# যুক্তরাষ্ট্র কমালেও কমেনি চট্টগ্রাম বন্দরে
# খাদের কিনারে পোশাক শিল্প
# বাড়বে মূল্যস্ফীতি
# বেদিশায় ব্যবসায়ীরা
ডলারের ঊর্ধ্বগতি ও চাহিদা সংকটে ধুঁকতে থাকা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন করে শুরু হলো ‘ট্যারিফ’ ঝড়। যার আঘাতের শেষ স্থল হবে রান্নাঘর। এর মধ্যে এই ট্যারিফ ঝড়ে বাড়বে দ্রব্যমুল্য। আর প্রায় খাদের কিনারে দেশের অর্থনীতির প্রধান আয়ের খাত পোশাক শিল্প। এ নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন ও বেদিশায় ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীরা জানান, একদিকে মার্কিন শুল্ক, তার সাথে চট্টগ্রাম বন্দরে সব ধরণের মাশুল বৃদ্ধি। একইসাথে চট্টগ্রাম বন্দরের নিয়ন্ত্রণাধীন বেসরকারি ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোর (আইসিডি) কন্টেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ বৃদ্ধির ঘোষণা। যা ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হচ্ছে। তবে আইসিডি ট্যারিফ কার্যকর হবে ১ সেপ্টেম্বর থেকে।
আর এই ট্যারিফ ঝড়ে স্থিমিত হয়ে পড়তে পারে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য। যার প্রভাব সরাসরি দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ওপর পড়বে। দিশেহারা হয়ে পড়বে গরিব মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষ। বিষয়টিকে সরকারের চরম ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন ব্যবসায়ীরা।
মার্কিন শুল্কে হতাশ ব্যবসায়ীরা
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক বৃদ্ধির ঘোষণা দেয় সেদেশের প্রশাসন। যদিও শেষ পর্যন্ত তা ২০% এ কমিয়ে আনার কথা বলছে বাংলাদেশ সরকার। এরপরও হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা।
হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদ এ প্রসঙ্গে বলেন, চল্লিশ বছরের ব্যবসায় জীবনে রপ্তানি খাতে এমন সংকট কখনও দেখিনি। আমরা ব্যবসায়ীরা হতাশ ও ক্ষুব্ধ।
পরিস্থিতির ভয়াবহতা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমার এক ক্রেতা ইমেইলে জানিয়েছে, ১ আগস্ট থেকে যে শুল্ক বসবে, তা সরানো না গেলে তার দায় আমাকে বহন করতে হবে। আমি সেই শুল্ক কীভাবে বহন করব?
অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, অনেক ক্রেতা ক্রয়াদেশ স্থগিত করেছে। তারা জিজ্ঞেস করছে, বাড়তি শুল্কের কত ভাগের দায় আমরা নিতে পারব। কিন্তু আমাদের পক্ষে এই বোঝা বহন করা সম্ভব নয়।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, দেশের প্রায় একশটি কারখানা, যারা মোট উৎপাদনের ৯০ থেকে ১০০ ভাগ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে এই বাড়তি শুল্কে তারা সবচেয়ে বড় বিপদে পড়েছে।
খাদের কিনারে পোশাক শিল্প
নতুন ২০% শুল্ক আরোপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পোশাকের মোট শুল্কহার দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৩৫ শতাংশে। এটি দেশের প্রধান রপ্তানি খাতের অস্তিত্বের ওপর এক বিরাট আঘাত।
প্রতিযোগী দেশগুলো যখন কম শুল্কে ব্যবসা করছে, তখন এই বিপুল বোঝা নিয়ে আমাদের শিল্প কতটা পথ চলতে পারবে, সেই প্রশ্নই এখন সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে সংশ্লিষ্টদের কাছে।
তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-র সভাপতি মাহমুদ হাসান খানের কথায়, আগে যেখানে আমাদের পণ্য গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে মার্কিন বাজারে প্রবেশ করত, সেখানে এখন ৩৫ শতাংশ শুল্কের বোঝা বহন করতে হবে।
এরই মধ্যে ট্রা¤প প্রশাসনের এই ঘোষণার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ব্র্যান্ডগুলো ক্রয়াদেশ বাতিল করছে বা স্থগিত রাখছে। অনেক ক্রেতা আবার এই বাড়তি শুল্কের বোঝা আমাদের কারখানাগুলোর ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছে।
এই সংকট শুধু পোশাক কারখানার মালিকদের নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের জীবন, ব্যাংকিং, বীমা, পরিবহনসহ পুরো সরবরাহ ব্যবস্থা (সাপ্লাই চেইন) একযোগে ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে পড়েছে। প্রতিটি কারখানা বন্ধ হওয়ার অর্থ শুধু উৎপাদন থেমে যাওয়া নয়, হাজার হাজার পরিবারের আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যাওয়া।
বিজিএমইএ-র তথ্যমতে, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৭৩৪ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। নতুন শুল্কহারে শুধু কর বাবদই গুনতে হবে ২০০ কোটি ডলারের বেশি। এই বিপুল অর্থ দিয়ে ভিয়েতনাম বা ভারতের মতো দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব।
চট্টগ্রাম বন্দরেও ট্যারিফ বৃদ্ধির ঘোষণা
মার্কিন শুল্কের চাপে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা। ঠিক তখনই ঘোষণা এলো চট্টগ্রাম বন্দরের সব ধরণের মাশুল বৃদ্ধির ঘোষণা। যা গড়ে প্রায় ৪০ শতাংশ। ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হচ্ছে এই মাশুল আদায়। আর ঘোষণাকে মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখছেন ব্যবসায়ীরা।
তবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, প্রায় চার দশক পর অর্থাৎ ১৯৮৬ সালের পর এই প্রথম দেশের প্রধান এই সমুদ্রবন্দর তাদের সব ধরনের সেবার মাশুল বাড়াতে চলেছে। যার গড় বৃদ্ধির হার প্রায় ৪০ শতাংশ। বন্দরের আধুনিকায়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য এই পদক্ষেপ অপরিহার্য।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক জানান, ১৯৮৬ সালে নির্ধারিত ট্যারিফ কাঠামোটি এখন যেন জাদুঘরের নিদর্শন। গত ৩৮ বছরে বন্দরের পরিচালন ব্যয়, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির রক্ষণাবেক্ষণ, নিরাপত্তা এবং কয়েক হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন-ভাতা বেড়েছে বহুগুণে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বন্দরের নিজস্ব কেনাকাটার খরচও আকাশচুম্বী। এই মাশুল বৃদ্ধি থেকে প্রাপ্ত অর্থ বন্দরের উন্নয়নে ব্যয় হবে। নতুন নতুন গ্যান্টিক্রেন সংযোজন, ইয়ার্ড সম্প্রসারণ এবং অটোমেশন করা হবে, যার চূড়ান্ত সুবিধা বন্দর ব্যবহারকারীরাই পাবেন।
গত ২৫ জুলাই চট্টগ্রাম বন্দর পরিদর্শন শেষে ট্যারিফ বাড়ানোর কথা জানিয়েছেন নৌ পরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেনও। তিনি বলেন, আমদানি-রপ্তানিতে গড়ে ৩০ শতাংশ ট্যারিফ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। আন্তঃমন্ত্রণালয় ও স্টেকহোল্ডারদের সাথে আলোচনা করেই এ ট্যারিফ বাড়ানো হয়েছে।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের মতো কম মূল্যে বিশ্বের আর কোথাও শিপিং সেবা পাওয়া যায় না। এটি কোনো একতরফা সিদ্ধান্ত নয়। সব অংশীজনের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমেই একটি যুগোপযোগী ও বাস্তবসম্মত ট্যারিফ কাঠামো গঠন করা হয়েছে। এতে রাজস্ব আয় বাড়বে।
ট্যারিফ বাড়ছে যেসব খাতে :
নতুন ট্যারিফ কাঠামোতে বিভিন্ন সেবার মূল্য বাড়ছে। যা নিচে দেওয়া হলো:
পণ্যের স্টাফিং (কন্টেইনারে ভরা): প্রতি কন্টেইনারে ২.৭৩ ডলার থেকে বেড়ে হবে ৬.৪১ ডলার।
লিফট অফ-লিফট অন: প্রতি কন্টেইনারে ৫.৪৬ ডলার থেকে বেড়ে হবে ৮.১২ ডলার।
গ্যান্টিক্রেন চার্জ (২০ ফুট কন্টেইনার): নতুন করে যুক্ত হচ্ছে ২০.৮০ ডলার।
লোডিং/ডিসচার্জিং (২০ ফুট কন্টেইনার): প্রতি কন্টেইনারে বেড়ে দাড়াচ্ছে প্রায় ৬৮ ডলার।
স্টোর রেন্ট (গোডাউন ভাড়া): ৪ দিন ফ্রি টাইমের পর, ২৮ দিন পর্যন্ত ২০ ফুট কন্টেইনারের জন্য দৈনিক ভাড়া হবে ৬.৯০ ডলার।
বন্দরের তথ্যমতে, ২০১৩ সালে একবার মাশুল বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হলেও ব্যবসায়ীদের আপত্তিতে তা স্থগিত হয়ে যায়। এবার ২০১৯ সাল থেকে একটি ¯প্যানিশ পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় নতুন এই কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। যা আগামি ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হচ্ছে।
এ নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং ব্যবহারকারীদের মধ্যে চলছে তীব্র টানাপোড়েন। এই মাশুল বৃদ্ধির চূড়ান্ত প্রভাব যে সাধারণ মানুষের রান্নাঘর পর্যন্ত পৌঁছাবে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই বলে মন্তব্য করেছেন বন্দরব্যবহারকারীরা।
ট্যারিফ বাড়ছে আইসিডিতেও
দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান সহায়ক খাত বেসরকারি ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো (আইসিডি)। মার্কিন শুল্ক ও চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন খাতে ট্যারিফ বৃদ্ধির পর কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ে ট্যারিফ বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছেন এই আইসিডি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশন (বিকডা)।
সম্প্রতি এক বিজ্ঞপ্তিতে নতুন কন্টেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ নির্ধারণ এবং আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে এই ট্যারিফ কার্যকরের ঘোষণা দিয়েছে বিকডা। এতে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য নতুন করে সংকট সৃষ্টি করবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করে বিকডার এই ঘোষণা শিপিং লাইন, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এবং ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারদের কেউ মেনে নিবে না বলে জানিয়েছেন।
আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য এবং শিপিং খাতের বিশ্লেষকরা বলেছেন, সময়টা খারাপ। দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য সংবেদনশীল কঠিন সময় পার করছে। রপ্তানি আদেশ স্থগিত, বাতিল এবং হ্রাসের ঘটনা ঘটছে হরদম। বিশ্ববাজারে অস্থিরতা এবং অভ্যন্তরীণ মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ বৃদ্ধি ব্যবসার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
তারা বলেন, নতুন চার্জ কাঠামো ঘোষণার পর থেকে দেশের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোতে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বিশেষত তৈরি পোশাক শিল্প যারা ট্রা¤েপর শুল্ক আরোপের ধাক্কা সামলে প্রতিযোগিতামূলক দামে পণ্য রপ্তানি করে নিজেদের টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে, তাদের জন্য এটি বড় সংকট সৃষ্টি করবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
তারা আরও বলেন, সবাই মিলে সবার পাশে দাঁড়িয়ে খারাপ সময় পার করতে হবে। বিকডার বিষয়টি নিয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে যৌক্তিক সমাধানে পৌঁছাতে হবে; যাতে আইসিডিগুলো টিকে থাকতে পারে, বাণিজ্যিক পরিবেশও ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
দেশের গার্মেন্টস সেক্টরের বিশ্ববাজারে অবস্থান ধরে রাখার যে নিরন্তর চেষ্টা, বিকডার এই মূল্য বৃদ্ধি তাতে বড় ধরনের ধাক্কা দেবে বলে মন্তব্য করেছেন একাধিক গার্মেন্টস মালিকও।
গার্মেন্টস মালিকরা জানিয়েছেন, এই খরচ সরাসরি পণ্যের কস্টিংয়ে প্রভাব ফেলবে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পণ্য প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে পারে। বিশেষ করে যেখানে ভিয়েতনাম, ভারত, কম্বোডিয়ার মতো দেশ কম খরচে রপ্তানি সুবিধা দিচ্ছে, সেখানে অতিরিক্ত চার্জ বাংলাদেশের রপ্তানিকে ঝুঁকিতে ফেলবে।
বিকডা সূত্র জানিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে আইসিডিগুলো আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করে আসছে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, ব্যাংক সুদের হার বৃদ্ধি, যন্ত্রপাতির ক্রয় ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বৃদ্ধিসহ ক্রমবর্ধমান ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় পূর্বের হারে কার্যক্রম পরিচালনা করা আর সম্ভব হচ্ছে না। তাই রপ্তানি পণ্য বোঝাই কন্টেইনারের ক্ষেত্রে স্টাফিংয়ে ৬০ শতাংশ ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে ৩০ শতাংশ দর বৃদ্ধি করে ১ সেপ্টেম্বর থেকে নতুন হারে হ্যান্ডলিং চার্জ আদায় করা হবে।
আইসিডির ট্যারিফ ঘোষণায় যা আছে
নতুন হারে ২০ ফুট কন্টেইনারের ক্ষেত্রে প্যাকেজ চার্জ নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ হাজার ৯০০ টাকা, ৪০ ফুট কন্টেইনারের জন্য ১৩ হাজার ২০০ টাকা এবং ৪০-৪৫ ফুট কন্টেইনারের জন্য ১৪ হাজার ৯০০ টাকা চার্জ নির্ধারণ করা হয়েছে।
খালি কন্টেইনারের হ্যান্ডলিংয়ের ক্ষেত্রেও চার্জ বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে গ্রাউন্ড রেন্ট ২০ ফুট কন্টেইনারের জন্য ১৫০ টাকা, ৪০ ফুটি কন্টেইনারের জন্য ৩০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। পরিবহন চার্জ নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ ফুট কন্টেইনারের জন্য আড়াই হাজার টাকা, ৪০ ফুট ও ৪৫ ফুটে ৫ হাজার টাকা, সর্বপ্রকার কন্টেইনারের ডকুমেন্টেশন ফি সাড়ে চারশ টাকা। লিফট-অন/লিফট-অফ সাড়ে ৭০০ টাকা।
এছাড়া ভিজিএম চার্জ, শ্রমিক খরচ, প্লাগ-ইন ফি, জিওএইচ চার্জ, কার্গো ও অন্যান্য সেবার ক্ষেত্রেও চার্জ বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। বর্তমানে প্যাকেজ চার্জ (স্টাফিং থেকে বন্দরে প্রেরণ পর্যন্ত) ২০ ফুট কন্টেইনারের জন্য ৬১৮৭ টাকা, ৪০ ফুট এবং ৪৫ ফুট কন্টেইনারের জন্য ৮২৫০ টাকা, গ্রাউন্ড ভাড়া (প্রতিদিন) ২০ ফুট কন্টেইনারের জন্য ১১৫ টাকা ৪০ ও ৪৫ ফুট কন্টেইনারের ক্ষেত্রে ২৩০ টাকা আদায় করা হয়।
উল্লেখ্য, বর্তমানে দেশের মোট রপ্তানি পণ্যের প্রায় ৯৩ শতাংশ এবং আমদানিকৃত কন্টেইনারের ২০ শতাংশ হ্যান্ডলিং করে দেশের ১৯টি বেসরকারি আইসিডি। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের ধারণক্ষমতার তুলনায় ১২ গুণ বেশি খালি কন্টেইনার আইসিডিগুলোতে সংরক্ষিত থাকে। ফলে একদিকে যেমন ডিপোগুলোর ওপর কন্টেইনারের চাপ বাড়ছে তেমনি আইসিডির চার্জ বৃদ্ধি আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের একটি বড় অংশের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে।
বাড়বে মূল্যস্ফীতি
ট্যারিফ ঝড় মোকাবেলার ঘোষণা দিয়ে ব্যবসায়ী ও শিপিং এজেন্টরা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দর ও বিকডা ধাপে ধাপে না বাড়িয়ে একবারে এতো ট্যারিফ বৃদ্ধি অযৌক্তিক এবং আত্নঘাতী। কারণ ত্রিমুখী ট্যারিফ চাপে বাড়বে মূল্যস্ফীতিও।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রিমিয়ার সিমেন্ট পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বলেন, ডলারের দাম ৭৬ টাকা থেকে বেড়ে ১২০ টাকা ছাড়িয়েছে। এতে আমাদের আমদানি ব্যয় এবং উৎপাদন খরচ দুটোই বেড়েছে। বাজারে চাহিদাও কম। এই চরম দুঃসময়ে বন্দরের চার্জ বাড়লে আমাদের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে। এর প্রভাব শেষ পর্যন্ত সিমেন্টের দামের ওপর পড়বে, যা সরাসরি নির্মাণ খাতে আঘাত হানবে। এ নিয়ে চরম বেদিশায় শিল্প মালিক ও ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন বলেন, বন্দরের সেবার বিল আমাদের ডলারে পরিশোধ করতে হয়। ডলারের দাম বাড়ায় আমাদের খরচ তো এমনিতেই প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এর ওপর নতুন করে ট্যারিফ বাড়ানো হলে আমদানি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি আমাদের রপ্তানি খাতও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা হারাবে। এতে মূল্যস্ফীতি সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌছাবে।
সংকট উত্তরণে পরামর্শ
এই সংকটময় মুহূর্তে একে অপরকে দোষারোপের প্রবণতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। কিন্তু তা না করে সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালাতে হবে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ।
তিনি বলেন, সরকার, বিজিএমইএ, ব্যবসায়ী এবং বিশেষজ্ঞ সবাইকে এক টেবিলে বসে এই জাতীয় সংকট মোকাবিলার পথ খুঁজে বের করতে হবে। এই সংকট থেকে কার্যকরভাবে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশকে একটি সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
এর প্রথম ধাপ হিসেবে, শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ওপর একক নির্ভরতা কমিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপান ও মধ্যপ্রাচ্যের মতো নতুন বাজারে রপ্তানি বাড়ানোর জন্য সর্বাত্নক চেষ্টা চালাতে হবে। এর পাশাপাশি পণ্যের বৈচিত্র আনাও অপরিহার্য; সাধারণ পোশাকের গন্ডি পেরিয়ে উচ্চ-মূল্যের ও ভ্যালু অ্যাডেড পণ্য, যেমন : ম্যান-মেইড ফাইবার বা প্রযুক্তি-নির্ভর পোশাক উৎপাদনে মনোযোগ দিতে হবে।
একইসাথে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন খরচ ও সময় কমিয়ে এনে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। সর্বোপরি, পুরো প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা জরুরি, যার জন্য শুল্ক সংক্রান্ত আলোচনার প্রতিটি ধাপে ব্যবসায়ীদের অন্তর্ভুক্ত রাখতে হবে এবং দেশের মানুষকে এ বিষয়ে অবগত রাখতে হবে।
You cannot copy content of this page