মঙ্গলবার- ১৯ আগস্ট, ২০২৫

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক যেন লুটেরাদের ‘গরিবের বউ’

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক যেন লুটেরাদের ‘গরিবের বউ’

# বিনিয়োগের ৯৫ শতাংশই লুটপাট
# ১৯৬ ব্যাক্তি-প্রতিষ্ঠানের পেটে পুরো ব্যাংকের টাকা
# তালিকায় বেক্সিমকো, নাসা, দেশবন্ধুসহ অনেক নামি গ্রুপ

থায় আছে, ‘গরিবের বউ সবার ভাবি’। চাইলেই করা যায় সবরকম ফুর্তি। সেই ‘গরিবের বউ’ ছিল ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যে কয়েকটি ব্যাংকে নজিরবিহীন লুটপাট হয়েছে তার মধ্যে শীর্ষে ব্যাংকটি।

ছোট-বড় সব লুটেরাদের নাইটক্লাব ছিল ব্যাংকটি। নামে-বেনামে ইচ্ছেমতো হাতিয়েছে অর্থ। ছিল না নিয়ম-নীতি ও কাগজপত্রের বালাই। ব্যাংকটির বিতরণকৃত বিনিয়োগের ৯৫ শতাংশই এখন খেলাপি হয়ে গেছে। সম্প্রতি ব্যাংকটির ইনভেস্টমেন্ট মনিটরিং অ্যান্ড রিকভারি বিভাগের একটি প্রতিবেদন থেকে লুটপাটের চাঞ্চল্যকর এমন তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ১৯৬টি প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকটির মোট ৫১ হাজার ২৫ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে, যার মধ্যে বিতর্কিত এস আলম গ্রুপ একাই বেনামি ও নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এস আলমের নামে-বেনামি ঋণ ছাড়াও ব্যাংকটির খেলাপির তালিকায় রয়েছে দেশের অনেক বড় বড় গ্রুপ ও কোম্পানির নাম।

এরমধ্যে শীর্ষে ১০ ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে দেশবন্ধু সুগার মিলস লিমিটেড- ৯৬৮ কোটি, মেসার্স এমআরসি বিজনেস হাউস ৮৭৪ কোটি, মেসার্স গ্লোব ট্রেডার্স ৮০১ কোটি, তাসমিন ফ্লাওয়ার মিলস লিমিটেড ৭২৫ কোটি, মো. নুরুন নবী ৬৫৩ কোটি, মেসার্স সাফরান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ৬৩৩ কোটি, মেসার্স লেজেন্ডারি ইন্টারন্যাশনাল ৬৩২ কোটি, এস.এ. অয়েল রিফাইনারি লিমিটেড ৬৩২ কোটি, মেসার্স ইমেজ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ৫৯৮ কোটি টাকা।

এছাড়াও ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের তালিকায় রয়েছে ব্যাক্সিমকো, নাসা, অ্যানেক্স, সিকদারের মতো অনেক নামি দামি প্রতিষ্ঠানের নাম। অর্থাৎ ব্যাংকটি লুটপাটে দেশের বড় বড় নামি-দামি প্রতিষ্ঠানগুলোর নাইটক্লাব ছিল।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের মোট বিনিয়োগ তথা ঋণের পরিমাণ ৬০ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা, যার মধ্যে ৫৮ হাজার ১৮২ কোটি টাকাই খেলাপি। শতকরা হিসেবে এটি মোট ঋণের ৯৫ শতাংশ, যা দেশের ব্যাংকিং খাতের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা।

অন্যদিকে, ব্যাংকটির আমানত সংগ্রহের পরিমাণ ৪৩ হাজার ৪৩ কোটি টাকা। মার্চ, ২০২৫ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকটিতে প্রায় ১৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নামসর্বস্ব কাগুজে প্রতিষ্ঠান, ভুয়া দলিল, জামানতকৃত সম্পত্তির অতিমূল্যায়নসহ বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক খেকো এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রিত এই ব্যাংকটিতে দীর্ঘদিন ধরে এই লুটপাট চলছে।

ব্যাংকটির ফরেনসিক প্রতিবেদনেও ভুয়া দলিল দিয়ে কাগুজে কোম্পানির নামে বিনিয়োগ গ্রহণের বিষয়টি উঠে এসেছে। বর্তমানে ব্যাংকটি চাহিদা অনুযায়ী গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে পারছে না।

ব্যাংকটির একাধিক শাখা ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, গ্রাহক ভেদে ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকার বেশি পরিশোধ করা হচ্ছে না, যা গ্রাহকদের মধ্যে চরম আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। আমানতকারীদের টাকা উত্তোলনের চাপ সামলাতে ব্যাংকটি রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। গ্রাহকেরা টাকা জমা না দিয়ে বরং বাজপাখির মতো টাকা উত্তোলনের জন্য ছুটে আসছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান বলেন, তৎকালীন সরকার এই অনিয়মে বাধা দেয়নি, বরং সরকার প্রধানের নাম ব্যবহার করে ব্যাংক খালি করা হয়েছে।

তিনি আরও জানান, এস আলমের লোকজন এখনো নানা অপতৎপরতা চালাচ্ছে এবং ইচ্ছাকৃতভাবে বকেয়া শোধ করছে না। তবে আমরা হতাশ নই, সামনে ব্যাংকটির পরিবর্তন আসবে এবং এ জন্য সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ উদ্যোগ প্রয়োজন। টাকা উত্তোলনের জন্য আমরা আইনগতসহ সব প্রক্রিয়া অবলম্বন করছি।

ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে অসংখ্য অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বেনামি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ প্রদান, বিনিয়োগ সীমা অতিক্রম করে ঋণ অনুমোদন, জামানত বা বন্ধকীকৃত সম্পত্তির অস্বাভাবিক মূল্যায়ন, অনাবৃত জামানতের বিপরীতে ঋণ বিতরণ, মুনাফা মওকুফের নামে মূলধন মওকুফ।

এছাড়াও রয়েছে এমটিডিআর বা স্থায়ী আমানতের বিপরীতে নিয়মবহির্ভূতভাবে মুনাফা বিতরণের নামে অর্থ উত্তোলন, নিয়োগ ও পদোন্নতিতে গুরুতর অনিয়ম এবং আঞ্চলিক বৈষম্য, চুক্তিভিত্তিক মেয়াদ শেষে পুনর্নিয়োগ ছাড়া এক নির্বাহীকে বেআইনিভাবে দায়িত্বে রাখা এবং তাকে বেতন ও বোনাস প্রদান, কর্মস্থলে উপস্থিত না থেকেও বিল উত্তোলনের অনুমোদন এবং জাকাত-সিএসআর ফান্ড বিতরণে অনিয়মসহ নানা অপকর্ম।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর এই তথ্যগুলো প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। এতে আতঙ্কিত হয়ে গ্রাহকেরা একযোগে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন শুরু করলে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে তীব্র তারল্য সংকট দেখা দেয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। যেই পাঁচ ব্যাংকের মার্জার প্রক্রিয়াধীন তারে মধ্যে ওই ব্যাংকও আছে। সবকিছুই নিয়ম মেনেই করা হবে। তবে বকেয়া আদায়ে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। অপরাধীদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ঈশান/খম/সুম

আরও পড়ুন

You cannot copy content of this page