গত ১৩ ফেব্রুয়ারি আমেরিকার ‘হোয়াইট হাউসে’ দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে দ্বিপাক্ষিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা শেষে উভয়ের একটি যৌথ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে জনৈক সাংবাদিক ট্রাম্পকে প্রশ্ন করেন- ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট, হোয়াট ইউ লাইক টু সে অ্যাবাউট দি বাংলাদেশ ইসু, বিকজ উই সও, অ্যান্ড ইট ওয়াজ এভিডেন্ট দ্যাট হাউ দি ডিপ-স্টেট অফ ইউনাইটেড স্টেটস, ইট ওয়াজ ইনভলভড টু রেজিম চেঞ্জ ডিউরিং দি বাইডেন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, দ্যান মোহাম্মদ ইউনূস মেড, দ্যান জুনিয়র সরোস অলসো, সো হোয়াট ইজ ইউর পয়েন্ট অফ ভিউ অ্যাবাউট বাংলাদেশ?’
অর্থাৎ ‘জনাব প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ বিষয়ে আপনি কী বলবেন, কারণ আমরা দেখেছি এবং সেটা দালিলিক যে আমেরিকার গভীর রাষ্ট্রযন্ত্র বাইডেন প্রশাসনের সময় ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটিয়েছে, তারপর মোহাম্মদ ইউনূস এলেন, পরে জুনিয়র সরোসও, তাই বাংলাদেশ নিয়ে আপনার দৃষ্টভঙ্গিটি কী?’ উত্তরে ট্রাম্প জানালেন- ‘দেয়ার ওয়াজ নো রোল ফর আওয়ার ডিপ স্টেট। দিস ইজ সামথিং দ্যাট দ্য প্রাইম মিনিস্টার (মোদি) হ্যাজ বিন ওয়ার্কিং অন ফর এ লং টাইম, ফর হানড্রেডস অফ ইয়ার্স, ফ্রাঙ্কলি আই হ্যাভ বিন রিডিং অ্যাবাউট ইট। আই উইল লিভ বাংলাদেশ টু দি প্রাইম মিনিস্টার।’
অর্থাৎ ‘সেখানে আমাদের গভীর রাষ্ট্রযন্ত্রের কোনো ভূমিকা নেই। এটা এমন কিছু, যা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী (মোদি) দীর্ঘসময় ধরে কাজ করছেন, একশ বছর ধরে, অকপটে বললে তা নিয়ে পড়ছি। আমি বাংলাদেশকে প্রধানমন্ত্রীর ওপর ছেড়ে দিলাম।’ এই শেষ বাক্যটি যেমন ইনডিয়ান মিডিয়ায় ফলাও করা হয়েছে, তেমনি বহুল প্রচারিত ইনডিয়ান জাতীয় দৈনিক ‘হিন্দুস্তান টাইমস’ তাদের ইউটিউব চ্যানেলে সেটির দুই মিনিট এক সেকেন্ডের একটি ভিডিও ক্লিপ যুক্ত করে শিরোনাম দিয়েছে- ‘আই উইল লিভ বাংলাদেশ টু পিএম মোদি : ট্রাম্পস হিউজ স্টেটমেন্ট…’। অর্থাৎ ‘আমি বাংলাদেশকে পিএম মোদির ওপর ছেড়ে দিলাম : ট্রাম্পের ভূয়সী বিবৃতি…’।
একইভাবে ‘দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ ইউটিউবে বিশ্লেষণমূলক তিন মিনিট এক সেকেন্ডের ভিডিও ক্লিপ যুক্ত করে শিরোনাম দিয়েছে- ‘পিএম মোদি ইউএস ভিজিট : ডোনাল্ড ট্রাম্প সেইজ হি উইল লিভ বাংলাদেশ টু পিএম মোদি’। কিন্তু ব্যতিক্রম দেখিয়েছে ‘টাইমস নাও’। তাদের তিন মিনিট ২০ সেকেন্ডের ভিডিও ক্লিপের শিরোনাম দেয়া হয়েছে- ‘মোদি-ট্রাম্প মিট : ইউএস প্রেসিডেন্ট ‘লিভস’ বাংলাদেশ ক্রাইসিস…’। অর্থাৎ ‘মোদি-ট্রাম্প বৈঠক : আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সমস্যাটি ‘পরিত্যাগ করেছেন…’। অনুরূপভাবে ওই বাক্যটি কেবলই প্রশ্নবোধক চিহ্নে আক্ষরিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
দেখুন, বিষয়টা কতটা অন্ধত্ব ও বধিরতাকেও হার মানিয়েছে! যেন ধান ভানতে শিবের গীত। হিন্দুস্তান টাইমস ও ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার এই দুরভিসন্ধিপূর্ণ ভূমিকার কী জবাব হতে পারে? তাই প্রশ্ন জাগে, এই পত্রিকাদ্বয় ওই একই সংবাদ সম্মেলনে আমেরিকা থেকে সম্প্রতি শতাধিক অবৈধ ইনডিয়ানকে বহিষ্কারের বিষয়ে নরেন্দ্র মোদির নতজানু চিত্তে মেনে নেয়া ও অবৈধ অভিবাসনের বিরুদ্ধে দেয়া হিন্দি বক্তব্যটি কেন ফলাও করে প্রচার করেনি?
কেন ফলাও করে প্রচার করেনি- ট্রাম্প সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, আমদানি পণ্যে শুল্ক আরোপ উভয় দেশে অনুরূপ হারে ঘটবে? এটির উত্তর একটাই নিজ স্বার্থে উজ্জীবিত ব্যবসায়িক ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির এই বৈঠক তেমনটা আশাপ্রদ কিংবা ফলপ্রসূ কোনোটাই হয়নি। আর হয়নি বলেই ট্রাম্পের ‘বাংলাদেশকে মোদির ওপর ছেড়ে দিলাম’ এই কথাকে লুফে নিয়ে ইনডিয়ার পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রিও থেমে থাকেননি। ইনডিয়ার এনডিটিভি ওয়ার্ল্ড নিউজের অনলাইন ভার্সনে ‘নো রোল ফর ডিপ স্টেট, লিভ ইট টু পিএম মোদি : ট্রাম্প অন বাংলাদেশ ক্রাইসিস’ শিরোনামের সংবাদে প্রকাশ, সে সময় ওয়াশিংটন ডিসিতে সংবাদ সম্মেলন করে মিশ্রি বলেছেন, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে মোদি তার উদ্বেগের কথাগুলো ট্রাম্পকে জানিয়েছেন।
একই সঙ্গে প্রশ্নোত্তর পর্বে বাংলাদেশের সঙ্গে আগামীর পথে ‘গঠনমূলক ও সুদৃঢ় সম্পর্ক গড়ার’ বিষয়ে মোদির সঙ্গে ট্রাম্পের কথা হয়েছে বলে তিনি জানান। অথচ এনডিটিভি দিবানিশ আছম কর্তৃক সম্পাদিত ওই সংবাদে লিখেছে, আগস্টে ব্যাপক সরকারবিরোধী বিক্ষোভের মুখে ঢাকা থেকে হাসিনার পলায়নের পর ইনডিয়া-বাংলাদেশ সম্পর্ক মুখ থুবড়ে পড়েছে। নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে ফিরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান হয়েছেন, যিনি সংখ্যালঘুদের ওপর উগ্র ইসলামপন্থীদের আক্রমণ রোধে সর্বাত্মক কিছু করতে না পারায় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন।
প্রসঙ্গত, ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘বাংলাদেশকে মোদির ওপর ছেড়ে দিলাম’ এবং একই সঙ্গে বলা ‘সেখানে আমাদের গভীর রাষ্ট্রযন্ত্রের কোনো ভূমিকা নেই। এটা এমন কিছু, যা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী (মোদি) দীর্ঘসময় ধরে কাজ করছেন, একশ বছর ধরে, অকপটে বললে তা নিয়ে পড়ছি’ বক্তব্যটি যথার্থভাবে অনুধাবন করতে গেলে ইনডিয়ার রাষ্ট্রপতি প্রয়াত প্রণব মুখার্জি কর্তৃক ২০১৭ সালে রচিত ও প্রকাশিত ‘দি কোয়ালিশন ইয়ার্স’ বইটি প্রণিধানযোগ্য।
সেখানে প্রণব মুখার্জি লিখেছেন, তার কারণেই বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্যটি সুপ্রসন্ন। এতে ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন উ আহমেদ ইনডিয়া সফরে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করলে প্রণব মুখার্জি লেখেন, বন্দি রাজনীতিকদের মুক্তির ক্ষেত্রে তার গুরুত্বারোপে আমার মনে অনুকূল ধারণার সৃষ্টি হয়। শেখ হাসিনা মুক্তি পেলে তার ক্ষমতাচ্যুতির ভয় ছিল। কিন্তু আমি ব্যক্তিগত দায়িত্ব নিয়ে হাসিনার ক্ষমতারোহণে জেনারেলের ভবিষ্যৎটি অক্ষুণ্ন রাখি। উপরন্তু আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের সঙ্গে দেখা করে এ বিষয়ে আমি তার হস্তক্ষেপ কামনাসহ খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার মুক্তি নিশ্চিত করি।
অতএব, ট্রাম্প ‘বাংলাদেশকে মোদির ওপর ছেড়ে দিলাম’ বলার মাহাত্ম্যটি তাতেই লুকায়িত। অথচ অপ্রস্তুত ও হতবিহ্বল মোদি সেই উত্তর না দিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে হিন্দিতে বললেন, ইনডিয়া শান্তিতে বিশ্বাসী এবং ইউক্রেন-রাশিয়ার মধ্যকার চলমান যুদ্ধের অবসান চায়। জনসমক্ষে ‘বাংলাদেশ’ প্রসঙ্গটাই টানলেন না! সংগ্রহ-যায়যায়দিন প্রতিদিন
You cannot copy content of this page