
শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সকাল ১০:৩৮ মিনিটে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভূক¤পন অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে ৫.৫ থেকে ৫.৭ মাত্রার মাঝারি এই ভূমিক¤পটির উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীর মাধবদী বা ঘোড়াশালের কাছাকাছি অঞ্চল।
এই ভুকম্পন অনুভুত হয় চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রামজুড়ে। ক¤পনটি বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের মনে চাপা আশঙ্কা জাগিয়ে তুলেছে। মনে করিয়ে দিচ্ছে ১৭৬২ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত হয়ে যাওয়া সবকটি ভুমিকম্পের ভয়াল স্মৃতি। ভাবছে তাহলে কি ভয়াবহ কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে চট্টগ্রাম।
বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, এই অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক নীরবতা হাজার বছরের। এর নিচে চাপা পড়ে আছে রিখটার স্কেলে ৮.৫ থেকে ৯.২ মাত্রার মতো একটি প্রলয়ঙ্করী ভূমিক¤েপর বিপুল শক্তি। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল এখন সেই মহা-ভূমিক¤েপর কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে, যা যেকোনো মুহূর্তে আঘাত হানতে পারে।
সক্রিয় তিন ফল্ট লাইন
ভূ-তত্ত্ববিদদের মতে, চট্টগ্রাম এবং এর নিকটবর্তী দূরত্বে বেশ কয়েকটি সক্রিয় ফল্ট বা চ্যুতি রেখা রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো সীতাকুন্ড-টেকনাফ ফল্ট এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বরকল ফল্টলাইন। যা এই অঞ্চলকে বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।
এছাড়া সক্রিয় ফল্ট লাইনগুলোর উল্লেখযোগ্য হলো, চট্টগ্রাম, ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তের কাছাকাছি বিস্তৃত বার্মিজ ফল্ট লাইন। যেহেতু ভারতের মিজোরাম এবং মিয়ানমার চট্টগ্রামের খুবই কাছাকাছি, বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলে, তাই এই অঞ্চলের ফল্টলাইনে সৃষ্ট যেকোনো বড় ভূমিক¤েপর সরাসরি আঘাত বাংলাদেশে এসে পড়ার আশঙ্কা অনেক বেশি।
ইন্ডিয়ান ও বার্মা প্লেটের ঘর্ষণ
ভূ-তত্ত্ববিদদের মতে, বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের অবস্থান প্রধানত দুটি সক্রিয় টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে রয়েছে ইন্ডিয়ান প্লেট এবং বার্মা প্লেট (বা ইউরেশিয়ান প্লেটের সাব-প্লেট)। ইন্ডিয়ান প্লেটটি প্রতি বছর পূর্ব দিকে বার্মা প্লেটের নিচে ক্রমাগত তলিয়ে যাচ্ছে এবং বার্মা প্লেটটি পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
এই দুই প্লেটের সংযোগস্থলেই সৃষ্টি হয়েছে বিশাল বার্মিজ ফল্টলাইন বা চ্যুতি। বিশেষজ্ঞদের দীর্ঘ গবেষণায় উঠে এসেছে যে, এই দুটি প্লেটের ঘর্ষণে এই অঞ্চলে বিপুল পরিমাণ স্থিতিস্থাপক শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে, যা প্রায় ৪০০ বছর ধরে জমা হচ্ছে বলে অনুমান করা হয়। মূলত এই ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের কারণেই চট্টগ্রাম, সিলেট ও ঢাকা অঞ্চলকে বাংলাদেশে ভূমিক¤েপর সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
দুই প্লেটের মরণফাঁদ
ভূমিক¤প বিশেষজ্ঞরা ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক হুমায়ুন আখতারের দীর্ঘ গবেষণার ফল বলছে, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অঞ্চল দুটি শক্তিশালী টেকটোনিক প্লেটের মিলনস্থল, যা ভূতাত্ত্বিক ভাষায় সাবডাকশন জোন নামে পরিচিত।
পশ্চিম থেকে আসা ভারতীয় প্লেটটি ক্রমাগত পূর্বের বার্মা প্লেটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। এই প্লেট দুটির মধ্যে সংঘর্ষের ফলে এই সাবডাকশন জোনের পশ্চিম প্রান্তে, অর্থাৎ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে, বহু বছর ধরে বিপুল পরিমাণ স্থিতিস্থাপক শক্তি জমা হয়ে আছে।
বিশেষজ্ঞদের সতর্কবাণী অনুযায়ী, এই অঞ্চলে গত প্রায় এক হাজার বছরের মধ্যে বড় মাত্রার কোনো ভূমিক¤েপর শক্তি পুরোপুরি মুক্ত হয়নি। এই দীর্ঘ নীরবতা সংকেত দিচ্ছে, সঞ্চিত শক্তির পরিমাণ এখন ধারণক্ষমতার চূড়ান্ত পর্যায়ে।
অধ্যাপক হুমায়ুন আখতারের বিশ্লেষণ আরও উদ্বেগজনক: আমরা শুধু জানি এই সঞ্চিত শক্তি এক সময়ে বের হবেই। এর কোনো বিকল্প নেই। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভূমিক¤প অবধারিত। সঞ্চিত শক্তি যখন ধারণক্ষমতা ছাড়িয়ে যাবে, তখন সেখানে যে ভয়াবহ ভূমিক¤প হবে, তার মাত্রা রিখটার স্কেলে ৮.৫ থেকে ৯.২ পর্যন্ত হতে পারে।
অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার গবেষণার বিস্তারিত জানিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিক¤েপর প্রধান দুটি উৎসের মধ্যে একটি হচ্ছে সিলেট থেকে ত্রিপুরা হয়ে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, টেকনাফ পর্যন্ত। এই উৎসটি খুব ভয়ংকর।
তিনি আরও বলেন, সাবডাকশন অঞ্চলের পশ্চিম প্রান্তে বাংলাদেশের ভেতরে প্রচন্ড সংঘর্ষের কারণে প্রচুর শক্তি জমা হয়ে আছে। এই সঞ্চিত শক্তি একবারেও যেমন বের হতে পারে, আবার ধীরে ধীরেও বের হতে পারে।
সাবডাকশন জোনে ছোট ক¤পন
বিজ্ঞানীদের দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, এই সাবডাকশন অঞ্চলের পূর্ব প্রান্তে প্রায়ই ভূমিক¤প হয়। এখানে সঞ্চিত শক্তি পাঁচ থেকে দশ বছর পর পর বের হয়ে যায় এবং এর মাত্রা থাকে রিখটার স্কেলে পাঁচ থেকে ছয়। সবশেষ যে ভূমিক¤প হয়েছে তারও কেন্দ্র ছিল মিয়ানমারে।
গত কয়েক মাসে বার্মিজ ফল্ট লাইনে বারবার ৫-এর বেশি মাত্রার ভূমিক¤প সংঘটিত হওয়া ইঙ্গিত দিচ্ছে যে এই স্থানটিতে সঞ্চিত শক্তির মুক্তি অতি সন্নিকটে। ছোট ছোট এই ক¤পনগুলো বড় ভূমিক¤েপর পূর্বাভাস হতে পারে।
চট্টগ্রামের কাছাকাছি যত ভূমিক¤প
২০২৩ সালের ২ ডিসেম্বর সকালে রামগঞ্জ, চট্টগ্রাম/ফেনীর কাছাকাছি ৫.৫ মাত্রার ভূমিক¤প। এর আগে ২০২২ সালের ২১ জানুয়ারি বিকেলে মিয়ানমারের ফালাম শহরে ৫.৪ মাত্রার ক¤পন অনুভূত হয়েছিল, যা চট্টগ্রাম থেকে মাত্র ২২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ছিল।
এর আগে ২০২১ সালের ২৬ নভেম্বর ভোর ৫:৪৫ মিনিটে ভারত-মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন মিজোরামের কাছে ৬.২ মাত্রার একটি শক্তিশালী ভূমিক¤প হয়েছিল, যা চট্টগ্রাম থেকে তুলনামূলকভাবে নিকটবর্তী দূরত্বে অবস্থিত ছিল।
এর আগে ১৯৯৭ সালের ২১ নভেম্বর বিকেল ৪:২৩ মিনিটে (স্থানীয় সময়) সংঘটিত ৬.১ মাত্রার ভূমিক¤পটির উৎপত্তিস্থল ছিল ভারত-বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন মিজোরাম রাজ্যে। চট্টগ্রাম নগরীর নিকটবর্তী দূরত্বে হওয়া এই ভূমিক¤েপ একটি পাঁচতলা ভবন ধসে ২৩ জন নিহত হয়েছিলেন।
ভূতত্ত্বের অংকে জমা বিপুল শক্তি
ভূ-তত্ত্ববিদদের ধারণা, প্রতি ১৫০ বছর পর পর এই অঞ্চলে একটি বড় ভূমিক¤েপর পুনরাবৃত্তি হয়। সে হিসেবে ১৭৬২ সালের মহা-ভূমিক¤েপর পর দীর্ঘ প্রায় ২৬৩ বছর কেটে গেছে। এই সময়ে একই ফল্টলাইনে আবার বিপুল পরিমাণ শক্তি জমা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের এই ধারণার মূলে রয়েছে ১৭৬২ সালের ২ এপৃলের এক ভয়াবহ স্মৃতি। ঐতিহাসিক দলিল অনুযায়ী, ওইদিন বিকেল ৫টার দিকে চট্টগ্রাম ও আরাকান উপকূলের মধ্যবর্তী বঙ্গোপসাগরের তলদেশে প্রায় ৮.৫ থেকে ৮.৮ মাত্রার একটি মেগাথ্রাস্ট ভূমিক¤প আঘাত হেনেছিল।
এর ফলে চট্টগ্রাম, ফেনী, এমনকি কুমিল্লা পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। গ্রেট আরাকান আর্থকোয়েক নামে পরিচিত ওই ভূমিক¤েপ টেকনাফ থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত ৮.৫ মাত্রার ক¤পনে সেন্টমার্টিন দ্বীপ তিন মিটার উপরে উঠে এসেছিল এবং বিশাল সুনামির সৃষ্টি হয়েছিল। এ পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিক¤প।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পূরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদি আহমেদ আনসারী বলেছেন, বড় ভূমিক¤পগুলো ১৫০ বছর পরপর ফিরে আসার আশঙ্কা থাকে। এদিক থেকে ৭ মাত্রার ভূমিক¤পগুলো ফেরত আসার সময় হয়ে গেছে।
তবে বিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা গেছে সাবডাকশন জোনে বড় আকারের দুটো ভূমিক¤েপর মাঝখানে সময়ের ব্যবধান হচ্ছে ৮০০ থেকে ৯০০ বছর। এই হিসেবে আরেকটা বড় মাপের ভূমিক¤প বাংলাদেশের দ্বারপ্রান্তে অপেক্ষা করছে।
অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার ¯পষ্ট করে বলেছেন, যে কোনো সময়ে এটা হতে পারে। আগামী ১০ বছরে হতে পারে আবার ৫০ বছরের মধ্যেও হতে পারে। তাদের মতে, ১৭৬২ সালের ভূমিক¤পটি ছিল এক বিশাল বিপর্যয়, এবং সেই শক্তির মুক্তির সময়কাল এখন আরও কাছে চলে এসেছে।
চরম ঝুঁকিতে দেড় কোটি মানুষ
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, যদি রিখটার স্কেলে ৭.৫ থেকে ৮ মাত্রার একটি ভূমিক¤প চট্টগ্রাম শহরে আঘাত হানে, তবে এক বিশাল মানবিক বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।
কারণ অপরিকল্পিত নগরায়ন, পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন এবং কর্ণফুলী নদীর পশ্চিম তীর সংলগ্ন বেলে মাটির ওপর নির্মিত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো যেমন বন্দর ও বিমানবন্দর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।
তাদের মতে, চট্টগ্রামে প্রায় দেড় কোটি মানুষের বসবাস এবং লক্ষাধিক ভবন, যার মধ্যে স্কুল, কলেজ ও হাসপাতাল রয়েছে, যা মাঝারি থেকে বড় মাত্রার ভূমিক¤েপর ঝুঁকি বহন করছে। মোটকথা, ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে দাড়িয়ে আছে চট্টগ্রাম।
প্রয়োজন দ্রুত প্রস্তুতি
অধ্যাপক হুমায়ুন আখতারের শেষ কথা এটিই: আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় হুমকি সিলেট এবং চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল। কারণ এসব অঞ্চলেই সবচেয়ে বেশি শক্তি সঞ্চিত হয়ে আছে। সেটা মাথায় রেখে আমাদের প্রয়োজন দ্রুত প্রস্তুতি।
ভূতত্ত্ববিদদের মতে, সরকারকে দ্রুততম সময়ে ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড যথাযথভাবে অনুসরণ করে নতুন ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করতে হবে। পুরোনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করে জরুরি ভিত্তিতে সেগুলোর রেট্রোফিটিং করা এখন সময়ের দাবি।
You cannot copy content of this page