টাকা বরাদ্দে দুটি প্রকল্প কাজ চলমান আছে। এই দুটি প্রকল্পের পিডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন জুলফিকার তারেক। এছাড়াও বাঁশখালী আনোয়ারায় ৮৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দের বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজের পিডিও তিনি। এসব কাজের কমিশন হিসেবে প্রাপ্ত অর্ধশত কোটি টাকা তিনি অস্ট্রেলিয়ায় পাচার করেছেন।
এছাড়া ঢাকায় বাড়ি, গাড়ি কিনে নিজেও বিলাসী জীবন যাপন করছেন। গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহেও বিপুল সম্পত্তি কিনেছেন। দেশের বিভিন্ন ব্যাংকের একাধিক হিসাবে তার মোটা অঙ্কের লেনদেনের তথ্য রয়েছে। তবে বিষয়টি তিনি অস্বীকার করে বলেছেন, ঢাকায় আমার কোন বাড়ি নেই। ব্যাংকের লেনদেন ও অন্যান্য সম্পত্তির বিষয়ে তিনি কিছুই বলেননি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খ. ম. জুলফিকার তারেক আরও বলেন, ঠিকাদারদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। ঠিকাদারের সাথে এক্সিয়েনদের সম্পর্ক। আমি কোন কমিশন নিই না। আমার ঠিকাদারি কোন লাইসেন্স নেই। যৌথভাবে কোন ঠিকাদারি ব্যবসাও নেই। আমি সরকারি চাকরি করি সে হিসেবে সেটা পারিও না। তবে কোন ফার্মের কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করার সুযোগ রয়েছে।
এক পর্যায়ে তিনি বলেন, আমার এখানে তো অনেক সাংবাদিক আসে। কিন্তু আপনি আসেন না। আপনি আসবেন, সম্পর্ক রাখবেন। আমার এক্সিয়েনদের আমি বলে দিব। আর দৈনিক কালবেলার মালিকানা প্রতিষ্ঠান বিশ্বাস বিল্ডার্সের সাথে আমার সম্পর্ক রয়েছে। সন্দ্বীপ বেড়িবাঁধ প্রকল্পের কাজ বিশ্বাস বিল্ডার্সের পাওয়ায় তাহলে আপনার ভুমিকা রয়েছে-এমন প্রশ্নে তিনি হতচকিত হয়ে উঠেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পাউবো দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী স্বপন কুমার বড়ুয়া বলেন, অর্থপাচার-কমিশন নেওয়া নিয়ে আমার জানার কথা নয়। তাছাড়া আমি এসেছিও সেদিন। আর ফোনে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলা কি ঠিক? আপনি অফিসে আসেন। আর জুলফিকার তারেক বিদেশে গেলে সিমিলার কর্মকর্তাকে অবশ্যই দায়িত্ব দিয়ে যান।
এ বিষয়ে জানতে একাধিকবার ফোন করা হলেও কল রিসিভ করেননি পানি স¤পদ মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মো. মাসুম রেজা। তবে তিনি অন্য এক গণমাধ্যমকে বলেন, ওয়ার্কশপের জন্য এসই জুলফিকার তারেককে ছুটির আদেশ দেয়া হয়। পরে চিকিৎসার কথা বললে ছুটিও বাড়ানো হয়। কিন্তু ছুটি নিয়ে তিনি অন্য দেশে গেলে সেটি আমার জানার কথা নয়। বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হবে।
কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারদের ভাষ্য, এসব বিষয়ে বাপাউবোর উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানলেও সহযোগীর মতো নিরব ভুমিকা পালন করছেন। ফলে এ বিষয়ে তারা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও দুদকে অভিযোগ দায়ের করবেন।
ঈশান/খম/মসু
(প্রেস নোট : পাউবো চট্টগ্রামের এসই খ. ম জুলফিকার তারেকের দূর্নীতির ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করবে দৈনিক ঈশান। পরবর্তী প্রতিবেদনে থাকছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। প্রিয় পাঠক চোখ রাখুন দৈনিক ঈশানের অনলাইন ও প্রিন্ট ভার্সনে)
You cannot copy content of this page