রবিবার- ২০ এপ্রিল, ২০২৫

প্লাস্টিকের ব্যবহারে চট্টগ্রাম ছাড়খার!

পণ্য পরিবহন ও মজুদ চলছে অবাধে

প্লাস্টিকের ব্যবহারে ক্রমেই ছাড়খার হচ্ছে চট্টগ্রাম মহানগর। নগরীর অলি-গলির নালা-নর্দমা, খাল ভরাট হয়ে যাচ্ছে নিষিদ্ধ পলিথিন ও প্লাস্টিকে। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেও সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। প্লাস্টিকের ভারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে চট্টগ্রামের শ্বাসনালী কর্ণফুলী নদিও। দুষিত হয়ে পরিবেশ করে তুলছে বিষাক্ত।

বুধবার (০২ আগস্ট) দুপুরে এমন তথ্য জানিয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের সহকারী পরিচালক রুবাইয়েত সৌরভ। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরীর ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ থেকে শুরু করে সবকটি বাজারের দোকানগুলোতে পণ্য পরিবহন ও মজুদে অবাধে ব্যবহার হচ্ছে পলিথিন বা প্লাস্টিকের বস্তা।

অথচ পলিথিন ও প্লাস্টিকের বস্তা ব্যবহার নিষিদ্ধ করে কয়েক দফা প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। পরিবেশ সংরক্ষণ এবং পাটের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করতে ৯ বছর আগে প্রথমবার প্রজ্ঞাপন জারি করে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়। সেই সময় ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার, চিনি সংরক্ষণ ও পরিবহনে বাধ্যতামূলকভাবে পাটের বস্তা ব্যবহারের নির্দেশনা দেয়।

২০১৭ ও ২০১৮ সালে আরো দুইবার প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। সর্বশেষ প্রজ্ঞাপনে ১৯টি পণ্য পরিবহনে পাটের বস্তার ব্যবহারের নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে তদারকির অভাবে এখনো পাটের বস্তার ব্যবহার নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। তবে সম্প্রতি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন পলিথিন ও প্লাস্টিকের বস্তা ব্যবহার রোধে মাঠে নেমেছে।

সেই সূত্র ধরে গত মঙ্গলবার নগরীর চাক্তাই এলাকায় ক্ষতিকর পলিথিন বিরোধী অভিযান চালিয়েছে জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর। এ সময় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে দুটি গোডাউন থেকে প্রায় আড়াই টন ওজনের পলিথিন জব্দ করা হয়েছে। পাশাপাশি গোডাউন দুটি সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে।

অভিযানে নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাাজিস্ট্রেট ও চান্দগাঁও সার্কেলের এসিল্যান্ড মো. মাসুদ রানা। তিনি বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় আমরা এ অভিযান পরিচালনা করেছি। আমরা যখন চাক্তাই যায়, বিষয়টি অবৈধ পলিথিন ও প্লাস্টিকের বস্তা বিক্রেতারা জানতে পারেন। একপর্যায়ে তারা তাদের ব্যবসায়িক গোডাউনে তালা লাগিয়ে পালিয়ে যায়। আমরা তালাবদ্ধ দুটি গোডাউনের তালা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করি এবং প্রায় ২৫০ কেজি (আড়াই টন) পলিথিন জব্দ করে বিনষ্টের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরকে বুঝিয়ে দিই।

এছাড়া গোডাউন দুটিকে সিলগালা করে দেওয়া হয় বলেও জানান তিনি। তিনি আরও বলেন, সিলগালা করা গোডাউনে কোন সাইনবোর্ড ছিল না। ব্যবসায়ীদের নামও পাওয়া যায়নি। স্থানীয়দের জিজ্ঞেস করলে কেউ কারো নাম আমাদের বলেনি। এখন বিষয়টি পরিবেশ অধিদপ্তর দেখবাল করবেন। আমাদের পক্ষ থেকে পরিবেশ অধিদপ্তরকে অধিকতর তদন্ত করে নিয়মিত মামলা করার জন্য বলা হয়েছে। ভবিষ্যতে এ ধরণের অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও জানান ম্যাজিস্ট্রেট মাসুদ রানা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চাক্তাইয়ের চালপট্টি ও পাহাড়তলীর চালের আড়তদাররা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বর্তমানে বাজারে প্লাস্টিকের বস্তার ছড়াছড়ি। উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি অঞ্চল থেকে ১০ শতাংশ মতো পাটের বস্তায় চাল আসছে। শুধু ধান-চাল নয়, দেশের মোট ভোগ্যপণ্যের ৯০ শতাংশই পরিবহন ও মজুদ হচ্ছে প্লাস্টিক বস্তায়।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে একটি পাটের বস্তার দাম পড়ছে প্রায় ৬৫ থেকে ৭০ টাকা। প্লাস্টিকের বস্তার দাম পড়ে ১৫-২০ টাকা। তাই ব্যবসায়ীরাও পাটের পরিবর্তে প্লাস্টিকের বস্তা ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।

খাতুনগঞ্জের আটা-ময়দার ব্যবসায়ী মো. সেলিম বলেন, পাটের তৈরি বস্তায় আটা-ময়দা পরিবহন করাটা কঠিন। কারণ পাটের বস্তায় আঁশ ও ছিদ্র থাকে। আটা ও ময়দার সাথে এসব আঁশ মিশে যায়। অনেক সময় ধুলোবালি বস্তার ছিদ্র দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। এতে আটা-ময়দার গুণগত মান নষ্ট হয়। তবে পাটের বস্তা আটা-ময়দার জন্য উপযোগী করে তৈরি হলে এটি ব্যবহার আমাদের আপত্তি নেই। আটা-ময়দার ক্ষেত্রে সুবিধা-সুবিধার কথা বিবেচনা করে সরকারকে এই বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার।

চট্টগ্রাম রাইচ মিল মালিক সমিতির সাধারণ স¤পাদক রফিক উল্লাহ বলেন, অনেক ক্রেতাই পাটের বস্তার পরিবর্তে প্লাস্টিকের বস্তায় পণ্য নিতে বেশি পছন্দ করেন। কারণ পাটের বস্তার চেয়ে প্লাস্টিকের বস্তায় পণ্য বেশি পাওয়া যায়। বাজারে এখন পাটের বস্তাতেও ধান-চাল পরিবহন হচ্ছে। তবে পরিমাণে অনেক কম।

পাহাড়তলী বণিক সমিতির সাধারণ স¤পাদক এসএম নিজাম উদ্দিন বলেন, আড়তদারদের যেভাবে মিলাররা চাল পাঠাচ্ছেন আমরা সেভাবেই বিক্রি করি। ফলে বাজারে এখন প্লাস্টিক বস্তার ছড়াছড়ি হয়ে গেছে। আড়তগুলোতে অভিযান না চালিয়ে প্রশাসনের উচিত ধান-চালের মোকামগুলোতে নজরদারি বাড়ানো। পণ্য প্যাকিংয়ের ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের বস্তার পরিবর্তে পাটের বস্তার ব্যবহার নিশ্চিত সেখান থেকেই করতে হবে।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা এম রেজাউল করিম চৌধুরী এ বিষয়ে বলেন, পণ্য পরিবহণ ও মজুদের সুবিধার চেয়েও পলিথিন ও প্লাস্টিকের বস্তার ব্যবহার পরিবেশের জন্য মারাত্নক। এই পলিথিন ও প্লাস্টিকের বস্তা নগরীর নালা-নর্দমা ও খালগুলো ভরাট করে দিচ্ছে। এতে সামান্য বৃষ্টিতেও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। আর সবচেয়ে ক্ষতি করছে কর্ণফুলী নদির। পলিথিন ও প্লাস্টিকের বস্তা ব্যবহারকারীদের বুঝতে হবে। কর্ণফুলী নদি ভরাট হয়ে গেলে চট্টগ্রাম বন্দর অচল হয়ে পড়বে। মৎস্যকুলের উপর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। পরিবেশ দূষণ হবে। নগরীতে জলবদ্ধতায় ভোগান্তির শেষ থাকবে না।

তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের সুবিধার কারণে আমরা পলিথিন বা প্লাস্টিকের বস্তা ব্যবহারে সমর্থন করতে পারি না। বরং পলিথিন ও প্লাস্টিকের বস্তা ব্যবহার বন্ধে আমরা জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছি। পলিথিন ও প্লাস্টিকের বস্তা ব্যবহারের বিরুদ্ধে আমরা ইতোমধ্যে কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেছি। অভিযানে পলিথিন ও প্লাস্টিকের বস্তা বিক্রীর কয়েকটি দোকান সীলগালা করে দিয়েছি। আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মো. ফখরুজ্জামান বলেন, আমরা পলিথিন ও প্লাস্টিকের বস্তা ব্যবহারের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছি। এই অভিযান বন্ধ হবে না, যতক্ষণ বাজারে পলিথিন ও প্লাস্টিকের বস্তা পাওয়া যাবে। চট্টগ্রামকে আমরা পলিথিন ও প্লাস্টিকের বস্তা দিয়ে ছাড়খার হতে দেব না।

আরও পড়ুন

No more posts to show

You cannot copy content of this page